ট্রানজিট ও নিরাপত্তা ঝুঁকি-বৈদেশিক সম্পর্ক by খুরশীদা বেগম
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে 'ট্রানজিট' বা 'করিডোর' প্রদানের প্রশ্নসূত্রে সর্বাগ্রে স্মরণ করা প্রয়োজন যে, বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দুটি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থের মৌল নির্ধারক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা প্রসঙ্গের বিস্তার রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিধিসূত্রে সর্বক্ষেত্রব্যাপী ও সার্বক্ষণিক, অশেষ ও অনিবার্য।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক যোগসূত্রতা, সংশ্লিষ্টতা ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নিরাপত্তা চিন্তার মানব বিবেকসিদ্ধ লক্ষ্য হওয়া উচিত অপরের ক্ষতি না করে অথবা পারস্পরিক স্বার্থ সমন্বয় করে নিজ দেশ কিংবা অন্য কোনো দেশের জনগণের কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ নিশ্চিতকরণ। এতগুলো কথা এ কারণে বলা হলো যে, এই আলোচনার আলোকেই ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন/পানি উন্নয়ন সমস্যা কিংবা করিডোর/ট্রানজিট প্রশ্ন ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা অর্থবহ হয়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত ছিল তার অন্যতম স্পর্শকাতর দুটি_ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের ট্রানজিট বা করিডোরের সুবিধা প্রদান। শেষ মুহূর্তে তিস্তার পানি বণ্টনের শর্তে আপত্তি থাকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন। যে কারণে শেষ পর্যন্ত দুটি চুক্তির কোনোটাই আর সম্পাদিত হয়নি। প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তিতে সই না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বকীয় অবস্থান সমুন্নত রেখেছেন ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে পণ্য পারাপারের সুবিধার্থে 'ট্রানজিট' প্রদানের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশিরভাগ আলোচনা আবর্তিত হয়েছে। প্রধানত 'ট্রানজিট' প্রদানের অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি, এর অবকাঠামো নির্মাণের প্রকৌশলগত চিন্তা ও হিসাব এবং ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল নিয়ে এ আলোচনা হয়েছে। পক্ষে যারা মতামত রেখেছেন, তারা ট্রানজিট বাস্তবায়ন সূত্রে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে রাতারাতি একটি উন্নততর সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তনের প্রত্যাশা করেছেন বা স্বপ্ন দেখেছেন। বর্তমান নিবন্ধে লাভ-লোকসানের খতিয়ানে ক্ষতিকর দিকগুলো নির্দেশ করা হয়েছে, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, আলোচ্য ট্রানজিট রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্বের মানদণ্ড, প্রাকৃতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য, জনগণের নিরাপত্তা ইত্যাদির পাশাপাশি এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুকূলে নয়। এখানে যে কোনো অঙ্কের অর্থ উপার্জনের হিসাব সার্বিক বিচারে অকিঞ্চিৎকর শুধু নয়, কোনোরূপ আর্থিক মূল্যমানে জাতীয় স্বার্থগত এ বিষয়টি কোনোমতেই বিচার্য নয়। এই সূত্রে প্রাসঙ্গিক প্রধান কয়েকটি বিষয় নির্দেশ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ এশিয়ার তিনটি বিশাল ভূখণ্ডে নির্ধারিত রাষ্ট্র ভারত, চীন ও বার্মা/মিয়ানমারের অতি স্পর্শকাতর (কখনও বিবদমান) সম্পর্কের পরিধির আওতাভুক্ত এবং তিন দিকে সরাসরি ভারত ও আংশিক মিয়ানমার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানে বিবেচ্য বিষয় এই যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দ্বিপক্ষীয়/বহুপক্ষীয় সম্পর্ক যেহেতু বন্ধুত্ব বা শত্রুতায় চিরস্থির নয় সেহেতু এসব ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপড়েন বা দ্বন্দ্বে-সংঘর্ষে বাংলাদেশের মধ্যে ভারতকে প্রদত্ত চলাচলের অধিকার সূত্রে বাংলাদেশ প্রধানত চারভাবে জড়িয়ে
পড়বে : ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় 'মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি'-এর আওতায় এনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে;
বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে;
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের চলাচলের সুবিধা থাকলে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হতে পারে;
