কালান্তরের কড়চা-কাচের ঘরে বাস করে অন্যের ঘরে ঢিল মারতে নেই by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
মনস্তাত্তি্বকরা বলেন, কোনো মানুষ যখন চরম হীনম্মন্যতায় (inferiority complex) ভোগে, তখন তার মধ্যে শ্রেয়ম্মন্যতার (superiority complex) লক্ষণ দেখা দেয় এবং তার সম্পর্কে অন্য লোকে যে যা-ই ভাবুক, নিজেকে সে সুপারহিরো ভাবতে শুরু করে এবং সে নকল বাহাদুর সেজে বসে।
যোগ্যতাহীন, মেধাহীন ব্যক্তিরা যখন সমাজে কদর পায় না, তার সমসাময়িক যোগ্য ব্যক্তিদের তুলনায় সম্মান ও কদর লাভ করে না, তখনই তাদের মধ্যে এই রোগ দেখা দেয়। আমি মনস্তাত্তি্বক নই; কিন্তু বিবিসি রেডিওর (লন্ডন) বাংলা বিভাগের সাবেক স্টাফ সিরাজুর রহমানের লেখা পড়ে, কথাবার্তা শুনে বহুকাল আগেই আমার মনে হয়েছে, তিনি এই হীনম্মন্যতা রোগে ভুগছেন। এখন সেই রোগটি বৃদ্ধ বয়সে প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সিরাজুর রহমানের সমসাময়িক অনেকেই দেশে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ইত্যাদি পরিচয়ে খ্যাত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু এসব পরিচয়ের কোনোটাই তিনি অর্জন করতে পারেননি এবং কোনো প্রতিষ্ঠা পাননি। তাঁর একমাত্র পরিচয় ও গুরুত্ব ছিল বিবিসি বেতারের চাকরির জন্য। সেই চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু যেমন লন্ডনে তেমনি ঢাকায়ও তাঁর কোনো কদর নেই। তিনি প্রায় বিস্মৃত একজন মানুষ। হালে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে আবোল-তাবোল লেখার দরুন দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মহলটিতে তাঁর কিছু কদর বেড়েছে।
তিনি একবার বিবিসির চাকরির কনট্রাক্ট শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরে গিয়ে দেখেন, তাঁর জন্য কোনো সংবাদপত্র, বেতার বা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো অফার নেই। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই বিভিন্ন পেশায় খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন; কিন্তু তাঁর কোনো খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা নেই। তাঁর একমাত্র পরিচয় 'বিবিসির ছেড়াজ'। বেশ কিছুকাল হতাশভাবে ঢাকায় ঘোরাফেরা করার পর অনেক ধরনা দেওয়ার শেষে লন্ডনে বিবিসি বেতারের পুরনো চাকরিটি আবার জোগাড় করেন।
কিন্তু এই চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি কী করবেন? সম্ভবত এ চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই বিবিসির পক্ষ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের নামে তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। হয়তো আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জিতে পাকিস্তানে ক্ষমতায় গেলে তাঁর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। তবে তাঁর এই ঘনিষ্ঠতা ছিল আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক গ্রুপের সঙ্গেই বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হলে বিবিসি যে এই সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখায় তাতে সিরাজুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ও বিবিসির নীতি। বিবিসির বাংলা বিভাগেও সেই নীতি অনুসৃত হয়েছে।
সেই সুবাদে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার নেতাদের সঙ্গে সিরাজুর রহমান পরিচিত হন। এই নেতারা কখনো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজুর রহমানের কাছে পরামর্শ বা উপদেশের জন্য যাননি। যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সিরাজুর রহমানের কোনো যোগাযোগও ছিল না। আমি তখন মুজিবনগরে। মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র জয়বাংলা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সিরাজুর রহমান তখন খোন্দকার মোশতাক বা তাঁর গ্রুপের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন কি না জানি না; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থেকে শুরু করে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী আর কোনো সদস্যের