আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা-অর্থনীতি by বাবুল চৌধুরী
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের বিজ্ঞ বোর্ডের কোনো দৃঢ় প্রতিক্রিয়া নেই। বোর্ড, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে তথ্য দিতে হবে। হিসাবায়নের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত যে তথ্য ও উপাত্তের ওপর ব্যাংকের স্ট্রেংথ মূল্যায়িত হচ্ছে,
তার যথার্থতা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যাচাই করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের 'আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০১০' উন্মুক্ত করেন। এর কয়েকদিন পর বিভিন্ন পত্রিকায় সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদায়ী ২০১১ সালের পরিচালন মুনাফা প্রকাশিত হয়েছে। বিষয় দুটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিবিড় এবং সরলরৈখিক।
আর্থিক স্থিতিশীলতা বলতে ব্যাংক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকেই বোঝায়। যার সঙ্গে সামগ্রিক ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পৃক্ত। আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই ব্যাংকের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। এখানে অসুস্থ কার্যক্রম বা বিচ্যুতির কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আর্থিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনেক গুরুত্ব বহন করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় দুটি বিষয়কে ব্যাংকের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে যথাযথ তারল্য ব্যবস্থাপনা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মূলধন বৃদ্ধি। এর মধ্যে তারল্য ব্যবস্থাপনা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকে ঋণ বিতরণ ও আমানতের ভারসাম্য (ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও-সিডিআর) রাখা আবশ্যক। কিন্তু সম্প্রতি তা আশঙ্কাজনকভাবে প্রমিত মাত্রা থেকে নেমে যায়; যার কারণ অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংক ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত বর্তমান ৮৫ থেকে নামিয়ে ৮২ শতাংশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ঋণ বিতরণ ও আমানত গ্রহণে ব্যাংকগুলোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খল আচরণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
মূলধন কোনো ব্যাংক/কোম্পানির সম্পদ ও মালিকানার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করে। মূলধনের উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকের ফান্ডের উৎস এবং ক্ষতি ধারণ (Absorb) করার কুশন। ব্যাংকে যে কোনো সময় তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। তা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে এবং আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় মূলধনের ভিত্তি বাড়ানো একান্ত আবশ্যক। দেশের ব্যাংক খাত ব্যাংকিংয়ে আন্তর্জাতিক মান সংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাসেল-২-এর মধ্যে আছে। এ ধাপে ২০১১ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বা ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের ১০ শতাংশ_ এ দুইয়ের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করার কথা। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা থাকতে হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোতে জানুয়ারি, ২০১০ থেকে ব্যাসেল-২ প্রচলন করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক এবং এর কার্যক্রম অতীতের যে কোনো সময় থেকে বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে। আমেরিকার ব্যাংক ব্যবস্থায় দেউলিয়াত্বের ফলে সম্প্রতি বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে সে বিবেচনায় ব্যাংকের কার্যক্রমে বৈশ্বিক রূপ আরও জোরালো হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি আর জি-৮-এর নীতি নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা জি-২০-এর মধ্যে চলে গেছে। জি-২০-ভুক্ত অর্থনীতির দেশগুলোর নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মূলধন কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় এখন থেকে মূলধন সংরক্ষণের হার ১২-১৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা উঠেছে। যাতে ব্যাসেল-৩-এর দিকে ব্যাংক খাত দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
পরিচালন মুনাফা বলতে কোনো ব্যাংক/কোম্পানি/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের পার্থক্যকে বোঝায়। পত্রিকার তথ্যানুযায়ী দৃশ্যত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা সন্তোষজনক। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক ব্যবসা ভালো হবে। তবে বড় অঙ্কের এ পরিচালন মুনাফার মধ্যে বড় ধরনের হিসাবের ফাঁক বা 'উইন্ডো ড্রেসিং' থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কারও কারও সন্দেহ আছে। যদি তা-ই হয় তবে বিষয়টি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা প্রতারণার শামিল এবং এ দুষ্টচক্র থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। ব্যাংকিং এথিক্সের সঙ্গে বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
পরিচালনা মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। নিট মুনাফা নির্ধারিত হয় পরিচালনা মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) এবং করপোরেট কর (৪২.৫ শতাংশ) বাদ দেওয়ার পর। এর ওপর অনেক ব্যাংক সাধারণ রিজার্ভ খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখে। পরিচালন মুনাফার মধ্যে যদি ফাঁক বা 'উইন্ডো ড্রেসিং' থাকে তাহলে তো সব ক্ষেত্রেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এবং ব্যাংক ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এ ধরনের প্রভিশন এবং মূলধন সংরক্ষণ দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকের ঝুঁকি রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মুনাফা হলো ব্যাংক ব্যবসার সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি। এখানে আপসের কোনো অবকাশ নেই। প্রফিট করুন, কীভাবে করবেন, জানি না_ এ ধরনের অসুস্থ মানসিকতা থেকে বোর্ড/ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বের হয়ে আসতে হবে। রিস্ক মিটিগেট করার জন্যই মুনাফা থেকে প্রভিশন, মূলধন এবং বিভিন্ন ধরনের রিজার্ভ রাখা হয়। প্রকৃত মুনাফা বৃদ্ধি পেলে সিএসআর কার্যক্রমও বাড়ানো সম্ভব হবে।
ব্যাংকের আয়ের খাত বহুমুখী হলেও তা বহুলাংশে ধ্রুপদী ব্যাংকিং অর্থাৎ আমানত ও অগ্রিমকেন্দ্রিক। জি-২০-ভুক্ত অর্থনীতির দেশগুলো ঋণের পরিমাণ এবং গুণগত মানের সঙ্গে লিভারেজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। লিভারেজ হলো ডেট-ইকুইটি রেশিও। গুণগত মান বিবেচনায় আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের লিভারেজ অতিমাত্রায় বেশি। ফলে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণও বেশি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের শর্ত ভঙ্গ করে ক্রমাগত ঋণ বিতরণে, নিয়মিতভাবে অন্য ব্যাংকের কুঋণ ক্রয় করা ও বিএমআরই'র নামে ঋণ বৃদ্ধি করা, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও অবলোপন এবং ঋণের সুদ মওকুফ, সঠিকভাবে শ্রেণীকরণ না করা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সরকারি ব্যাংককে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের বিজ্ঞ বোর্ডের কোনো দৃঢ় প্রতিক্রিয়া নেই। বোর্ড, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে তথ্য দিতে হবে। হিসাবায়নের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত যে তথ্য ও উপাত্তের ওপর ব্যাংকের স্ট্রেংথ মূল্যায়িত হচ্ছে, তার যথার্থতা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যাচাই করতে হবে। বাণিজ্যিক নিরীক্ষা, বহিঃনিরীক্ষা (সিএ ফার্ম) কর্তৃক যাচাই করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততা প্রয়োগ করতে হবে। হিসাবায়নের ক্ষেত্রে মুনাফা প্রদর্শনে স্বচ্ছতা না থাকলে এর অভিঘাত সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালকে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য সংস্কারের বছর ঘোষণা করেছে। বিগত চলি্লশ বছরে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে ধারাবাহিকভাবে সংস্কার চলছে। এখন বোধহয় মূল্যায়নের সময় এসেছে; যা থেকে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। সংস্কারের প্রতিটি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই ব্যাংক খাতে সঠিক মুনাফা প্রদর্শনপূর্বক আমাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।
বাবুল চৌধুরী : ব্যাংকার
আর্থিক স্থিতিশীলতা বলতে ব্যাংক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকেই বোঝায়। যার সঙ্গে সামগ্রিক ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পৃক্ত। আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই ব্যাংকের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। এখানে অসুস্থ কার্যক্রম বা বিচ্যুতির কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আর্থিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনেক গুরুত্ব বহন করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় দুটি বিষয়কে ব্যাংকের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে যথাযথ তারল্য ব্যবস্থাপনা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মূলধন বৃদ্ধি। এর মধ্যে তারল্য ব্যবস্থাপনা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকে ঋণ বিতরণ ও আমানতের ভারসাম্য (ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও-সিডিআর) রাখা আবশ্যক। কিন্তু সম্প্রতি তা আশঙ্কাজনকভাবে প্রমিত মাত্রা থেকে নেমে যায়; যার কারণ অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংক ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত বর্তমান ৮৫ থেকে নামিয়ে ৮২ শতাংশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ঋণ বিতরণ ও আমানত গ্রহণে ব্যাংকগুলোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খল আচরণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