বাংলাদেশ অপরাপর দেশের কাছে সন্দেহভাজন দেশে পরিগণিত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে দেশের দ্বিপক্ষীয়/আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে স্থিরীকৃত মানচিত্রে বাংলাদেশ একদিকে ছোট ও অপরদিকে দরিদ্র-দুর্বল রাষ্ট্র। এ অবস্থায় একটি বিরাট ও শক্তিশালী ভিন দেশের দিবা-রাত্রি চলাচলের সুবিধার্থে এই ছোট্ট আয়তনবিশিষ্ট ভূখণ্ডের বুক চিরে বিভিন্ন দিক থেকে পনেরো/সতেরোটি প্রস্তাবিত চলাচল পথ বাংলাদেশকে 'খণ্ড-বিখণ্ড' করে ফেলবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজনে নির্মিত কোনো পথসূত্রে 'খণ্ড-বিখণ্ড' শব্দটি রাজনৈতিকভাবে প্রযোজ্য নয়। 'খণ্ড-বিখণ্ড' শব্দের রাজনৈতিক ভাবার্থ এই যে, এসব পথে ভিন দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিবহন ও লোকজনের উপস্থিতি ঘটবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান প্রাপ্তির স্বার্থে ও শর্তে ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি যুক্তিযুক্ত কূটনীতি নয়। একটি মাত্র পয়েন্টে বিষয়টি এখানে নির্দেশ করা যায়। ভারত উজানের দেশ এবং বাংলাদেশ ভাটির দেশ। প্রায় সবক'টি নদী নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ভারতের হাতে প্রকৃতিদত্ত। সুতরাং ট্রানজিট/করিডোর ইত্যাদি প্রাপ্তি শেষে আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারত যদি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেয় তখন কী হবে? বাংলা প্রবাদে এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় 'আমও গেল, ছালাও গেল'।
বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের পূর্বাঞ্চলে 'সাত ভগিনী' বা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীগত সমস্যাকেন্দ্রিক ভারতের জাতীয় সংহতির সংকট নিরসনে কঠিন-কোমল যে নীতিই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করুক না কেন, স্বল্প ব্যয়ে, স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করে, স্বল্প সময়ে নিরাপদে/নির্বিঘ্নে সেখানে যোগাযোগ স্থাপন করতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলাচলের পথ সে ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে ভারতের এই সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি দেশের কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীর সমস্যা নবতর রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ক্ষুদ্র-দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে এসব সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বেনাপোল সীমান্ত পারাপার অথবা কলকাতা বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা সূত্রে ভারতগামী বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং স্থলপথে (বেনাপোল) কিছুটা চুপচাপ বিজিবি জওয়ান এবং অপরপক্ষে বিএসএফ জওয়ানদের যে রুক্ষ-রূঢ় আচরণ ও উভয় পক্ষে অফিসিয়াল দায়িত্বপ্রাপ্তদের ঘুষ গ্রহণের যে দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে ট্রানজিট/করিডোরে ভারতীয় পণ্য বহনকারী যানবাহনগুলো কতটা 'চেক' করা সম্ভব সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে।
বাংলাদেশে ভারী যানবাহন চলার উপযোগী রাস্তা-রেলপথ ইত্যাদি নির্মাণের দরুন পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে ফসলি জমি নষ্ট, ভূমি থেকে উৎপাটিত জনগণের পুনর্বাসন ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হবে।
আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন- ট্রানজিট/করিডোরে চলাচলসূত্রে চোরাচালান, চোরাকারবার তীব্রতর হতে পারে, নারী ও শিশু পাচার সমস্যা প্রকট হতে পারে, এইডস সংক্রমণ বিস্তৃত ও ব্যাপক হতে পারে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদী অপতৎপরতার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশে 'ট্রানজিট'-এর পক্ষে যারা ইউরোপের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন, তাদের অনুধাবন করা উচিত ভারত ও বাংলাদেশে ওইরূপ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি।
আলোচ্য ক্ষেত্রে যে কোনোরূপ চুক্তি সম্পাদনের আগে সংজ্ঞায়ন আবশ্যক এটি 'ট্রানজিট' অথবা 'করিডোর' কিংবা 'ট্রানশিপমেন্ট'। কেননা চুক্তির সব শর্ত বা দায়-দাবি ইত্যাদি ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং একটি আইনি মোড়ক লাভ করে।
ভারতের প্রয়োজন অনুযায়ী পথঘাট সংস্কার, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বাংলাদেশে ক্রমাগত হরতাল-ধর্মঘট চলাকালে বা অন্যান্য কারণে ভারতের নির্দেশ-নির্দেশনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সার্বভৌম অবস্থান থেকে বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। উপরের আলোচনার আলোকে ভারত-বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা প্রযোজ্য। অর্থাৎ ভারতের এক সীমান্ত থেকে ভারতীয় যান থেকে মালামাল খালাস করে বাংলাদেশ নিজ পরিবহনে অপর সীমান্তে পেঁৗছে আবার তা ভারতীয় যানবাহনে তুলে দেবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্থিক লাভের হিসাব রয়েছে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, যে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থগত বিষয়গুলোর অন্যতম এর প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। ভারত-বাংলাদেশ সুন্দর-শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উভয় দেশেরই জাতীয় স্বার্থে অত্যাবশ্যক। সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে উভয়ের জন্য কল্যাণকর পণ্য পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক।