সঙ্গেই তাঁর কোনো ব্যক্তিগত বা পেশাগত যোগাযোগ ছিল না, তা জানি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অনুরোধে তিনি লুলু বিলকিস বানু, গাউস খান প্রমুখ এবং লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ছাত্রনেতাদের সহযোগিতায় প্রবাসে সংগঠিত মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সিরাজুর রহমান এই আন্দোলনের বহু পরে স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে তাঁর 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতে অশোভনভাবে দাবি করেছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। সিরাজুর রহমান তা জানতে পেরে টেলিফোনে তাঁকে এমন ধমক দেন যে, বিচারপতি নেতৃত্ব গ্রহণে আর গড়িমসি করেননি।
সিরাজুর রহমানের ভাগ্য ভালো, অকাল প্রয়াত বিচারপতি তাঁর এই লেখা পড়ার সুযোগ পাননি। তা না হলে এই 'কোথাকার কে সিরাজুর রহমান' সম্পর্কে তিনি কী ভাবতেন তা আমি জানি না। বিচারপতি চৌধুরী নিজেও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সংগঠিত আন্দোলন সম্পর্কে একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাতে সিরাজুর রহমানের নাম একবার বা দুবার আছে। তাও অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে চাকরি দিতে না পারায় তিনি কতটা হতাশ ও বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে 'প্রীতি নিন সকলে' বইতে জাতির জনক সম্পর্কেও তাঁর ধৃষ্টতামূলক মিথ্যাচারে। এই বইতে তিনি লিখেছেন, 'বঙ্গবন্ধু কোনো জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় মুখে মেকআপ নিতেন।' আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছয় দফা আন্দোলনের আগে পরে, বহু সময়ে সঙ্গী হয়েছি। তাঁকে কখনো মুখে মেকআপ নিতে দেখিনি। তিনি এতই সুপুরুষ ছিলেন যে তাঁর মেকআপ নেওয়ার কোনো দরকারই ছিল না। তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল বজ্রকণ্ঠ। এই কণ্ঠের নিনাদে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হতো। তিনি মুখে মেকআপ নেবেন কোন দুঃখে? তা ছাড়া একেক দিন তিনি এতগুলো সভায় যোগ দিতেন যে তাঁর মেকআপ নেওয়ার সময় হতো কখন_যেখানে তাঁর সময়মতো খাওয়াদাওয়ারও উপায় থাকত না।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সমালোচনা করার মতো কিছু ছিল না এমন দাবি আমি করি না। কেউ ইতিহাসনিষ্ঠা থেকে সত্যসন্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাঁর সমালোচনা করলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে জাতীয় নেতাদের চরিত্র হননে যদি কেউ জঘন্য মিথ্যাচার শুরু করে তাহলে তার বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ এই মিথ্যাচার জাতির ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায় এবং জাতির চরম ক্ষতি সাধন করে।
তবে আমার একটি ধারণা, সিরাজুর রহমান শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের (চাকরি না পাওয়া) জন্যই নয়, স্বাধীনতার আদর্শবিরোধীদের সঙ্গে তাঁর মনের মিল থাকায় সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের এই গ্রুপের সঙ্গে সম্ভবত তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। একটি ঘটনায় এই সন্দেহটি অনেকেই মনে পোষণ করেন।
১৯৭১ সালের গোড়ায় যখন মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত এবং ভারত এই যুদ্ধে মিত্রশক্তি হিসেবে জড়িত হতে বাধ্য হবে এটা প্রায় নিশ্চিত, তখন মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের ভেতরে বসে খোন্দকার মোশতাক তাঁর গ্রুপসহ এটি ষড়যন্ত্র পাকান। হঠাৎ প্রচারণা শুরু হয়, ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এখনই যুদ্ধ চালানো হলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে জেলে ফাঁসি দেবে, ফলে বঙ্গবন্ধুবিহীন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। খোন্দকার মোশতাক এই সময় মুজিবনগর থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন_নাম 'অভিযান'। এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরের ব্যানার হেডিং দেওয়া হয়_'বঙ্গবন্ধুর প্রাণরক্ষা, না স্বাধীনতা?'
তখন অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ এখন শেষ সন্ধিক্ষণে। ভারত তাতে যোগ দিলে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য। এই যুদ্ধ ঠেকানোর জন্যই মোশতাক গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে এই চাল চেলেছিল। তাদের পেছনে ছিল পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার বুদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই প্রচারণার জবাব দেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করেই আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা করতে পারি। আমরা যদি পাকিস্তানের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারি, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে তারা সাহসী হবে না। কিন্তু আমরা এই আঘাত হানতে ঢিলেমি করলে তারা এটাকে আমাদের দুর্বলতা ভেবে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করে ফেলবে।'
এই বিতর্কের সময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ধরে ফেলে, খোন্দকার মোশতাক ও তাঁর গ্রুপের সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ। মোশতাক তখন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রী পদ থেকে তাঁকে না সরিয়ে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিদেশ সফরের কথা ছিল; তাও বাতিল করা হয়।
ঠিক এই সময় লন্ডনে ঘটে আরো রহস্যজনক একটি ঘটনা। এই সময় লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে উচ্চ কূটনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তিনি হঠাৎ বিবিসি বেতারের বাংলা বিভাগে কর্মরত সিরাজুর রহমানের কাছ থেকে একটি রহস্যপূর্ণ টেলিফোন কল পান। সিরাজুর রহমান তাঁকে জানান, বুশ হাউসে (বিবিসি বেতারের অফিস) মি. ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর জরুরি সাক্ষাৎ প্রয়োজন। মি. ব্যানার্জি বুশ হাউসে ছুটে যান। তারপর কী হলো, মি. ব্যানার্জির স্মৃতিকথা 'India's security dilemmas : Pakistan and Bangladesh' শীর্ষক বই থেকে নিচে তা তুলে দিচ্ছি।
"He (Serajur Rahman) showed me a two page obituary of the Bangladesh leader, which he said the BBC world service was getting ready to broadcast within the next hour. He did not say a word more. The obituary papers with the logo on the top were handed over to me. There was no question of doubting the authenticity of the document. The meeting ended in the next few minutes followed by an exchange of usual courtesies. Grief-stricken but not without a certain amount of cynicism, I returned to my office almost running and wondering what was the real purpose of the meeting. What was the obituary notice trying to convey? Was it a plant to confuse India? Was Mujib really hanged by the Pakistanis, the news that BBC had come to know of before India did? It could not be that on such a matter of crucial importance for India, the BBC could have secured the information before India had done. Apa B Pant was the Indian High commissioner to whom I reported immidiately. An emergency meeting was called. Various channels of communication were activated and quick checks and counter checks followed. It was found out within minutes that Mujib was still alive and that the story was a deliberate plant to confuse India at an important stages on the war." (Indian security Dilemmas : Pakistan and Bangladesh." P 145-146).
মোদ্দাকথায় এর অর্থ হলো, 'সিরাজুর রহমান আমাকে বুশ হাউসে দুই পৃষ্ঠায় লেখা বাংলাদেশের নেতার মৃত্যুপরবর্তী জীবনালেখ্য দেখান এবং জানান, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস পরবর্তী ঘণ্টাতেই তা প্রচার করতে যাচ্ছে, যা আসলে হয়নি। ওই ওবিচুয়ারি প্রামাণ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কারণ ছিল না। শোকার্ত মনে, তবে কিছুটা সন্দেহসহ আমি প্রায় দৌড়ে অফিসে ফিরে আসি। ভাবতে থাকি, আমাকে ওবিচুয়ারির কাগজপত্র দেখানোর পেছনে সিরাজুর রহমানের উদ্দেশ্য কী? এটা কি ভারতকে হতবুদ্ধি করার চেষ্টা? সত্যই কি পাকিস্তানিরা মুজিবকে হত্যা করেছে? আর এই হত্যার খবর, যা ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা বিবিসি সর্বাগ্রে জেনে ফেলেছে? আপা বি পন্থ তখন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। তাঁকে অবিলম্বে বিষয়টি জানালাম। জরুরি মিটিং ডাকা হলো। সব রকম চ্যানেলে খবরটির সত্যাসত্য পরীক্ষা করা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে জানা গেল, মুজিব এখনো বেঁচে আছেন এবং তাঁর এই মৃত্যুসংবাদ যুদ্ধের এই চরম সন্ধিক্ষণে ভারতকে বিভ্রান্ত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রচার (ইন্ডিয়াস সিকিউরিটি ডাইলেমাস : পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬)।
ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি তাঁর বইতে এই ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করার বহু আগেই তা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও নেতাই জানতে পেরেছিলেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর কানে তাঁর মুক্তির পর তা পেঁৗছতে দেরি হয়নি। সিরাজুর রহমানকে বিদেশে একটি উচ্চপদ সৃষ্টি করে বসানোর প্রস্তাবের সময়ও বঙ্গবন্ধুকে এই ঘটনা পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তাঁকে চাকরিদানের প্রস্তাবটি তখন ধামাচাপা পড়ে। এরপর বঙ্গবন্ধু-বিদ্বেষে সিরাজুর রহমানের উন্মাদ হওয়ার এবং শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘাতক চক্র এবং তাদের সমর্থকদের দলের হয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারের আসল কারণের আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার আছে কি?
বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই তাঁর প্রতি অন্ধবিদ্বেষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্রতি সিরাজুর রহমান লন্ডনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এই বঙ্গবন্ধুবিরোধী এবং মোশতাকপন্থী চক্রটির নেতৃত্বে ছিলেন এ টি এম ওয়ালি আশরাফ নামে এক বাংলাদেশি সাংবাদিক। তিনি ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের প্রিয়পাত্র এবং খোন্দকার মোশতাক লন্ডনে এলে এই ওয়ালি আশরাফের বালহামের (Balham) বাসায় প্রায়ই উঠতেন। ওয়ালি আশরাফের মাধ্যমে সিরাজুর রহমান খোন্দকার মোশতাকেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।
সিরাজুর রহমান সম্পর্কে অধিক লিখে আমি তাঁর গুরুত্ব বাড়াতে চাই না। তিনি লিখেছেন, আমি লন্ডনে প্রথম এসে শফিক রেহমানের দ্বারা অনেকভাবে উপকৃত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে লিখেছি। শফিক রেহমান আমার বাল্যবন্ধু। আমার লেখায় তাঁর প্রতিভা ও মেধার কথা আমি উল্লেখ করেছি। পরবর্তীকালে তাঁর নীতিভ্রষ্টতা ও রাজনৈতিক অধঃপতনের সমালোচনা করেছি। লন্ডনে আসার পর আমার নানা সমস্যায় শফিক যেমন আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, আমিও তাঁর সমস্যা ও ক্রাইমিসে সাহায্য দিতে এগিয়ে গেছি। আমি লন্ডনে এসে তাঁদের কাছে আর্থিক বা বড় ধরনের কোনো সাহায্য নিইনি। চাইলে হয়তো শফিক বা তাঁর স্ত্রী তালেয়া দিতেন। আমার প্রয়োজন হয়নি।
অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে আমি ফকির হয়ে আসেনি। তখন আমি দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদন দিয়েছিল এবং ঢাকার ও লন্ডনের অনেক বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে প্রয়োজনে অর্থ সাহায্যও করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত তাসাদ্দুক আহমদ, এখনো জীবিত আছেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মতিন, এঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিবিসিতে চাকরি পাওয়ার জন্য সিরাজুর রহমানের কাছে আমাকে যেতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন বিবিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, তখনো সিরাজুর রহমান আমার প্রতি প্রীত ছিলেন না। সে কাহিনী আজ নয়, সময় ও সুযোগ হলে আরেক লেখায় বিস্তারিতভাবে লিখব। (সমাপ্ত)
লন্ডন : ১ আগস্ট সোমবার, ২০১১
সিরাজুর রহমানের সমসাময়িক অনেকেই দেশে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ইত্যাদি পরিচয়ে খ্যাত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু এসব পরিচয়ের কোনোটাই তিনি অর্জন করতে পারেননি এবং কোনো প্রতিষ্ঠা পাননি। তাঁর একমাত্র পরিচয় ও গুরুত্ব ছিল বিবিসি বেতারের চাকরির জন্য। সেই চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু যেমন লন্ডনে তেমনি ঢাকায়ও তাঁর কোনো কদর নেই। তিনি প্রায় বিস্মৃত একজন মানুষ। হালে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে আবোল-তাবোল লেখার দরুন দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মহলটিতে তাঁর কিছু কদর বেড়েছে।
তিনি একবার বিবিসির চাকরির কনট্রাক্ট শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরে গিয়ে দেখেন, তাঁর জন্য কোনো সংবাদপত্র, বেতার বা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো অফার নেই। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই বিভিন্ন পেশায় খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন; কিন্তু তাঁর কোনো খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা নেই। তাঁর একমাত্র পরিচয় 'বিবিসির ছেড়াজ'। বেশ কিছুকাল হতাশভাবে ঢাকায় ঘোরাফেরা করার পর অনেক ধরনা দেওয়ার শেষে লন্ডনে বিবিসি বেতারের পুরনো চাকরিটি আবার জোগাড় করেন।
কিন্তু এই চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি কী করবেন? সম্ভবত এ চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই বিবিসির পক্ষ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের নামে তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। হয়তো আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জিতে পাকিস্তানে ক্ষমতায় গেলে তাঁর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। তবে তাঁর এই ঘনিষ্ঠতা ছিল আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক গ্রুপের সঙ্গেই বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হলে বিবিসি যে এই সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখায় তাতে সিরাজুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ও বিবিসির নীতি। বিবিসির বাংলা বিভাগেও সেই নীতি অনুসৃত হয়েছে।
সেই সুবাদে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার নেতাদের সঙ্গে সিরাজুর রহমান পরিচিত হন। এই নেতারা কখনো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজুর রহমানের কাছে পরামর্শ বা উপদেশের জন্য যাননি। যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সিরাজুর রহমানের কোনো যোগাযোগও ছিল না। আমি তখন মুজিবনগরে। মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র জয়বাংলা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সিরাজুর রহমান তখন খোন্দকার মোশতাক বা তাঁর গ্রুপের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন কি না জানি না; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থেকে শুরু করে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী আর কোনো সদস্যের সঙ্গেই তাঁর কোনো ব্যক্তিগত বা পেশাগত যোগাযোগ ছিল না, তা জানি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অনুরোধে তিনি লুলু বিলকিস বানু, গাউস খান প্রমুখ এবং লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ছাত্রনেতাদের সহযোগিতায় প্রবাসে সংগঠিত মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সিরাজুর রহমান এই আন্দোলনের বহু পরে স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে তাঁর 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতে অশোভনভাবে দাবি করেছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। সিরাজুর রহমান তা জানতে পেরে টেলিফোনে তাঁকে এমন ধমক দেন যে, বিচারপতি নেতৃত্ব গ্রহণে আর গড়িমসি করেননি।
সিরাজুর রহমানের ভাগ্য ভালো, অকাল প্রয়াত বিচারপতি তাঁর এই লেখা পড়ার সুযোগ পাননি। তা না হলে এই 'কোথাকার কে সিরাজুর রহমান' সম্পর্কে তিনি কী ভাবতেন তা আমি জানি না। বিচারপতি চৌধুরী নিজেও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সংগঠিত আন্দোলন সম্পর্কে একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাতে সিরাজুর রহমানের নাম একবার বা দুবার আছে। তাও অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে চাকরি দিতে না পারায় তিনি কতটা হতাশ ও বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে 'প্রীতি নিন সকলে' বইতে জাতির জনক সম্পর্কেও তাঁর ধৃষ্টতামূলক মিথ্যাচারে। এই বইতে তিনি লিখেছেন, 'বঙ্গবন্ধু কোনো জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় মুখে মেকআপ নিতেন।' আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছয় দফা আন্দোলনের আগে পরে, বহু সময়ে সঙ্গী হয়েছি। তাঁকে কখনো মুখে মেকআপ নিতে দেখিনি। তিনি এতই সুপুরুষ ছিলেন যে তাঁর মেকআপ নেওয়ার কোনো দরকারই ছিল না। তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল বজ্রকণ্ঠ। এই কণ্ঠের নিনাদে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হতো। তিনি মুখে মেকআপ নেবেন কোন দুঃখে? তা ছাড়া একেক দিন তিনি এতগুলো সভায় যোগ দিতেন যে তাঁর মেকআপ নেওয়ার সময় হতো কখন_যেখানে তাঁর সময়মতো খাওয়াদাওয়ারও উপায় থাকত না।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সমালোচনা করার মতো কিছু ছিল না এমন দাবি আমি করি না। কেউ ইতিহাসনিষ্ঠা থেকে সত্যসন্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাঁর সমালোচনা করলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে জাতীয় নেতাদের চরিত্র হননে যদি কেউ জঘন্য মিথ্যাচার শুরু করে তাহলে তার বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ এই মিথ্যাচার জাতির ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায় এবং জাতির চরম ক্ষতি সাধন করে।
তবে আমার একটি ধারণা, সিরাজুর রহমান শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের (চাকরি না পাওয়া) জন্যই নয়, স্বাধীনতার আদর্শবিরোধীদের সঙ্গে তাঁর মনের মিল থাকায় সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের এই গ্রুপের সঙ্গে সম্ভবত তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। একটি ঘটনায় এই সন্দেহটি অনেকেই মনে পোষণ করেন।
১৯৭১ সালের গোড়ায় যখন মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত এবং ভারত এই যুদ্ধে মিত্রশক্তি হিসেবে জড়িত হতে বাধ্য হবে এটা প্রায় নিশ্চিত, তখন মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের ভেতরে বসে খোন্দকার মোশতাক তাঁর গ্রুপসহ এটি ষড়যন্ত্র পাকান। হঠাৎ প্রচারণা শুরু হয়, ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এখনই যুদ্ধ চালানো হলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে জেলে ফাঁসি দেবে, ফলে বঙ্গবন্ধুবিহীন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। খোন্দকার মোশতাক এই সময় মুজিবনগর থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন_নাম 'অভিযান'। এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরের ব্যানার হেডিং দেওয়া হয়_'বঙ্গবন্ধুর প্রাণরক্ষা, না স্বাধীনতা?'
