চালচিত্র-হুগো শাভেজের লাল শার্ট বদল ও মধ্যবিত্তের চিত্তজয় by শুভ রহমান
শুধু ক্ষমতা নিশ্চিত করলেই হবে না, পাল্টাতে হবে গোটা সমাজটাকেই। পচে-গলে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা ও প্রতারণার এই সমাজ থেকে। এটা মধ্যবিত্ত সমাজ। সরকার, বিরোধী দল_সবই মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। শুধু সরকার বদলেই সমাজ পাল্টাবে না। এই বর্তমানের রাজনৈতিক মেরুকরণ, এই অন্ধভাবে ছোট সব দলকে, মায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো শুদ্ধ সবাইকে নিয়ে জোট বাঁধার সনাতনী কার্যক্রম সমাজ পাল্টানোর নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
এ দিয়ে কিছুতেই পাল্টাবে না আইনশৃঙ্খলার চেহারা, পাল্টাবে না দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুর্ভোগ, পাল্টাবে না নিত্য সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল, নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো চরম মানবিক অবমাননা ও শতসহস্র নৈতিক অবক্ষয়। মূলত এগুলোতেই প্রতিদিনের কাগজ ভরে থাকে। তারা বলে দেয়_এই হচ্ছে সমাজের চেহারা। সংবেদনশীল মানুষকে তা তাড়া করে ফেরে। এ দুর্গন্ধময় সমাজটাকে পাল্টাতে হবে। সে কাজটিই হচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত, সবাই_সরকার, বিরোধী দল, চুনোপুঁটি রাজনীতিক, ক্ষমতাধর, শুধু ক্ষমতা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, ক্ষমতা নিশ্চিত করতেই তাদের যত মাথাব্যথা, এতটুকুও চিন্তা নেই সমাজটাকে পাল্টানোর; একটা নিষ্কলুষ, মানুষের বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সুখে, আনন্দে বাঁচার মতো একটি সমাজ গড়ার কোনোই মাথাব্যথা নেই কারো।
আগস্টের এই মহাশোকাবহ মাসে আরো বেশি করে বেদনাদগ্ধ হতে থাকি, জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যার মতো সুপরিকল্পিত ও ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের আত্মস্বীকৃত সব খুনির শাস্তি প্রদান এখনো সম্পূর্ণ হচ্ছে না দেখে। হয়তো সরকারের তরফে চেষ্টার ত্রুটি হচ্ছে না; কিন্তু তার পরও বিলম্ব মানুষকে নিশ্চিত হতে দিচ্ছে না। মানুষ দেখছে, ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই যেন ক্ষমতাসীনদের বেশি মাথাব্যথা। ঠিক তেমনি যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারেও যেন অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বই ঘটে যাচ্ছে, মানুষ দেখছে, তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা যেন ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই। তেমনি প্রায় সব কয়টি ক্ষেত্রেই শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বই ঘটে চলেছে। জিনিসপত্রের দাম কিছুতেই আর সম্পূর্ণ স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক করা গেল না। কিছুতেই রোধ করা গেল না নিত্য আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ওপর অহেতুক ডাকাত বলে দোষারোপ করে পুলিশের অকথ্য নির্যাতন, তাকে গুরুতর জখম করার মতো নিষ্ঠুরতার ঘটনাই এক টানে যেন এই মেকি সমাজের মুখোশটা খুলে দিয়েছে, মানুষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের জন্য কেউ চেষ্টা করছে, বরং মানুষ দেখছে, সর্বক্ষণ ক্ষমতা নিশ্চিত করারই জোর তৎপরতা চলছে। একইভাবে শিক্ষকের মতো সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাকর কারো পক্ষে অকল্পনীয়ভাবে ছাত্রী ধর্ষণের কদর্য ঘটনাই এক টানে এ সমাজের বিবেকবর্জিত নিপীড়ক চেহারাটাই খুলে ধরছে এবং এর পরিবর্তনে কেউ সচেষ্ট রয়েছে, এমন কথা বিশ্বাসের অযোগ্যই মনে করতে বাধ্য করছে। আবার মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ফুলের মতো ৪০ কিশোরের করুণ মৃত্যুও কিছুতেই মানুষকে আর বিশ্বাসই করাতে পারছে না, কখনো এই সমাজটাকে সড়ক দুর্ঘটনায় করুণ মৃত্যু ঘটানোর হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে মুক্ত করা যাবে, এ সমাজের সব সড়ক হবে চিরকালের মতো নিরাপদ এবং নিশ্চিন্তে মানুষ সর্বত্র চলাচল করার স্থায়ী ভরসা ফিরে পাবে। তার চেয়ে মানুষ দেখছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা যেন তেমন একটা স্পর্শই করতে পারছে না ক্ষমতাধরদের, বরং তারা অনেক বেশি সময় দিতে ব্যস্ত থাকছে ক্ষমতা নিশ্চিত করতেই।
