জ্বালানি-বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন by মুশফিকুর রহমান
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৩ নভেম্বর সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটি ঢাকার আমিনবাজার ও যাত্রাবাড়ীতে ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানি হিসেবে ঢাকা মহানগরের ফেলে দেওয়া বর্জ্য পোড়াবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ‘ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসইএল’ নামের সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি হিসেবে ইতালীয় ওই কোম্পানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণের কাজ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটি নিজ ব্যয়ে পৌরবর্জ্যনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। কেন্দ্র দুটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতি কিলোওয়াট ৮ দশমিক ৭৫ টাকা দরে সরকার ২০ বছর ধরে কিনবে। চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পর তিন বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির নির্মাণ সম্পূর্ণ করে উৎপাদন শুরু করার কথা। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয় এবং উৎপাদিত বর্জ্য ফেলার জায়গা পাওয়া ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। তা ছাড়া পরিবেশ ও পানিদূষণের জন্যও বর্জ্য এক বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ এ দেশে নতুন। এবং বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প দুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারে ভূমিকা রাখবে।
পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই আমাদের দেশেও শহরগুলোর নিকটবর্তী নিচু জমিতে পৌরবর্জ্যের ভাগাড় গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে নিচু জমি ভরাট করতে বর্জ্য ফেলাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু জমি যত দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভের জলদূষণ যত বাড়ছে, বর্জ্য ফেলার জায়গা তত দুর্লভ হয়ে উঠছে। তা ছাড়া মানুষের সংখ্যা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাপ্রতি উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণও প্রতিদিন বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ভুলে যাই যে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বর্জ্যের উৎপাদন। এক বোতল পানি বা কোমল পানীয় বোতলজাত করার জন্য ব্যবহূত প্লাস্টিক বোতল তৈরি করতেও বোতলে যতটুকু পানি বা পানীয় রাখা যায়, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি পানি ব্যবহূত হয়। আমরা প্লাস্টিক বোতলে ভরা পানি যেভাবে এবং যে দামে কিনি, তা কী সব ক্ষেত্রে যৌক্তিক? কেবল প্লাস্টিক এবং পলিথিনের ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলেও আমাদের উৎপাদিত বর্জ্য অনেকটুকু কমানো সম্ভব। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্য অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে। বর্জ্য কম উৎপাদিত হলে তার জুতসই ব্যবস্থাপনা সহজ।
গৃহস্থালির বর্জ্যের অনেকটুকু পচনশীল বর্জ্য। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা গেলে পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ করে ভালো মানের জৈব সার উৎপাদন এবং বিপণনের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ইতিমধ্যে দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সীমিত পরিসরে গৃহস্থালির বর্জ্য সংগ্রহ ও তা থেকে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করার কিছু ছোট আকারের প্রকল্প পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ও সেগুলোর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনের তুলনায় এখনো সেসব উদ্যোগ অপর্যাপ্ত।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপায় নিশ্চিতভাবে বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ কমিয়ে ফেলা। বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব হতে পারে। তবে বর্জ্য পোড়ানোর সময় চারপাশের পরিবেশে ধোঁয়া এবং ছাই ছড়িয়ে গেলে তা বিপত্তির কারণ হতে পারে। বর্জ্যের উপাদানসমূহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্জ্য পোড়ানো ধোঁয়া এবং ছাইয়ের ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্ন হতে পারে। যেমন বর্জ্যের অংশ যদি হয় সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ধাতব বা ডাই-অক্সিন উৎপাদন-ক্ষমতার প্লাস্টিক বা পলিথিনজাতীয় পদার্থ, তাহলে তেমন বর্জ্য পোড়ালে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ছাই পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কেবল বিশেষায়িত চুল্লিতে এমন ক্ষতিকর বর্জ্য পোড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়। সে সঙ্গে ক্ষতিকর বর্জ্য পোড়ানোর কাজ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে সম্পাদন করতে হয়। উচ্চতাপে পোড়ানোর ফলে পৌরবর্জ্যেও ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফারের অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
আরও ভালো হয় যদি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা যায় (পচনশীল বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন তেমনই এক প্রক্রিয়া)। ১৯৮৮ সালের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে পৌরবর্জ্যের ১৭ শতাংশ পুড়িয়ে, ৫৫ শতাংশ আবর্জনার ভাগাড়ে জমি ভরাট করে এবং ২৮ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৭ সালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এক-তৃতীয়াংশ পুনর্ব্যবহার কাজে, ১৩ শতাংশ পোড়ানো এবং অবশিষ্ট বর্জ্য ভাগাড়ে ফেলেছে। পৌরবর্জ্য বলতে কাগজ, প্যাকেজিং সামগ্রী, ঘাস, লতাপাতা, আসবাবপত্র, কাপড়, বোতল, খাদ্যবস্তুর ফেলে দেওয়া অংশ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রং, ব্যাটারি ইত্যাদি বোঝায়। আমাদের দেশে সাধারণভাবে মেডিকেল বর্জ্য পৌর বর্জ্যের অংশ হলেও নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো মেডিকেল বর্জ্য, ক্ষতিকর শিল্প ও রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পৃথকভাবে ব্যবস্থা করা। এ জন্য বর্জ্যেও পৃথক ও সুশৃঙ্খল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। বর্জ্য উৎপাদনস্থলে পরিকল্পিতভাবে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী সেগুলো পৃথকভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন করা। অনেক ক্ষেত্রে বর্জ্য পোড়ানো বা পুনর্ব্যবহারের আগে তা পৃথক করার ব্যবস্থা উপযোগী হতে পারে, তবে অবশ্যই তা স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদভাবে সম্পাদন করা জরুরি।
পৌরবর্জ্য পোড়ালে তাপ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত তাপ কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ফুটিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা গেলে, তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে দুটি প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলো কত বর্জ্য পোড়াবে বা বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা পালন করবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। মোটা দাগের হিসাব অনুযায়ী, এক টন পৌরবর্জ্য (কঠিন বর্জ্য) থেকে ৫৫০ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ২৫০ কিলোগ্রাম কয়লা বা এক ব্যারেল পরিমাণ তেল পোড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৭টি পৌরবর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট রয়েছে (২০০৬ পর্যন্ত প্রকাশিত হিসাব) যার স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দুই হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। পৌর আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানায় উৎপন্ন ছাই বিভিন্ন ক্ষতিকর ভারী খনিজ ও ধাতব উপাদানসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। যথাযথ পৃথ্কীকরণসহ উপযুক্ত স্থান ছাড়া সে ছাই ফেলা হলে তা মাটি, পানি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু ছাই থেকে ক্ষতিকর উপাদান পৃথক করার ব্যয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির জন্য মোটেও আকর্ষণীয় বা লাভজনক বিনিয়োগ নয়। কিন্তু পরিবেশের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এ বিষয়টির তদারকি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অবশ্য কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন যে আমিনবাজারে ঢাকা-সাভার সড়কের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা সারি সারি মৌসুমি ইটভাটাগুলো বাধাহীনভাবে যে মাত্রার ধোঁয়া ও দূষণ ছড়িয়ে ঢাকার বাতাস ধূলিময় ও বিষাক্ত করে চলেছে, সেই নিরিখে ছোট্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র আর নতুন কতটুকু দূষণই বা যোগ করবে, তার সদুত্তর দেওয়া কঠিন।
মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক, খনি বিশেষজ্ঞ।
পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই আমাদের দেশেও শহরগুলোর নিকটবর্তী নিচু জমিতে পৌরবর্জ্যের ভাগাড় গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে নিচু জমি ভরাট করতে বর্জ্য ফেলাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু জমি যত দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভের জলদূষণ যত বাড়ছে, বর্জ্য ফেলার জায়গা তত দুর্লভ হয়ে উঠছে। তা ছাড়া মানুষের সংখ্যা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাপ্রতি উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণও প্রতিদিন বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ভুলে যাই যে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বর্জ্যের উৎপাদন। এক বোতল পানি বা কোমল পানীয় বোতলজাত করার জন্য ব্যবহূত প্লাস্টিক বোতল তৈরি করতেও বোতলে যতটুকু পানি বা পানীয় রাখা যায়, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি পানি ব্যবহূত হয়। আমরা প্লাস্টিক বোতলে ভরা পানি যেভাবে এবং যে দামে কিনি, তা কী সব ক্ষেত্রে যৌক্তিক? কেবল প্লাস্টিক এবং পলিথিনের ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলেও আমাদের উৎপাদিত বর্জ্য অনেকটুকু কমানো সম্ভব। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্য অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে। বর্জ্য কম উৎপাদিত হলে তার জুতসই ব্যবস্থাপনা সহজ।
গৃহস্থালির বর্জ্যের অনেকটুকু পচনশীল বর্জ্য। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা গেলে পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ করে ভালো মানের জৈব সার উৎপাদন এবং বিপণনের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ইতিমধ্যে দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সীমিত পরিসরে গৃহস্থালির বর্জ্য সংগ্রহ ও তা থেকে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করার কিছু ছোট আকারের প্রকল্প পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ও সেগুলোর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনের তুলনায় এখনো সেসব উদ্যোগ অপর্যাপ্ত।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপায় নিশ্চিতভাবে বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ কমিয়ে ফেলা। বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব হতে পারে। তবে বর্জ্য পোড়ানোর সময় চারপাশের পরিবেশে ধোঁয়া এবং ছাই ছড়িয়ে গেলে তা বিপত্তির কারণ হতে পারে। বর্জ্যের উপাদানসমূহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্জ্য পোড়ানো ধোঁয়া এবং ছাইয়ের ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্ন হতে পারে। যেমন বর্জ্যের অংশ যদি হয় সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ধাতব বা ডাই-অক্সিন উৎপাদন-ক্ষমতার প্লাস্টিক বা পলিথিনজাতীয় পদার্থ, তাহলে তেমন বর্জ্য পোড়ালে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ছাই পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কেবল বিশেষায়িত চুল্লিতে এমন ক্ষতিকর বর্জ্য পোড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়। সে সঙ্গে ক্ষতিকর বর্জ্য পোড়ানোর কাজ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে সম্পাদন করতে হয়। উচ্চতাপে পোড়ানোর ফলে পৌরবর্জ্যেও ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফারের অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
আরও ভালো হয় যদি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা যায় (পচনশীল বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন তেমনই এক প্রক্রিয়া)। ১৯৮৮ সালের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে পৌরবর্জ্যের ১৭ শতাংশ পুড়িয়ে, ৫৫ শতাংশ আবর্জনার ভাগাড়ে জমি ভরাট করে এবং ২৮ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৭ সালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এক-তৃতীয়াংশ পুনর্ব্যবহার কাজে, ১৩ শতাংশ পোড়ানো এবং অবশিষ্ট বর্জ্য ভাগাড়ে ফেলেছে। পৌরবর্জ্য বলতে কাগজ, প্যাকেজিং সামগ্রী, ঘাস, লতাপাতা, আসবাবপত্র, কাপড়, বোতল, খাদ্যবস্তুর ফেলে দেওয়া অংশ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রং, ব্যাটারি ইত্যাদি বোঝায়। আমাদের দেশে সাধারণভাবে মেডিকেল বর্জ্য পৌর বর্জ্যের অংশ হলেও নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো মেডিকেল বর্জ্য, ক্ষতিকর শিল্প ও রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পৃথকভাবে ব্যবস্থা করা। এ জন্য বর্জ্যেও পৃথক ও সুশৃঙ্খল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। বর্জ্য উৎপাদনস্থলে পরিকল্পিতভাবে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী সেগুলো পৃথকভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন করা। অনেক ক্ষেত্রে বর্জ্য পোড়ানো বা পুনর্ব্যবহারের আগে তা পৃথক করার ব্যবস্থা উপযোগী হতে পারে, তবে অবশ্যই তা স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদভাবে সম্পাদন করা জরুরি।
পৌরবর্জ্য পোড়ালে তাপ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত তাপ কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ফুটিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা গেলে, তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে দুটি প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলো কত বর্জ্য পোড়াবে বা বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা পালন করবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। মোটা দাগের হিসাব অনুযায়ী, এক টন পৌরবর্জ্য (কঠিন বর্জ্য) থেকে ৫৫০ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ২৫০ কিলোগ্রাম কয়লা বা এক ব্যারেল পরিমাণ তেল পোড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৭টি পৌরবর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট রয়েছে (২০০৬ পর্যন্ত প্রকাশিত হিসাব) যার স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দুই হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। পৌর আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানায় উৎপন্ন ছাই বিভিন্ন ক্ষতিকর ভারী খনিজ ও ধাতব উপাদানসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। যথাযথ পৃথ্কীকরণসহ উপযুক্ত স্থান ছাড়া সে ছাই ফেলা হলে তা মাটি, পানি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু ছাই থেকে ক্ষতিকর উপাদান পৃথক করার ব্যয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির জন্য মোটেও আকর্ষণীয় বা লাভজনক বিনিয়োগ নয়। কিন্তু পরিবেশের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এ বিষয়টির তদারকি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অবশ্য কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন যে আমিনবাজারে ঢাকা-সাভার সড়কের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা সারি সারি মৌসুমি ইটভাটাগুলো বাধাহীনভাবে যে মাত্রার ধোঁয়া ও দূষণ ছড়িয়ে ঢাকার বাতাস ধূলিময় ও বিষাক্ত করে চলেছে, সেই নিরিখে ছোট্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র আর নতুন কতটুকু দূষণই বা যোগ করবে, তার সদুত্তর দেওয়া কঠিন।
মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক, খনি বিশেষজ্ঞ।
No comments