কপালে আরও কত দুর্ভোগ, কে জানে-সময়ের কথা by অজয় দাশগুপ্ত

সেই পুরনো কৌতুকটি আবার বলছি। এক জেলের জীবন চলত কায়ক্লেশে। তদুপরি ছিল স্ত্রীর তরফে সন্দেহজনিত কারণে খানিক বিড়ম্বনা। স্বামী জাল নিয়ে নদী থেকে ফিরতে দেরি করলে তার সন্দেহ হতো_ নিশ্চয়ই এমন কেউ রয়েছে (অবশ্যই মহিলা এবং তার চেয়ে সুন্দরী), যার কাছে কিছু মাছ রেখে তারপর বাড়ি আসে।


এক সকালে জেলের জালে উঠল এক মাথার খুলি। প্রথমে সে পেল ভয় এবং তারপর খুলিতে কিছু লেখা দেখে বিস্ময়। এতে লেখা ছিল :'না জানি কপালে আরও কত দুঃখ আছে!'
জেলে বুঝতে পারে, এ খুলি যার তার অবশ্যই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। নইলে তো মরদেহ মাটি দেওয়া কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হতো। অপঘাতে মরণ এবং যথাযথ সৎকার না হওয়ার পরও কপালে কী দুঃখ থাকতে পারে, সেটা জেলে ভেবে পায় না। রহস্য উদ্ঘাটনের বাসনায় তাকে পেয়ে বসল এবং খুলিটা বাড়ি নিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে দিল। এ সময় স্ত্রী ছিল রান্না ঘরে, সে কিছুই দেখতে পায়নি। জেলে বাজারে গেল মাছ বিক্রি করতে। এক সময় স্ত্রীর নজরে পড়ল খুলিটি এবং তার কপালের অংশের লেখা। তার সন্দেহ হলো_ এটা নিশ্চয়ই স্বামীর কোনো সাবেক প্রেমিকার হবে। এখনও ভুলতে পারেনি বলে ঘরে এনে রেখেছে। তার রাগ এবং ক্রোধ-ক্ষোভ হলো যথেষ্ট মাত্রায়। এর জেরে খুলিটা নিয়ে সে ঢেঁকিতে চূর্ণবিচূর্ণ করে নোংরা পানির ডোবায় ফেলে দিল। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গোমরামুখো স্ত্রীর কাছে সব শুনে জেলে হেসে বলল, 'খুলিতে তাহলে ঠিকই লেখা ছিল। মরলেও দুর্ভোগ শেষ হয় না।'
ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় দূতাবাস রয়েছে। এ দেশটির সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনেক। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশকেও তারা একহাত দেখিয়ে দিতে পারে। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতা মনে করেন, দলের ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দরকার আছে। ওয়াশিংটনের কর্তারা নাখোশ হতে পারে, এমন পদক্ষেপ সাধারণত কেউ নিতে চায় না। বরং তারা সদা তৎপর থাকে, এ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য। চীন ও ভারতও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার এ দুটি দেশের লোকসংখ্যা এখন প্রায় আড়াইশ' কোটি। তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ক্রমে জোরালো হচ্ছে। এক সময়ে ভারতকে আমাদের দেশেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হতো। এখন এ মনোভাব বদলাতে শুরু করেছে। এ তিনটি দেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক চিত্র সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন যায়, তাতে সন্দেহ নেই। তাদের ঢাকার দূতাবাসের লোকরাই এটা পাঠায় এবং তাতে দোষের কিছু নেই। আরও কয়েকটি দেশ, যেমন_ পাকিস্তান, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স, কানাডা প্রভৃতি দেশের দূতাবাসও ঢাকায় বেশ সক্রিয় এবং তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চিত্র তাদের মতো করে ফুটে ওঠে। তথ্য-খবর সংগ্রহের জন্য তারা বাংলাদেশের সংবাদপত্র মনিটর করে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য রাখে। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তারা জেনে নিতে চায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি। খানাপিনার অনুষ্ঠানেও কথা হয়। দূতাবাসের পার্টিতেও কথা হয়। অনেকে এসব অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। কিন্তু উইকিলিকস একের পর এক কূটনৈতিক বার্তা ফাঁস করে দিতে থাকায় অনেকে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন। কবে কোথায় কার কাছে গোপনে-নিভৃতে কিছু হয়তো বলেছে, এখন তা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো তার বস সম্পর্কে মন্তব্য করেছে। কেউ হয়তো দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করেছে। কেউ হয়তো বলেছে সামরিক বাহিনী সম্পর্কে। এখন দেখা যাচ্ছে, একান্ত ব্যক্তিগত কথা ঢাকার মার্কিন দূতাবাস-ওয়াশিংটনের মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর-উইকিলিকস হয়ে ঢাকার সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সব কথা বিপদ ডেকে আনে না। কিন্তু কিছু কিছু কথা বিপদ ঘটাতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে তার পুত্র তারেক রহমানের দুর্নীতি-অনিয়ম প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন, সেটা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরেরই এক পদস্থ কর্মকর্তা। এমনটি যে ঘটছে সেটা দেশবাসীর অনেকের মুখে মুখে রটনা ছিল। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক পদস্থ কর্মকর্তার মুখ থেকে সেটা জানা যায়, তাতে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। উইকিলিকসের বরাত দিয়ে ঢাকার সংবাদপত্রে ওই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে 'নির্দোষ' প্রমাণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তাতে সাবেক মনিবের কাছে কি নিজেকে ফের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারবেন? তারেক রহমান যদি ফের ক্ষমতার অলিন্দে আসতে পারেন, তাহলে তিনিই-বা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন?
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রতিবেদনগুলো ফাঁস হচ্ছে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এটা ঘটছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী নিজের আরামদায়ক জুতা আনার জন্য ব্যক্তিগত বিমান পাঠিয়েছিলেন, এ খবরও ভারত-আমেরিকা ঘুরে ভারতের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অনেক দেশ থেকে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পাঠানো বার্তার কারণে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কোনো কোনো প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের সম্পর্কে এমন সব ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও মতামত থাকে, যা ফাঁস হয়ে গেলে বিপদ। কারও গোপন প্রেমের খবর এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। এমনটি হলে তাতে অনেক পত্রিকায় দিনের পর দিন রসাল খবর থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ফাঁস হওয়া খবরকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণ বিষয়টিকে কীভাবে দেখে, সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে এখানকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস যেসব বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছে তার অনেকগুলোতে দেখা যায়, সরকার এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে মতামত রয়েছে। পর্যবেক্ষণ যথার্থ হতে পারে, নাও হতে পারে। তারা কাউকে দুর্নীতিবাজ বললেই সেটা সত্য হয়ে যাবে, সেটা ঠিক নয়। তবে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষিত তারেক রহমান সম্পর্কে অভিমত অনেককেই চিন্তায় ফেলতে পারে। এতে তাকে ভয়ঙ্কর রাজনীতিক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তিনি যে দুর্নীতিতে যুক্ত সেটাও বলা হয়েছে। বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের প্রতি তিনি হুমকি, এটাও বলা হয়েছে। তিনি যেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্যও ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে সুপারিশ করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী অভিযুক্ত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও এ মত অনেকে পোষণ করেন। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র যার বল্পুব্দ তার আর শত্রুর দরকার হয় না; বল্পুব্দ হিসেবে ভান করে যে যাকে-তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। এর বিপরীতে রেখে তারা কী বলবেন যে তারেক রহমান অন্তত ভাগ্যবান। কারণ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে বিপদে পড়তে হবে না। কেউ মনে করতে পারেন, বিএনপির এ ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি এখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে পারেন। বাংলাদেশে এখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন তেমন জোরালো নেই। তার মতো জনপ্রিয় কাউকে নেতৃত্বে পেলে মন্দ হয় না।
দেখা যাক, পানি কোনদিকে গড়ায়। আমরা এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা ফাঁস হতে দেখছি। উইকিলিকসের মতো কেউ কি অন্য দেশের পাঠানো বার্তা ফাঁস করে দেবে? সেটা হলে কিন্তু মন্দ হয় না_ অন্তত কিছু লোকের শিক্ষা হবে যে সব স্থানে সব কথা বলতে নেই। কোনো দূতাবাস নিমন্ত্রণ করে কিছু উপাদেয় খাবার ও পানীয় ধরিয়ে দিলেই সরকারের হাঁড়ির খবর জানিয়ে দিতে হবে কেন? দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই-বা দিতে হবে কেন? তবে অনেকে মনে করেন, সামান্য নয়, কখনও কখনও ভালো এনামও মেলে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে বিদেশের স্বার্থ রক্ষার বিনিময়ে। এদের কীর্তিকলাপ প্রকাশ হলে মন্দ হয় না। তাতে জনগণ সতর্ক হতে পারে। রাজনীতি পরিশীলিত হওয়ারও কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিএনপি নেতা ও সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন দেশের স্বার্থ নস্যাৎ করে কানাডার একটি কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। তার মতো আরও অনেকেই এমন কাণ্ড করে চলেছেন। কিন্তু সবাইকে হাতেনাতে ধরা যায় না। এ ক্ষেত্রে নতুন কোনো উইকিলিকস এগিয়ে আসে কি-না, তার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
তবে বিপদের দিকও রয়েছে। তথ্য ফাঁসের নামে ব্ল্যাকমেইল করা হতে পারে। ব্যক্তিবিশেষ কিংবা সরকারকে বিপদে ফেলা যেতে পারে। প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার নামে, এমনকি সরকারের পতনও ঘটিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। তারা হয়তো বাংলাদেশের কোনো নেতাকে অপছন্দ করল কিংবা এমনকি সরকারকে মনে করছে তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি। এ অবস্থায় সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে কোনো প্রতিবেদন 'নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে' তা উইকিলিকস বা অন্য কোনো সূত্রে প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দেওয়াও অসম্ভব নয়। এটা যে মিথ্যা এবং প্রকৃতই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেটা বুঝতে না বুঝতেই অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সাধারণ নির্বাচনের আগে পছন্দের দলকে সুবিধা করে দিতে এবং অপছন্দের দল সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে জনমনকে বিষিয়ে তোলার ঘটনাও অসম্ভব নয়। এভাবে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত কোনো রাজনৈতিক নেতাকে 'ডুবিয়ে দেওয়াও' সম্ভব।
অতএব, সাধু সাবধান। কথা বলতে হবে হিসাব কষে। এটাও মনে রাখবেন, কপালে আরও দুর্ভোগের কথা লেখা থাকতেই পারে। আর তেমনটি ঘটলে, এমনকি ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে চলে গেলেও বিপদ হতে পারে।

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.