হায় টিসিবি, হায় পণ্যমূল্য-মরা হাতি টানাটানি আর কতকাল?

নিজের পায়ে কুড়াল মারা_বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। সাধারণত কোনো বুদ্ধিমান মানুষ তা করে না। অথচ বর্তমান সরকার যেন তা-ই করছে এবং তা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। লাগামহীন বাজারের কারণে জনজীবনে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তারা কিছুতেই তাল মেলাতে পারছে না।


দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম কেবল বেড়েই যাচ্ছে। কিছুদিন আগে মানুষকে ৮৫ টাকা কেজি দরে চিনিও কিনতে হয়েছে। অথচ গত আড়াই বছরে সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) গতিশীল করতে পারল না। বাণিজ্যমন্ত্রী এ প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল করার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তব বলে উল্টো কথা। একে গতিশীল করার আদৌ কোনো ইচ্ছা সরকারের আছে বলেও মনে হয় না। টিসিবির গঠিত তদন্ত কমিটিও একই কথা বলেছে_একটি চক্র টিসিবিকে গতিশীল করতে দিচ্ছে না।
একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নানা রকম হয়রানির কারণে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ডিলাররা এসে টিসিবির মাল না নিয়েই ফেরত যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সরবরাহকারী গুদামে মাল থাকে না। সরবরাহ করা মসুর ডাল ও খেজুর অত্যন্ত নিম্নমানের। ডিলারদের সেগুলোই নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে লোকসানের আশঙ্কায় অনেক ডিলার মাল তুলছেন না। টিসিবির আড়াই হাজার ডিলার থাকলেও প্রথম কিস্তির মাল তুলেছেন মাত্র এক হাজার ১০০ ডিলার। আমাদের প্রশ্ন হলো, কার স্বার্থে টিসিবিকে এমন অকার্যকর করে রাখা হচ্ছে? ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট বাজারকে বারবার অস্থিতিশীল করছে এবং দফায় দফায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে_তাদের স্বার্থে?
প্রকৃত অর্থে এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কৌশলই সরকারের হাতে নেই। অভিযোগ আছে, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আগের সরকারগুলোও টিসিবিকে কার্যকর করেনি, এই সরকারও তা করছে না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, 'দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।... সর্বোপরি, সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।' সেই বহুমুখী ব্যবস্থা কোথায়? প্রতিটি পণ্যের দামই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে টিসিবির পাশাপাশি কসকর ও রেশন ব্যবস্থা চালু ছিল। এখন রেশন ব্যবস্থাও নেই, কসকরও নেই। আর টিসিবির যে অবস্থা, ওটা তো থেকেও নেই। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতেই নাকি এগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছিল এবং পরবর্তী সরকারগুলোও সেই ধারাকেই বহাল রেখেছে। এ থেকে একটি সত্যই বেরিয়ে আসে, ব্যবসায়ীদের অর্থে পরিচালিত রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকার গঠন করে, তখন ব্যবসায়ীদের প্রতিই তারা দায়বদ্ধ থাকে, জনগণের প্রতি নয়। কেবল ভোট পাওয়ার জন্য নির্বাচনী ইশতেহারে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। বর্তমান সরকার যদি সেই কলঙ্ক মাথায় নিতে না চায়, তাহলে তাকে বাকি সময়টুকু সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। সে জন্য টিসিবিকে কার্যকর করতে হবে, রেশনিং-ব্যবস্থা আবার চালু করতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে ক্রেতা ঠকানো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণ যেমন ক্ষমতায় বসাতে পারে, তেমনি প্রতিশ্রুতি না রাখলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.