উদার সঞ্চরণশীল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন by আনোয়ারুল আজিম আরিফ

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ তার ছাত্রছাত্রীরা। দলমত-নির্বিশেষে জ্ঞান আহরণ করার জন্য আসা ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে মুখর থাকবে ক্যাম্পাস_এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এর ছন্দঃপতন রোধে এগিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের সবার। সম্মানিত শিক্ষকরা নিয়মিত পাঠদান করবেন, পরীক্ষাসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করবেন, নিজের গবেষণার বাইরেও ছাত্রছাত্রীদের গবেষণাকর্ম তত্ত্বাবধান করবেন_এটাই তো স্বাভাবিক।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা সামাজিক স্তর থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী সময়ে একজন প্রকৃত জীবনযোদ্ধারূপে গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষকদেরই। আমরা জানি, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকসমাজ এ ব্যাপারে সচেতন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের ৩৫টি বিভাগ ও চারটি ইনস্টিটিউটে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ১৯ হাজার ৫৬৮ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। এর মধ্যে ১৪ হাজার ২৬৬ জন ছাত্র এবং পাঁচ হাজার ৩০২ জন ছাত্রী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে এক হাজার ৯৫ জন গবেষক তালিকাভুক্ত আছেন। এর মধ্যে এমফিল প্রোগ্রামে ৮১৯ জন এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে ২৭৬ জন অধ্যয়নরত। এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক অধ্যয়নরত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বৃত্তির অধীনে ২০ জন শিক্ষক এবং বহিরাগত ১৫ জন গবেষক অধ্যয়ন করছেন। এ বছর ১৯ জন গবেষক পিএইচডি এবং ২১ জন গবেষক এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চিকিৎসা অনুষদের আওতায় ৫৩ জন ডক্টর অব মেডিসিন, মাস্টার্স অব সার্জারি, মাস্টার্স অব ফিলোসফি ও মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এ বছর এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই হাজার সাতজন শিক্ষার্থী মাস্টার ডিগ্রি, এক হাজার ৯২৮ জন স্নাতক সম্মান ডিগ্রি এবং ৩০৪ জন এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র হলো গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের সেবাদানের উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারকে আধুনিকভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। বর্তমানে এটি একটি সমৃদ্ধ ও অত্যাধুনিক গ্রন্থাগার, যার সংগ্রহসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন গ্রন্থাগারের সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি এবং এর আধুনিকায়নের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ও সচেষ্ট। এ লক্ষ্যে গ্রন্থাগারে এরই মধ্যে ১৪টি কম্পিউটার ও একটি সার্ভার স্থাপন করা হয়েছে। গ্রন্থাগারের সব পাঠসামগ্রী বর্তমানে কম্পিউটারে এন্ট্রি করা হচ্ছে। গ্রন্থাগারে পাঠকের চাহিদার ওপর গুরুত্বারোপ করে On Line Based Library Management Software চালু করা হয়েছে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে সহজে তাদের প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক ও জার্নাল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাবেন। এ ছাড়া ইন্টারনেট সার্চ এবং সিডিরম সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। ২০১০-১১ আর্থিক সালে বই কেনার জন্য বরাদ্দ ২০ লাখ টাকা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কমিটির মাধ্যমে বিভাগগুলোতে বণ্টন করা হয়েছে। ফলে বিভাগীয় সভাপতি ও ইনস্টিউিটটের পরিচালকরা নিজ নিজ ক্রয় কমিটির মাধ্যমে সহজে তাঁদের প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক কিনতে পারবেন। জার্নালের জন্য বরাদ্দ টাকা দিয়ে On Line Journal সার্ভিসের আওতায় INASP-PERI PROGRAM-এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ Publishers-এর জার্নাল-সেবা পাওয়া যাচ্ছে, যার মধ্যে Springer, Cambridge University Press, University of Chicago Press, Mary Ann Libert, Royal Society, Wiley-Black-well, Oxford University Press, Annual Reviews, American Chemical Society, American Physical Society, EBSCO, IEEE উল্লেখযোগ্য। অদূর-ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ গ্রন্থাগারটি আধুনিকায়নের (Automation) জন্য একটি প্রকল্প ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে (HEQEP) পাঠানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়নাধীন উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (ঐঊছঊচ) আওতায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগে বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। ওই ছয়টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ৮৫৩ দশমিক ৯২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পগুলোর বিপরীতে ২০১০-১১ আর্থিক সালের জন্য মোট ৩৮৪ দশমিক ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। আগামী আর্থিক সালের জন্য মোট ৩৬২ দশমিক ৭৮ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আশা করি, উলি্লখিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের উচ্চতর গবেষণাকাজের সুবিধা আরো বাড়বে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম আরো উন্নত হবে।
উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষসাধন এবং উচ্চশিক্ষায় সর্বাধুনিক ধ্যানধারণা লাভের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমেরিকার Middle Tennessee State University, জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের Graduate School of Agricultural and Life Sciences, ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং EU Consortium for Erasmus Mundus Programme-এর আওতায় পাকিস্তানের করাচির Institute of Business Management-এর সঙ্গে MOU স্বাক্ষরিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন হল ও জাদুঘর কর্তৃক প্রতিবছর নিয়মিত বৃক্ষ রোপণ করা হয়। বৃক্ষরোপণের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার ২০১০-এর দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেছে। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটকে জাতীয় পরিবেশ পদক ২০১১ প্রদান করা হয়েছে।
আমি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর আওতায় গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ উপস্থাপন করছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে ১৮টি অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে পঞ্চম একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণকাজ (জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবন) সমাপ্তির পথে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা এবং রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরি ভবন (বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আমদানিসহ) নির্মাণের কাজ চলছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা সুবিধা উন্নয়নকল্পে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয় শীর্ষক অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের জন্য এক কোটি ৭০ লাখ টাকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। আগামী বছরও এ খাতে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাবে। সম্মানিত শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করে অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের মধ্যেও বিদেশে সেমিনারে যোগদান, গবেষণা সহায়তা, অভ্যন্তরীণ সেমিনার-কনফারেন্স অনুষ্ঠান ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাসংক্রান্ত সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফিল্ড ওয়ার্ক ও শিক্ষা সফর, কো-কারিকুলার কার্যক্রম, ছাত্র-সহায়ক তহবিল, অনুষ্ঠান-উৎসব ইত্যাদি খাতে গত অর্থবছরের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সামুদ্রিক বিজ্ঞান ও ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের জন্য একটি একাডেমিক ভবন, সিনেট ভবন, চারুকলা ইনস্টিটিউটের জন্য একটি একাডেমিক ভবন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের জন্য দ্বিতীয় একাডেমিক ভবন, মাস্টারদা সূর্য সেন হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ, পরিবহন কমপ্লেক্স, ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদানের জন্য স্ট্রং ব্যাকবোন-সমৃদ্ধ অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল্ স্থাপন, শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্সে অধ্যয়ন, সেমিনার ও ওয়ার্কশপে যোগদানের জন্য অর্থ মঞ্জুর, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ২২টি বাস, দুটি মাইক্রোবাস, বিভিন্ন অনুষদ ও হলের আসবাব, বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের জন্য বই ও সাময়িকী সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দুটি প্রকল্প প্রস্তাব বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সবার। এর ভালোমন্দ সব কিছুর সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেশনজটমুক্ত একটি উদার সঞ্চরণশীল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্রতী হওয়ার সংগ্রামে সবাইকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহবান জানাই।
লেখক : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
vccu66@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.