তখন অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ এখন শেষ সন্ধিক্ষণে। ভারত তাতে যোগ দিলে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য। এই যুদ্ধ ঠেকানোর জন্যই মোশতাক গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে এই চাল চেলেছিল। তাদের পেছনে ছিল পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার বুদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই প্রচারণার জবাব দেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করেই আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা করতে পারি। আমরা যদি পাকিস্তানের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারি, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে তারা সাহসী হবে না। কিন্তু আমরা এই আঘাত হানতে ঢিলেমি করলে তারা এটাকে আমাদের দুর্বলতা ভেবে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করে ফেলবে।'
এই বিতর্কের সময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ধরে ফেলে, খোন্দকার মোশতাক ও তাঁর গ্রুপের সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ। মোশতাক তখন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রী পদ থেকে তাঁকে না সরিয়ে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিদেশ সফরের কথা ছিল; তাও বাতিল করা হয়।
ঠিক এই সময় লন্ডনে ঘটে আরো রহস্যজনক একটি ঘটনা। এই সময় লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে উচ্চ কূটনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তিনি হঠাৎ বিবিসি বেতারের বাংলা বিভাগে কর্মরত সিরাজুর রহমানের কাছ থেকে একটি রহস্যপূর্ণ টেলিফোন কল পান। সিরাজুর রহমান তাঁকে জানান, বুশ হাউসে (বিবিসি বেতারের অফিস) মি. ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর জরুরি সাক্ষাৎ প্রয়োজন। মি. ব্যানার্জি বুশ হাউসে ছুটে যান। তারপর কী হলো, মি. ব্যানার্জির স্মৃতিকথা 'India's security dilemmas : Pakistan and Bangladesh' শীর্ষক বই থেকে নিচে তা তুলে দিচ্ছি।
"He (Serajur Rahman) showed me a two page obituary of the Bangladesh leader, which he said the BBC world service was getting ready to broadcast within the next hour. He did not say a word more. The obituary papers with the logo on the top were handed over to me. There was no question of doubting the authenticity of the document. The meeting ended in the next few minutes followed by an exchange of usual courtesies. Grief-stricken but not without a certain amount of cynicism, I returned to my office almost running and wondering what was the real purpose of the meeting. What was the obituary notice trying to convey? Was it a plant to confuse India? Was Mujib really hanged by the Pakistanis, the news that BBC had come to know of before India did? It could not be that on such a matter of crucial importance for India, the BBC could have secured the information before India had done. Apa B Pant was the Indian High commissioner to whom I reported immidiately. An emergency meeting was called. Various channels of communication were activated and quick checks and counter checks followed. It was found out within minutes that Mujib was still alive and that the story was a deliberate plant to confuse India at an important stages on the war." (Indian security Dilemmas : Pakistan and Bangladesh." P 145-146).
মোদ্দাকথায় এর অর্থ হলো, 'সিরাজুর রহমান আমাকে বুশ হাউসে দুই পৃষ্ঠায় লেখা বাংলাদেশের নেতার মৃত্যুপরবর্তী জীবনালেখ্য দেখান এবং জানান, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস পরবর্তী ঘণ্টাতেই তা প্রচার করতে যাচ্ছে, যা আসলে হয়নি। ওই ওবিচুয়ারি প্রামাণ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কারণ ছিল না। শোকার্ত মনে, তবে কিছুটা সন্দেহসহ আমি প্রায় দৌড়ে অফিসে ফিরে আসি। ভাবতে থাকি, আমাকে ওবিচুয়ারির কাগজপত্র দেখানোর পেছনে সিরাজুর রহমানের উদ্দেশ্য কী? এটা কি ভারতকে হতবুদ্ধি করার চেষ্টা? সত্যই কি পাকিস্তানিরা মুজিবকে হত্যা করেছে? আর এই হত্যার খবর, যা ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা বিবিসি সর্বাগ্রে জেনে ফেলেছে? আপা বি পন্থ তখন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। তাঁকে অবিলম্বে বিষয়টি জানালাম। জরুরি মিটিং ডাকা হলো। সব রকম চ্যানেলে খবরটির সত্যাসত্য পরীক্ষা করা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে জানা গেল, মুজিব এখনো বেঁচে আছেন এবং তাঁর এই মৃত্যুসংবাদ যুদ্ধের এই চরম সন্ধিক্ষণে ভারতকে বিভ্রান্ত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রচার (ইন্ডিয়াস সিকিউরিটি ডাইলেমাস : পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬)।
ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি তাঁর বইতে এই ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করার বহু আগেই তা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও নেতাই জানতে পেরেছিলেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর কানে তাঁর মুক্তির পর তা পেঁৗছতে দেরি হয়নি। সিরাজুর রহমানকে বিদেশে একটি উচ্চপদ সৃষ্টি করে বসানোর প্রস্তাবের সময়ও বঙ্গবন্ধুকে এই ঘটনা পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তাঁকে চাকরিদানের প্রস্তাবটি তখন ধামাচাপা পড়ে। এরপর বঙ্গবন্ধু-বিদ্বেষে সিরাজুর রহমানের উন্মাদ হওয়ার এবং শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘাতক চক্র এবং তাদের সমর্থকদের দলের হয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারের আসল কারণের আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার আছে কি?
বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই তাঁর প্রতি অন্ধবিদ্বেষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্রতি সিরাজুর রহমান লন্ডনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এই বঙ্গবন্ধুবিরোধী এবং মোশতাকপন্থী চক্রটির নেতৃত্বে ছিলেন এ টি এম ওয়ালি আশরাফ নামে এক বাংলাদেশি সাংবাদিক। তিনি ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের প্রিয়পাত্র এবং খোন্দকার মোশতাক লন্ডনে এলে এই ওয়ালি আশরাফের বালহামের (Balham) বাসায় প্রায়ই উঠতেন। ওয়ালি আশরাফের মাধ্যমে সিরাজুর রহমান খোন্দকার মোশতাকেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।
সিরাজুর রহমান সম্পর্কে অধিক লিখে আমি তাঁর গুরুত্ব বাড়াতে চাই না। তিনি লিখেছেন, আমি লন্ডনে প্রথম এসে শফিক রেহমানের দ্বারা অনেকভাবে উপকৃত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে লিখেছি। শফিক রেহমান আমার বাল্যবন্ধু। আমার লেখায় তাঁর প্রতিভা ও মেধার কথা আমি উল্লেখ করেছি। পরবর্তীকালে তাঁর নীতিভ্রষ্টতা ও রাজনৈতিক অধঃপতনের সমালোচনা করেছি। লন্ডনে আসার পর আমার নানা সমস্যায় শফিক যেমন আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, আমিও তাঁর সমস্যা ও ক্রাইমিসে সাহায্য দিতে এগিয়ে গেছি। আমি লন্ডনে এসে তাঁদের কাছে আর্থিক বা বড় ধরনের কোনো সাহায্য নিইনি। চাইলে হয়তো শফিক বা তাঁর স্ত্রী তালেয়া দিতেন। আমার প্রয়োজন হয়নি।
অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে আমি ফকির হয়ে আসেনি। তখন আমি দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদন দিয়েছিল এবং ঢাকার ও লন্ডনের অনেক বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে প্রয়োজনে অর্থ সাহায্যও করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত তাসাদ্দুক আহমদ, এখনো জীবিত আছেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মতিন, এঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিবিসিতে চাকরি পাওয়ার জন্য সিরাজুর রহমানের কাছে আমাকে যেতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন বিবিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, তখনো সিরাজুর রহমান আমার প্রতি প্রীত ছিলেন না। সে কাহিনী আজ নয়, সময় ও সুযোগ হলে আরেক লেখায় বিস্তারিতভাবে লিখব। (সমাপ্ত)
লন্ডন : ১ আগস্ট সোমবার, ২০১১
No comments