স্মরণ-বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইতিহাসের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব by তামান্না ইসলাম অলি

১৯৭১-এর মার্চ মাস। উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। তিনি তখন জেনেভায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে। এ সময় পত্রিকায় দেখলেন পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র শহীদ। তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাসচিবকে লিখে পাঠালেন, 'আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই।

তাই আমি পদত্যাগ করলাম।' তার পরই যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব নিলেন সারা বিশ্বে জনমত গঠনের। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও গণহত্যার বিপক্ষে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ছিলেন একজন বিচারপতিও। তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আজ ১ আগস্ট এই খ্যাতিমান পুরুষের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৭ সালের এই দিনে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে লন্ডনে মারা যান তিনি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি, টাঙ্গাইলের নাগরবাড়ির এক জমিদার পরিবারে। বাবা আবদুল হামিদ চৌধুরীও ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর ডাকনাম শাহজাহান। ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় কলেজ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ কে ফজলুল হক, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুসহ আরো অনেক বিখ্যাত মানুষের কাছাকাছি আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে শেষ করেন বার অ্যাট ল। ১৯৬০ সালে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে। ১৯৬১ সালে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি পদে। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে তিনি প্রথম বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের দক্ষ কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা জানতে পেরে তিনি জেনেভা থেকে লন্ডনে চলে আসেন। সেখানে তিনি সর্বস্তরের বাঙালির জন্য সভা আহ্বান করেন। এ সভায়ই বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম নামে চারটি আঞ্চলিক কমিটি এবং ২০টি সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। অর্থ সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ব্রিটেনে তিনি প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। উদ্বোধন করেন স্মারক ডাকটিকিট।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি ছিলেন যেমন সহজ-সরল, তেমনি সুপণ্ডিত। অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি তৎকালীন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির সভাপতিরও। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন আবু সাঈদ চৌধুরী। ১২ জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব নেন রাষ্ট্রপতির। তিনিই দেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্মে তাঁর ভূমিকা খুবই উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই দিনে তাঁকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানো উচিত সবার। আর নীতি-নির্ধারণীয় কর্তৃপক্ষের উচিত তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.