এই ক্ষমতাব্যস্ততা, এই ক্ষমতান্ধতা, এই ক্ষমতার জন্য এক উন্মাদনাই বস্তুত এ সমাজের পরিবর্তনকে বিঘি্নত ও বাধাগ্রস্তই করে চলেছে।
পাশের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দিকে তাকালেই দেখব, ৩৫ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সেখানকার সমাজ পাল্টাতে পারেনি। আর তার ফলেই আজ পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য শাখার সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় বসেছে এবং প্রথম মুহূর্ত থেকেই সমাজবদলের কাজটা শুরু করে দিয়েছে। কত দূর সফল হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে চমকে দেওয়ার মতো কিছু ঘটনা তো সেখানকার হতাশ, ক্ষুব্ধ মানুষ, বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত মানুষের মনে একটা বড় রকম আশারই সঞ্চার করেছে। তার মধ্যে বড় রকম আশাব্যঞ্জক ঘটনা হচ্ছে, বিরোধী সিপিএমের প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা জ্যোতি বসুর জন্মবার্ষিকী একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে বিধানসভাতেই পালন করা। এত বড় আশ্চর্যজনক, তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত তো পৃথিবীর কোথাও কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ রাখতে পারেনি। এখানে তো আমরা এ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই বিরোধী নেতার প্রতি ক্ষমতাসীনদের সে রকম গণতান্ত্রিক ঔদার্য ও রূপময় এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিচয়ই পাইনি। সমাজটা বদল তো হাওয়া থেকে হবে না। যে চিন্তা-চেতনা, যে কালচার এমন সমাজ পরিবর্তনের আশ্বাসবহ ঘটনা ঘটাতে পারে, তার দেখা তো আমরা আজও পেলাম না। শুধু জীবনভর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধী নেতা-কর্মীদের চরম অশ্রাব্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত কটু বাদানুবাদ শুনে গেলাম। দুয়েক সময় ইফতারের দাওয়াত ধরনের কূটনৈতিক চাল কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই কখনো দিয়ে ফেললেও একে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বলে ধরা যায় না। সমাজটা এমনি এমনি, হাওয়ার ওপর তো আর বদলাবে না! এখানে এক দল মধ্যবিত্তই আরেক দল মধ্যবিত্তকে দেখতে পারে না, তাদের জাতশত্রু মনে করে। এ এক অদ্ভুত সমাজ!
হুগো শাভেজের লাল শার্ট প্রসঙ্গ
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এদিকে কিউবায় গিয়ে ক্যান্সারকে জয় করে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে তাঁর ৫৭তম জন্মদিন পালনকালে এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি প্রায় সব সময় পরে-আসা (ট্রেড মার্ক) লাল শার্ট খুলে ফেলে হলুদ শার্ট গায়ে চড়িয়ে বলেছেন, লাল শার্টই পরতে হবে কেন! খুবই প্রতীকী ও তাৎপর্যময় কিছু কথা বলেছেন তিনি। তিনি উদারনীতি গ্রহণ করে মধ্যবিত্তের মন জয় করতে সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে চেয়েছেন। বিবিসির বরাত দিয়ে গত ৩১ জুলাই রবিবার কালের কণ্ঠের খবরে এ কথা বলা হয়েছে। লাতিন আমেরিকার এই নব্য মুক্তির দিশারীর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করা দরকার। কোনো রকম গোঁড়ামির তিনি পক্ষপাতী নন। ক্ষমতাসীন দলের একজন মেয়র একটি সড়কের নামকরণ 'সোশ্যালিস্ট এভিনিউ' রাখার কার্যক্রম গ্রহণ করলে তিনি ভর্ৎসনা করে একে মূর্খতা বলে অভিহিত করেন। উদারনীতিই যে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে হলে মধ্যবিত্তের মন জয় করা অপরিহার্য_তাঁর এ উপলব্ধি প্রণিধানযোগ্য। সিপিএমের শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের ইন্দিরা স্টেডিয়ামে হুগো শাভেজকে বিরাট সংবর্ধনা জানানো হলেও তাঁর চিন্তা-চেতনার খবর সিপিএম বোধকরি নেয়নি। লাতিন আমেরিকার মধ্যবিত্ত হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কিংবা আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত থেকে ভিন্ন, তবু সে সমাজের প্রেক্ষাপটে ও শাসক শ্রেণী আর প্রকৃত উৎপাদিকা শ্রেণীর মাঝখানে যাদের অবস্থান, তারাই মধ্যবিত্ত। এটাই ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব। সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে তাদের মন জয়ের চিন্তাটা তিনি সমাজ-রূপান্তরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণই মনে করেছেন। সিপিএম ৩৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও মধ্যবিত্তের মন জয় করতে পারেনি এবং ক্রমেই তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছে। একপর্যায়ে মধ্যবিত্ত সমাজ, বিশেষ করে, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা অর্থাৎ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি একেবারে ব্যাপকভাবে সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধেই চলে গেছে। সিপিএম, বিশেষ করে, শহুরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজের সমর্থন হারিয়েই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারিয়েছে।
এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বড় শক্তিই হচ্ছে মধ্যবিত্ত। কিন্তু ক্ষমতার আড়াই বছর তথা অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও মধ্যবিত্তের আস্থা অর্জন ও চিত্তজয়ের মতো জরুরি কার্যক্রমগুলো যেন মহাজোট সরকার উপেক্ষাই করে চলেছে। এর ফল ভালো হওয়ার নয়। সরকারে শুধু প্রধানমন্ত্রী আর দুই-চারজন সহমর্মী-সহযাত্রী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তেরও নানা দুর্ভোগ দূর করতে, অপমান, লাঞ্ছনা, দুর্বিপাকের মুহূর্তে পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান, তাতেই কিন্তু এ অধঃপতিত সমাজের রূপান্তর ঘটে যাবে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর হাতেগোনা সাথিদের নিয়ে যা করছেন, তা মহাজোট সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে মানুষ বিবেচনা করছে না। আর ব্যক্তি-উদ্যোগ হাজার মহৎ হলেও সমাজ-রূপান্তরের শক্তি হিসেবে তা ভূমিকা রাখতে পারবে না। অসৎ ব্যবসায়ীদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভর্ৎসনা করলে দু-একদিনের জন্য সিন্ডিকেট মুখ লুকাবে এবং দুয়েকটি পণ্যের দাম কমলে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্ভোগ দুয়েকদিন একটু লাঘব হতে পারে_কিন্তু মানুষের তিক্ততম অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ওতে কোনো সিস্টেম পাল্টানো যাবে না। সারমেয়-লেজের মতোই ক্ষণকাল পরেই তা আবার বাঁকা হয়ে যেতে বাধ্য। আজ পর্যন্ত সিন্ডিকেট গড়ার জন্য, অযৌক্তিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম ধাঁইধাঁই করে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, মানুষ দেখল কারোই তো গায়ে এতটুকু আঁচড় পর্যন্ত লাগল না। লাভ ও লোভের ক্রীতদাস অসৎ ব্যবসায়ীরা তাতে দমবে কেন! তারা আবার স্পর্ধিত উত্থান ঘটিয়ে দেখিয়ে দিল_তারাই শক্তিশালী, সরকার নয়। টিসিবির অকার্যকর হতদ্দশা নিত্য তাদের ফুসফুসে হাওয়া দিয়ে তাদের আয়ু দীর্ঘস্থায়ী ও নিশ্চিত করে চলেছে। সমাজ-রূপান্তরের প্রধান প্রতিবন্ধক তো এই রক্তপিপাসু অসাধু ও দুর্বৃত্তচক্রই। সমাজের দুর্বৃত্তায়ন, রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করবে কে? সেই গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনৈতিক শক্তি তো গড়ে তোলা হচ্ছে না! দরকার সেটারই। বিপুল সম্ভাবনার অধিকারী সমাজের সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও সৃজনশীলতার বিরাট আধার চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতার উৎস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক মধ্যবিত্তকে সেই শক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে, তাকে সর্বতোভাবে দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনামুক্ত করে বিকশিত করে তুলতে হবে। তাকে সমাজে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদাটুকু দিতে হবে। ইংরেজ আমলে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জমিদার-জোতদার ও ফড়িয়ার জন্ম হয়েছিল দীর্ঘ সমাজ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার রেনেসাঁস যুগের রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ মনীষী সমাজ-সংস্কারকের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় তার কিছু রূপান্তর ও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামল শেষ করে গণতান্ত্রিক শাসনামল সূচিত হওয়ার পর সমাজের এত বড় সম্ভাবনাময় ও ঐশ্বর্যময় শক্তির আজও প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা আজও ব্যাপকভাবেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ফলে সমাজ বদলে তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নেই। তারা শুধু 'অন লুকারে'র ভূমিকাতেই থাকছে। আর সমাজটা থাকছে বন্ধ্যা হয়ে। তার আমূল পরিবর্তন ঘটছে না। অথচ সেটাই সময়ের দাবি।
০২.৮.২০১১
আগস্টের এই মহাশোকাবহ মাসে আরো বেশি করে বেদনাদগ্ধ হতে থাকি, জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যার মতো সুপরিকল্পিত ও ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের আত্মস্বীকৃত সব খুনির শাস্তি প্রদান এখনো সম্পূর্ণ হচ্ছে না দেখে। হয়তো সরকারের তরফে চেষ্টার ত্রুটি হচ্ছে না; কিন্তু তার পরও বিলম্ব মানুষকে নিশ্চিত হতে দিচ্ছে না। মানুষ দেখছে, ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই যেন ক্ষমতাসীনদের বেশি মাথাব্যথা। ঠিক তেমনি যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারেও যেন অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বই ঘটে যাচ্ছে, মানুষ দেখছে, তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা যেন ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই। তেমনি প্রায় সব কয়টি ক্ষেত্রেই শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বই ঘটে চলেছে। জিনিসপত্রের দাম কিছুতেই আর সম্পূর্ণ স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক করা গেল না। কিছুতেই রোধ করা গেল না নিত্য আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ওপর অহেতুক ডাকাত বলে দোষারোপ করে পুলিশের অকথ্য নির্যাতন, তাকে গুরুতর জখম করার মতো নিষ্ঠুরতার ঘটনাই এক টানে যেন এই মেকি সমাজের মুখোশটা খুলে দিয়েছে, মানুষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের জন্য কেউ চেষ্টা করছে, বরং মানুষ দেখছে, সর্বক্ষণ ক্ষমতা নিশ্চিত করারই জোর তৎপরতা চলছে। একইভাবে শিক্ষকের মতো সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাকর কারো পক্ষে অকল্পনীয়ভাবে ছাত্রী ধর্ষণের কদর্য ঘটনাই এক টানে এ সমাজের বিবেকবর্জিত নিপীড়ক চেহারাটাই খুলে ধরছে এবং এর পরিবর্তনে কেউ সচেষ্ট রয়েছে, এমন কথা বিশ্বাসের অযোগ্যই মনে করতে বাধ্য করছে। আবার মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ফুলের মতো ৪০ কিশোরের করুণ মৃত্যুও কিছুতেই মানুষকে আর বিশ্বাসই করাতে পারছে না, কখনো এই সমাজটাকে সড়ক দুর্ঘটনায় করুণ মৃত্যু ঘটানোর হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে মুক্ত করা যাবে, এ সমাজের সব সড়ক হবে চিরকালের মতো নিরাপদ এবং নিশ্চিন্তে মানুষ সর্বত্র চলাচল করার স্থায়ী ভরসা ফিরে পাবে। তার চেয়ে মানুষ দেখছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা যেন তেমন একটা স্পর্শই করতে পারছে না ক্ষমতাধরদের, বরং তারা অনেক বেশি সময় দিতে ব্যস্ত থাকছে ক্ষমতা নিশ্চিত করতেই।
এই ক্ষমতাব্যস্ততা, এই ক্ষমতান্ধতা, এই ক্ষমতার জন্য এক উন্মাদনাই বস্তুত এ সমাজের পরিবর্তনকে বিঘি্নত ও বাধাগ্রস্তই করে চলেছে।
পাশের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দিকে তাকালেই দেখব, ৩৫ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সেখানকার সমাজ পাল্টাতে পারেনি। আর তার ফলেই আজ পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য শাখার সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় বসেছে এবং প্রথম মুহূর্ত থেকেই সমাজবদলের কাজটা শুরু করে দিয়েছে। কত দূর সফল হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে চমকে দেওয়ার মতো কিছু ঘটনা তো সেখানকার হতাশ, ক্ষুব্ধ মানুষ, বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত মানুষের মনে একটা বড় রকম আশারই সঞ্চার করেছে। তার মধ্যে বড় রকম আশাব্যঞ্জক ঘটনা হচ্ছে, বিরোধী সিপিএমের প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা জ্যোতি বসুর জন্মবার্ষিকী একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে বিধানসভাতেই পালন করা। এত বড় আশ্চর্যজনক, তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত তো পৃথিবীর কোথাও কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ রাখতে পারেনি। এখানে তো আমরা এ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই বিরোধী নেতার প্রতি ক্ষমতাসীনদের সে রকম গণতান্ত্রিক ঔদার্য ও রূপময় এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিচয়ই পাইনি। সমাজটা বদল তো হাওয়া থেকে হবে না। যে চিন্তা-চেতনা, যে কালচার এমন সমাজ পরিবর্তনের আশ্বাসবহ ঘটনা ঘটাতে পারে, তার দেখা তো আমরা আজও পেলাম না। শুধু জীবনভর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধী নেতা-কর্মীদের চরম অশ্রাব্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত কটু বাদানুবাদ শুনে গেলাম। দুয়েক সময় ইফতারের দাওয়াত ধরনের কূটনৈতিক চাল কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই কখনো দিয়ে ফেললেও একে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বলে ধরা যায় না। সমাজটা এমনি এমনি, হাওয়ার ওপর তো আর বদলাবে না! এখানে এক দল মধ্যবিত্তই আরেক দল মধ্যবিত্তকে দেখতে পারে না, তাদের জাতশত্রু মনে করে। এ এক অদ্ভুত সমাজ!
হুগো শাভেজের লাল শার্ট প্রসঙ্গ
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এদিকে কিউবায় গিয়ে ক্যান্সারকে জয় করে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে তাঁর ৫৭তম জন্মদিন পালনকালে এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি প্রায় সব সময় পরে-আসা (ট্রেড মার্ক) লাল শার্ট খুলে ফেলে হলুদ শার্ট গায়ে চড়িয়ে বলেছেন, লাল শার্টই পরতে হবে কেন! খুবই প্রতীকী ও তাৎপর্যময় কিছু কথা বলেছেন তিনি। তিনি উদারনীতি গ্রহণ করে মধ্যবিত্তের মন জয় করতে সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে চেয়েছেন। বিবিসির বরাত দিয়ে গত ৩১ জুলাই রবিবার কালের কণ্ঠের খবরে এ কথা বলা হয়েছে। লাতিন আমেরিকার এই নব্য মুক্তির দিশারীর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করা দরকার। কোনো রকম গোঁড়ামির তিনি পক্ষপাতী নন। ক্ষমতাসীন দলের একজন মেয়র একটি সড়কের নামকরণ 'সোশ্যালিস্ট এভিনিউ' রাখার কার্যক্রম গ্রহণ করলে তিনি ভর্ৎসনা করে একে মূর্খতা বলে অভিহিত করেন। উদারনীতিই যে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে হলে মধ্যবিত্তের মন জয় করা অপরিহার্য_তাঁর এ উপলব্ধি প্রণিধানযোগ্য। সিপিএমের শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের ইন্দিরা স্টেডিয়ামে হুগো শাভেজকে বিরাট সংবর্ধনা জানানো হলেও তাঁর চিন্তা-চেতনার খবর সিপিএম বোধকরি নেয়নি। লাতিন আমেরিকার মধ্যবিত্ত হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কিংবা আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত থেকে ভিন্ন, তবু সে সমাজের প্রেক্ষাপটে ও শাসক শ্রেণী আর প্রকৃত উৎপাদিকা শ্রেণীর মাঝখানে যাদের অবস্থান, তারাই মধ্যবিত্ত। এটাই ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব। সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প শুরু করতে তাদের মন জয়ের চিন্তাটা তিনি সমাজ-রূপান্তরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণই মনে করেছেন। সিপিএম ৩৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও মধ্যবিত্তের মন জয় করতে পারেনি এবং ক্রমেই তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছে। একপর্যায়ে মধ্যবিত্ত সমাজ, বিশেষ করে, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা অর্থাৎ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি একেবারে ব্যাপকভাবে সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধেই চলে গেছে। সিপিএম, বিশেষ করে, শহুরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজের সমর্থন হারিয়েই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারিয়েছে।
এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বড় শক্তিই হচ্ছে মধ্যবিত্ত। কিন্তু ক্ষমতার আড়াই বছর তথা অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও মধ্যবিত্তের আস্থা অর্জন ও চিত্তজয়ের মতো জরুরি কার্যক্রমগুলো যেন মহাজোট সরকার উপেক্ষাই করে চলেছে। এর ফল ভালো হওয়ার নয়। সরকারে শুধু প্রধানমন্ত্রী আর দুই-চারজন সহমর্মী-সহযাত্রী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তেরও নানা দুর্ভোগ দূর করতে, অপমান, লাঞ্ছনা, দুর্বিপাকের মুহূর্তে পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান, তাতেই কিন্তু এ অধঃপতিত সমাজের রূপান্তর ঘটে যাবে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর হাতেগোনা সাথিদের নিয়ে যা করছেন, তা মহাজোট সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে মানুষ বিবেচনা করছে না। আর ব্যক্তি-উদ্যোগ হাজার মহৎ হলেও সমাজ-রূপান্তরের শক্তি হিসেবে তা ভূমিকা রাখতে পারবে না। অসৎ ব্যবসায়ীদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভর্ৎসনা করলে দু-একদিনের জন্য সিন্ডিকেট মুখ লুকাবে এবং দুয়েকটি পণ্যের দাম কমলে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্ভোগ দুয়েকদিন একটু লাঘব হতে পারে_কিন্তু মানুষের তিক্ততম অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ওতে কোনো সিস্টেম পাল্টানো যাবে না। সারমেয়-লেজের মতোই ক্ষণকাল পরেই তা আবার বাঁকা হয়ে যেতে বাধ্য। আজ পর্যন্ত সিন্ডিকেট গড়ার জন্য, অযৌক্তিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম ধাঁইধাঁই করে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, মানুষ দেখল কারোই তো গায়ে এতটুকু আঁচড় পর্যন্ত লাগল না। লাভ ও লোভের ক্রীতদাস অসৎ ব্যবসায়ীরা তাতে দমবে কেন! তারা আবার স্পর্ধিত উত্থান ঘটিয়ে দেখিয়ে দিল_তারাই শক্তিশালী, সরকার নয়। টিসিবির অকার্যকর হতদ্দশা নিত্য তাদের ফুসফুসে হাওয়া দিয়ে তাদের আয়ু দীর্ঘস্থায়ী ও নিশ্চিত করে চলেছে। সমাজ-রূপান্তরের প্রধান প্রতিবন্ধক তো এই রক্তপিপাসু অসাধু ও দুর্বৃত্তচক্রই। সমাজের দুর্বৃত্তায়ন, রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করবে কে? সেই গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনৈতিক শক্তি তো গড়ে তোলা হচ্ছে না! দরকার সেটারই। বিপুল সম্ভাবনার অধিকারী সমাজের সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও সৃজনশীলতার বিরাট আধার চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতার উৎস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক মধ্যবিত্তকে সেই শক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে, তাকে সর্বতোভাবে দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনামুক্ত করে বিকশিত করে তুলতে হবে। তাকে সমাজে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদাটুকু দিতে হবে। ইংরেজ আমলে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জমিদার-জোতদার ও ফড়িয়ার জন্ম হয়েছিল দীর্ঘ সমাজ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার রেনেসাঁস যুগের রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ মনীষী সমাজ-সংস্কারকের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় তার কিছু রূপান্তর ও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামল শেষ করে গণতান্ত্রিক শাসনামল সূচিত হওয়ার পর সমাজের এত বড় সম্ভাবনাময় ও ঐশ্বর্যময় শক্তির আজও প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা আজও ব্যাপকভাবেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ফলে সমাজ বদলে তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নেই। তারা শুধু 'অন লুকারে'র ভূমিকাতেই থাকছে। আর সমাজটা থাকছে বন্ধ্যা হয়ে। তার আমূল পরিবর্তন ঘটছে না। অথচ সেটাই সময়ের দাবি।
০২.৮.২০১১
No comments