ড. খুরশীদা বেগম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত ছিল তার অন্যতম স্পর্শকাতর দুটি_ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের ট্রানজিট বা করিডোরের সুবিধা প্রদান। শেষ মুহূর্তে তিস্তার পানি বণ্টনের শর্তে আপত্তি থাকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন। যে কারণে শেষ পর্যন্ত দুটি চুক্তির কোনোটাই আর সম্পাদিত হয়নি। প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তিতে সই না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বকীয় অবস্থান সমুন্নত রেখেছেন ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে পণ্য পারাপারের সুবিধার্থে 'ট্রানজিট' প্রদানের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশিরভাগ আলোচনা আবর্তিত হয়েছে। প্রধানত 'ট্রানজিট' প্রদানের অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি, এর অবকাঠামো নির্মাণের প্রকৌশলগত চিন্তা ও হিসাব এবং ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল নিয়ে এ আলোচনা হয়েছে। পক্ষে যারা মতামত রেখেছেন, তারা ট্রানজিট বাস্তবায়ন সূত্রে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে রাতারাতি একটি উন্নততর সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তনের প্রত্যাশা করেছেন বা স্বপ্ন দেখেছেন। বর্তমান নিবন্ধে লাভ-লোকসানের খতিয়ানে ক্ষতিকর দিকগুলো নির্দেশ করা হয়েছে, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, আলোচ্য ট্রানজিট রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্বের মানদণ্ড, প্রাকৃতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য, জনগণের নিরাপত্তা ইত্যাদির পাশাপাশি এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুকূলে নয়। এখানে যে কোনো অঙ্কের অর্থ উপার্জনের হিসাব সার্বিক বিচারে অকিঞ্চিৎকর শুধু নয়, কোনোরূপ আর্থিক মূল্যমানে জাতীয় স্বার্থগত এ বিষয়টি কোনোমতেই বিচার্য নয়। এই সূত্রে প্রাসঙ্গিক প্রধান কয়েকটি বিষয় নির্দেশ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ এশিয়ার তিনটি বিশাল ভূখণ্ডে নির্ধারিত রাষ্ট্র ভারত, চীন ও বার্মা/মিয়ানমারের অতি স্পর্শকাতর (কখনও বিবদমান) সম্পর্কের পরিধির আওতাভুক্ত এবং তিন দিকে সরাসরি ভারত ও আংশিক মিয়ানমার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানে বিবেচ্য বিষয় এই যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দ্বিপক্ষীয়/বহুপক্ষীয় সম্পর্ক যেহেতু বন্ধুত্ব বা শত্রুতায় চিরস্থির নয় সেহেতু এসব ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপড়েন বা দ্বন্দ্বে-সংঘর্ষে বাংলাদেশের মধ্যে ভারতকে প্রদত্ত চলাচলের অধিকার সূত্রে বাংলাদেশ প্রধানত চারভাবে জড়িয়ে
পড়বে : ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় 'মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি'-এর আওতায় এনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে;
বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে;
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের চলাচলের সুবিধা থাকলে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হতে পারে;
বাংলাদেশ অপরাপর দেশের কাছে সন্দেহভাজন দেশে পরিগণিত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে দেশের দ্বিপক্ষীয়/আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে স্থিরীকৃত মানচিত্রে বাংলাদেশ একদিকে ছোট ও অপরদিকে দরিদ্র-দুর্বল রাষ্ট্র। এ অবস্থায় একটি বিরাট ও শক্তিশালী ভিন দেশের দিবা-রাত্রি চলাচলের সুবিধার্থে এই ছোট্ট আয়তনবিশিষ্ট ভূখণ্ডের বুক চিরে বিভিন্ন দিক থেকে পনেরো/সতেরোটি প্রস্তাবিত চলাচল পথ বাংলাদেশকে 'খণ্ড-বিখণ্ড' করে ফেলবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজনে নির্মিত কোনো পথসূত্রে 'খণ্ড-বিখণ্ড' শব্দটি রাজনৈতিকভাবে প্রযোজ্য নয়। 'খণ্ড-বিখণ্ড' শব্দের রাজনৈতিক ভাবার্থ এই যে, এসব পথে ভিন দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিবহন ও লোকজনের উপস্থিতি ঘটবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান প্রাপ্তির স্বার্থে ও শর্তে ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি যুক্তিযুক্ত কূটনীতি নয়। একটি মাত্র পয়েন্টে বিষয়টি এখানে নির্দেশ করা যায়। ভারত উজানের দেশ এবং বাংলাদেশ ভাটির দেশ। প্রায় সবক'টি নদী নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ভারতের হাতে প্রকৃতিদত্ত। সুতরাং ট্রানজিট/করিডোর ইত্যাদি প্রাপ্তি শেষে আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারত যদি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেয় তখন কী হবে? বাংলা প্রবাদে এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় 'আমও গেল, ছালাও গেল'।
বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের পূর্বাঞ্চলে 'সাত ভগিনী' বা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীগত সমস্যাকেন্দ্রিক ভারতের জাতীয় সংহতির সংকট নিরসনে কঠিন-কোমল যে নীতিই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করুক না কেন, স্বল্প ব্যয়ে, স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করে, স্বল্প সময়ে নিরাপদে/নির্বিঘ্নে সেখানে যোগাযোগ স্থাপন করতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলাচলের পথ সে ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে ভারতের এই সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি দেশের কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীর সমস্যা নবতর রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ক্ষুদ্র-দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে এসব সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বেনাপোল সীমান্ত পারাপার অথবা কলকাতা বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা সূত্রে ভারতগামী বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং স্থলপথে (বেনাপোল) কিছুটা চুপচাপ বিজিবি জওয়ান এবং অপরপক্ষে বিএসএফ জওয়ানদের যে রুক্ষ-রূঢ় আচরণ ও উভয় পক্ষে অফিসিয়াল দায়িত্বপ্রাপ্তদের ঘুষ গ্রহণের যে দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে ট্রানজিট/করিডোরে ভারতীয় পণ্য বহনকারী যানবাহনগুলো কতটা 'চেক' করা সম্ভব সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে।
বাংলাদেশে ভারী যানবাহন চলার উপযোগী রাস্তা-রেলপথ ইত্যাদি নির্মাণের দরুন পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে ফসলি জমি নষ্ট, ভূমি থেকে উৎপাটিত জনগণের পুনর্বাসন ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হবে।
আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন- ট্রানজিট/করিডোরে চলাচলসূত্রে চোরাচালান, চোরাকারবার তীব্রতর হতে পারে, নারী ও শিশু পাচার সমস্যা প্রকট হতে পারে, এইডস সংক্রমণ বিস্তৃত ও ব্যাপক হতে পারে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদী অপতৎপরতার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশে 'ট্রানজিট'-এর পক্ষে যারা ইউরোপের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন, তাদের অনুধাবন করা উচিত ভারত ও বাংলাদেশে ওইরূপ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি।
আলোচ্য ক্ষেত্রে যে কোনোরূপ চুক্তি সম্পাদনের আগে সংজ্ঞায়ন আবশ্যক এটি 'ট্রানজিট' অথবা 'করিডোর' কিংবা 'ট্রানশিপমেন্ট'। কেননা চুক্তির সব শর্ত বা দায়-দাবি ইত্যাদি ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং একটি আইনি মোড়ক লাভ করে।
ভারতের প্রয়োজন অনুযায়ী পথঘাট সংস্কার, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বাংলাদেশে ক্রমাগত হরতাল-ধর্মঘট চলাকালে বা অন্যান্য কারণে ভারতের নির্দেশ-নির্দেশনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সার্বভৌম অবস্থান থেকে বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। উপরের আলোচনার আলোকে ভারত-বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা প্রযোজ্য। অর্থাৎ ভারতের এক সীমান্ত থেকে ভারতীয় যান থেকে মালামাল খালাস করে বাংলাদেশ নিজ পরিবহনে অপর সীমান্তে পেঁৗছে আবার তা ভারতীয় যানবাহনে তুলে দেবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্থিক লাভের হিসাব রয়েছে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, যে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থগত বিষয়গুলোর অন্যতম এর প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। ভারত-বাংলাদেশ সুন্দর-শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উভয় দেশেরই জাতীয় স্বার্থে অত্যাবশ্যক। সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে উভয়ের জন্য কল্যাণকর পণ্য পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক।
ড. খুরশীদা বেগম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments