বলবেন না, টেনে যাও...-নাগরিক নিরাপত্তা by মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী
গত ১৬ আগস্ট এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান সম্পাদক মিশুক মুনীরের দাফন শেষে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশ নিয়ে দেশের রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা করেন মিশুকের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী। তিনি রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা বলেন যে মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। এমন মিথ্যা কথা আর বলবেন না।
রাজনীতি আপনাদের ব্যবসা। নিজেদের স্বার্থেই আপনারা রাজনীতি করেন' (দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৭, ২০১১)। মঞ্জুলী কাজীর মতো মানববন্ধনে উপস্থিত আরও অনেকেই নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বর্তমান যুগের বিকল্প মিডিয়া 'বল্গগ' ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'ফেসবুক' ব্যবহারকারী এবং দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণে সংবাদের বিপরীতে পাঠকের প্রতিক্রিয়াও একই রকম। মানুষ ক্ষুব্ধ, সরকারের ওপর বিতশ্রদ্ধ, রাজনীতিকদের ওপর আস্থাহীন, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে ভীত, হতাশ এবং আতঙ্কিত। ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পায়ে হেঁটে চললেও কেউ আমার ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেবে, ছিনতাইকারী-ডাকাত সন্দেহে পিটুনি দিয়ে হত্যা করবে, পুলিশ ধরে নিয়ে সন্ত্রাসী বানাবে, চাপাতি দিয়ে পুলিশ নিজেই কোপাবে কিংবা গণপিটুনির উদ্দেশ্যে জনগণের হাতে তুলে দেবে, র্যাব ক্রসফায়ারে ফেলে হত্যা করবে এবং এর কোনো বিচার তো হবেই না উপরন্তু বিচার চাইতেও পারব না। দেশের মানুষ অসহায়, আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ। সঙ্গত কারণেই মানুষের মনের কথা রাজনীতিকরা শুনতে পান না। কারণ মানুষের জন্য রাজনীতি না করলে মানুষের কথা তারা শুনবেন কীভাবে?
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতদিন পর মঞ্জুলী মুনীরসহ অন্যরা প্রকাশ্যে এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছেন কীভাবে? উত্তর একটাই, নিজের ওপর পড়েছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা আত্মীয় কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুঝতে পারলেও ঠিক অনুভব করতে পারেন না, যতক্ষণ না নিজের ওপর পড়ে। আমরা এতদিন ধরে এটাই করে আসছি। নিজের গায়ে আঘাত না আসা পর্যন্ত আমরা চুপ থাকি, থেকেছি। বড়জোর কিছুক্ষণ মন খারাপ করে দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলে আবার নিজের কাজে মন দেই। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আজ প্রায় আঠারো বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কিন্তু কই? তার আন্দোলনে কি আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কোনোকালে ছিল? ছিল না, কারণ ইলিয়াস কাঞ্চন আপনজন হারিয়ে নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব বুঝেছিলেন, আমরা বুঝিনি। এমনিভাবে যার যায় সে বুঝে, অন্যরা বুঝে না। কিন্তু এই না বোঝাটা আমার জন্যও যে কাল হতে পারে সে কথা কি আমাদের মনে আসে? বেশ কিছুদিন আগে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন পুলিশের ১১ জন। সাম্পতিক সময়ে মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ঝরে গেল ৪২টি তাজা প্রাণ। এবারে দেশের দুই রত্ন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ নিহত হলেন পাঁচজন। এত কিছু হারানোর পর আমরা এখন মুখ খোলেছি। কারণ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন ফোরামে সবাই মোটামুটি একই কথা বলেন। মানুষ নিরাপত্তাহীন, জীবন অনিশ্চিত, কারও ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না, সরকার কোনো দায়িত্ব পালন করছে না ইত্যাদি। কিন্তু বলতে গেলে আমরা কেউই নিজের দায়িত্বটা পালন করছি না। আমরাই যানবাহনে উঠে ড্রাইভারকে বলি, 'আরে ড্রাইভার জোরে চালাও' কিংবা ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি চালালে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে মনে মনে বলি, 'ড্রাইভারটা ভালো আছে, টেনে চলে এসেছে।' অথচ এই আমরাই আবার সমালোচনা করছি। এমনকি অন্যায়ের প্রতিবাদটা পর্যন্ত করি না, যতক্ষণ না অন্যায়টা আমার নিজের সঙ্গে হচ্ছে। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রকে কেউ না কেউ পরিচালনা করতে হয়, জনগণের দেখাশোনার জন্য কেউ থাকতে হয়। মানুষ যদি নিজের থেকেই শৃঙ্খলা মেনে চলত তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দরকার ছিল না, আইন প্রণয়নের দরকার ছিল না, প্রশাসনেরও দরকার ছিল না। এসব কারণেই সচেতন নাগরিকের সহযোগিতায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার যখন এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না, তখন আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে এবং তা করতে হবে সব হারানোর আগেই।
আমরা আর কোনো অঙ্গীকার চাই না, আর কোনো শোক বাণী চাই না, সমবেদনা চাই না। আমরা চাই সরকারের কাজের মাধ্যমে মানুষের জানমাল নিরাপদ থাকুক, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হোক। ফাঁকা বুলি আর বিগত সরকারের সমালোচনা আমরা অনেক শুনেছি, আর শুনতে চাই না। কে কখন কী করেছিল সেটা দেশের সবাই জানে। দয়া করে একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কী করেছেন?
অনেক কথা হয়েছে, হচ্ছে। দেশের সমস্যা ও সমাধান আমরা জানি, সবাই জানেন। এবার দয়া করে সমস্যা সমূহের সমাধানটা করুন। আর এই সমাধানটা সরকারকেই করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আর কোনো প্রাণহানি দেখতে চাই না। জীবন বলিদান কিংবা স্বজন হারানোর আগেই আমরা জোর দাবি জানাই, সব অনাচার বন্ধ হোক। এসব আর চলতে দেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার, এখনই। নিজের গায়ে পড়ার আগেই আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সব অনাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মতো ব্যক্তিদের অকালে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে এই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।
ড. মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী :পোস্ট ডক্টোরাল রিচার্সার, কিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কোরিয়া
rabbani_che@yahoo.com
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতদিন পর মঞ্জুলী মুনীরসহ অন্যরা প্রকাশ্যে এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছেন কীভাবে? উত্তর একটাই, নিজের ওপর পড়েছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা আত্মীয় কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুঝতে পারলেও ঠিক অনুভব করতে পারেন না, যতক্ষণ না নিজের ওপর পড়ে। আমরা এতদিন ধরে এটাই করে আসছি। নিজের গায়ে আঘাত না আসা পর্যন্ত আমরা চুপ থাকি, থেকেছি। বড়জোর কিছুক্ষণ মন খারাপ করে দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলে আবার নিজের কাজে মন দেই। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আজ প্রায় আঠারো বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কিন্তু কই? তার আন্দোলনে কি আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কোনোকালে ছিল? ছিল না, কারণ ইলিয়াস কাঞ্চন আপনজন হারিয়ে নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব বুঝেছিলেন, আমরা বুঝিনি। এমনিভাবে যার যায় সে বুঝে, অন্যরা বুঝে না। কিন্তু এই না বোঝাটা আমার জন্যও যে কাল হতে পারে সে কথা কি আমাদের মনে আসে? বেশ কিছুদিন আগে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন পুলিশের ১১ জন। সাম্পতিক সময়ে মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ঝরে গেল ৪২টি তাজা প্রাণ। এবারে দেশের দুই রত্ন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ নিহত হলেন পাঁচজন। এত কিছু হারানোর পর আমরা এখন মুখ খোলেছি। কারণ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন ফোরামে সবাই মোটামুটি একই কথা বলেন। মানুষ নিরাপত্তাহীন, জীবন অনিশ্চিত, কারও ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না, সরকার কোনো দায়িত্ব পালন করছে না ইত্যাদি। কিন্তু বলতে গেলে আমরা কেউই নিজের দায়িত্বটা পালন করছি না। আমরাই যানবাহনে উঠে ড্রাইভারকে বলি, 'আরে ড্রাইভার জোরে চালাও' কিংবা ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি চালালে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে মনে মনে বলি, 'ড্রাইভারটা ভালো আছে, টেনে চলে এসেছে।' অথচ এই আমরাই আবার সমালোচনা করছি। এমনকি অন্যায়ের প্রতিবাদটা পর্যন্ত করি না, যতক্ষণ না অন্যায়টা আমার নিজের সঙ্গে হচ্ছে। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রকে কেউ না কেউ পরিচালনা করতে হয়, জনগণের দেখাশোনার জন্য কেউ থাকতে হয়। মানুষ যদি নিজের থেকেই শৃঙ্খলা মেনে চলত তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দরকার ছিল না, আইন প্রণয়নের দরকার ছিল না, প্রশাসনেরও দরকার ছিল না। এসব কারণেই সচেতন নাগরিকের সহযোগিতায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার যখন এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না, তখন আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে এবং তা করতে হবে সব হারানোর আগেই।
আমরা আর কোনো অঙ্গীকার চাই না, আর কোনো শোক বাণী চাই না, সমবেদনা চাই না। আমরা চাই সরকারের কাজের মাধ্যমে মানুষের জানমাল নিরাপদ থাকুক, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হোক। ফাঁকা বুলি আর বিগত সরকারের সমালোচনা আমরা অনেক শুনেছি, আর শুনতে চাই না। কে কখন কী করেছিল সেটা দেশের সবাই জানে। দয়া করে একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কী করেছেন?
অনেক কথা হয়েছে, হচ্ছে। দেশের সমস্যা ও সমাধান আমরা জানি, সবাই জানেন। এবার দয়া করে সমস্যা সমূহের সমাধানটা করুন। আর এই সমাধানটা সরকারকেই করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আর কোনো প্রাণহানি দেখতে চাই না। জীবন বলিদান কিংবা স্বজন হারানোর আগেই আমরা জোর দাবি জানাই, সব অনাচার বন্ধ হোক। এসব আর চলতে দেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার, এখনই। নিজের গায়ে পড়ার আগেই আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সব অনাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মতো ব্যক্তিদের অকালে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে এই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।
ড. মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী :পোস্ট ডক্টোরাল রিচার্সার, কিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কোরিয়া
rabbani_che@yahoo.com
No comments