মূলধন কোনো ব্যাংক/কোম্পানির সম্পদ ও মালিকানার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করে। মূলধনের উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকের ফান্ডের উৎস এবং ক্ষতি ধারণ (Absorb) করার কুশন। ব্যাংকে যে কোনো সময় তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। তা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে এবং আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় মূলধনের ভিত্তি বাড়ানো একান্ত আবশ্যক। দেশের ব্যাংক খাত ব্যাংকিংয়ে আন্তর্জাতিক মান সংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাসেল-২-এর মধ্যে আছে। এ ধাপে ২০১১ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বা ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের ১০ শতাংশ_ এ দুইয়ের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করার কথা। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা থাকতে হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোতে জানুয়ারি, ২০১০ থেকে ব্যাসেল-২ প্রচলন করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক এবং এর কার্যক্রম অতীতের যে কোনো সময় থেকে বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে। আমেরিকার ব্যাংক ব্যবস্থায় দেউলিয়াত্বের ফলে সম্প্রতি বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে সে বিবেচনায় ব্যাংকের কার্যক্রমে বৈশ্বিক রূপ আরও জোরালো হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি আর জি-৮-এর নীতি নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা জি-২০-এর মধ্যে চলে গেছে। জি-২০-ভুক্ত অর্থনীতির দেশগুলোর নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মূলধন কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় এখন থেকে মূলধন সংরক্ষণের হার ১২-১৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা উঠেছে। যাতে ব্যাসেল-৩-এর দিকে ব্যাংক খাত দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
পরিচালন মুনাফা বলতে কোনো ব্যাংক/কোম্পানি/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের পার্থক্যকে বোঝায়। পত্রিকার তথ্যানুযায়ী দৃশ্যত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা সন্তোষজনক। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক ব্যবসা ভালো হবে। তবে বড় অঙ্কের এ পরিচালন মুনাফার মধ্যে বড় ধরনের হিসাবের ফাঁক বা 'উইন্ডো ড্রেসিং' থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কারও কারও সন্দেহ আছে। যদি তা-ই হয় তবে বিষয়টি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা প্রতারণার শামিল এবং এ দুষ্টচক্র থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। ব্যাংকিং এথিক্সের সঙ্গে বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
পরিচালনা মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। নিট মুনাফা নির্ধারিত হয় পরিচালনা মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) এবং করপোরেট কর (৪২.৫ শতাংশ) বাদ দেওয়ার পর। এর ওপর অনেক ব্যাংক সাধারণ রিজার্ভ খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখে। পরিচালন মুনাফার মধ্যে যদি ফাঁক বা 'উইন্ডো ড্রেসিং' থাকে তাহলে তো সব ক্ষেত্রেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এবং ব্যাংক ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এ ধরনের প্রভিশন এবং মূলধন সংরক্ষণ দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকের ঝুঁকি রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মুনাফা হলো ব্যাংক ব্যবসার সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি। এখানে আপসের কোনো অবকাশ নেই। প্রফিট করুন, কীভাবে করবেন, জানি না_ এ ধরনের অসুস্থ মানসিকতা থেকে বোর্ড/ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বের হয়ে আসতে হবে। রিস্ক মিটিগেট করার জন্যই মুনাফা থেকে প্রভিশন, মূলধন এবং বিভিন্ন ধরনের রিজার্ভ রাখা হয়। প্রকৃত মুনাফা বৃদ্ধি পেলে সিএসআর কার্যক্রমও বাড়ানো সম্ভব হবে।
ব্যাংকের আয়ের খাত বহুমুখী হলেও তা বহুলাংশে ধ্রুপদী ব্যাংকিং অর্থাৎ আমানত ও অগ্রিমকেন্দ্রিক। জি-২০-ভুক্ত অর্থনীতির দেশগুলো ঋণের পরিমাণ এবং গুণগত মানের সঙ্গে লিভারেজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। লিভারেজ হলো ডেট-ইকুইটি রেশিও। গুণগত মান বিবেচনায় আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের লিভারেজ অতিমাত্রায় বেশি। ফলে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণও বেশি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের শর্ত ভঙ্গ করে ক্রমাগত ঋণ বিতরণে, নিয়মিতভাবে অন্য ব্যাংকের কুঋণ ক্রয় করা ও বিএমআরই'র নামে ঋণ বৃদ্ধি করা, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও অবলোপন এবং ঋণের সুদ মওকুফ, সঠিকভাবে শ্রেণীকরণ না করা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সরকারি ব্যাংককে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের বিজ্ঞ বোর্ডের কোনো দৃঢ় প্রতিক্রিয়া নেই। বোর্ড, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে তথ্য দিতে হবে। হিসাবায়নের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত যে তথ্য ও উপাত্তের ওপর ব্যাংকের স্ট্রেংথ মূল্যায়িত হচ্ছে, তার যথার্থতা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যাচাই করতে হবে। বাণিজ্যিক নিরীক্ষা, বহিঃনিরীক্ষা (সিএ ফার্ম) কর্তৃক যাচাই করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততা প্রয়োগ করতে হবে। হিসাবায়নের ক্ষেত্রে মুনাফা প্রদর্শনে স্বচ্ছতা না থাকলে এর অভিঘাত সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালকে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য সংস্কারের বছর ঘোষণা করেছে। বিগত চলি্লশ বছরে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে ধারাবাহিকভাবে সংস্কার চলছে। এখন বোধহয় মূল্যায়নের সময় এসেছে; যা থেকে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। সংস্কারের প্রতিটি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই ব্যাংক খাতে সঠিক মুনাফা প্রদর্শনপূর্বক আমাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।
বাবুল চৌধুরী : ব্যাংকার
No comments