দূরের দূরবীনে-বিদেশযাত্রা ও অভিবাসনবিষয়ক সতর্কতা by অজয় দাশগুপ্ত
ভাগ্য অন্বেষণে মানুষের বিদেশযাত্রা বা দেশান্তরি হওয়ার বাসনা নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসন হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতি প্রায় ঈশ্বরের ভূমিকায়। এমনকি এ ক্ষেত্রেও। শীতকালে উড়ে আসা অতিথি পাখির কথাই ধরা যাক। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এশিয়ার গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। তার পরও অনিন্দ্য সুন্দর যাত্রায় প্রকৃতি ভরিয়ে তোলে অতিথি পাখি।
এই যে আগমন, একি সত্যি আনন্দযাত্রা? মূলত জীবনের তাগিদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়া। বরফ, শীত, মাইনাস উষ্ণতার জন্য সাইবেরিয়া থেকে প্রাণ বাঁচাতেই উড়ে আসে এগুলো। খুঁজে নেয় নাতিশীতোষ্ণ অথবা উষ্ণ দেশের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা ডিঙানোর জন্য সব প্রাণীর পাখা থাকে না। সে কারণে কিছু কিছু প্রাণী একেকটি দেশের বিশেষ আকর্ষণও বটে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু বা কোয়েলা কেন পৃথিবী বিরল? কেন বিশ্ব পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় প্রাণী? কারণ এ দেশটি সমুদ্রবেষ্টিত। অনেক বছর আগে এশিয়ার সঙ্গে সংলগ্ন থাকার কারণে বলা হতো অস্ট্রেলেশিয়া। কালক্রমে সমুদ্র তাকে বিচ্ছিন্ন অথবা পৃথক করে একঘরে করেছে। আমাদের দেশটি ছোট হলেও অন্তত দুটি দেশে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব। ভারত ও মিয়ানমার। এ দুই দেশকে করিডর দিলে আরো অন্তত পাঁচটি দেশে স্থলভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু হয় আকাশ, নয় সমুদ্র। এ ছাড়া বেরোনোর পথ নেই এ দেশে। ক্যাঙ্গারু না জানে উড়তে না পারে সমুদ্র ডিঙাতে। ফলে সে অস্ট্রেলিয়ার একান্ত অস্ট্রেলিয়ান প্রাণী হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব তো মানুষ। মানুষ পাখি বা ক্যাঙ্গারু নয়, তার ইচ্ছাশক্তির ডানা আছে। যখন ছিল না, তখনো তার ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা থেমে থাকেনি। সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়াত, আবিষ্কার করত নতুন ভূমি, নতুন দেশ, নব বসতি। বস্তুত সে আমলেই মানুষ পেয়েছিল আশ্চর্য সব ভূখণ্ডের ঠিকানা। আবিষ্কৃত হয়েছে আমেরিকা, ভারত, লাতিন আমেরিকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কালক্রমে রাইট ব্রাদার্সের কল্পনা আকাশে ডানা মেলল। মানুষ পাখি হয়ে উঠতেও দেরি হলো না।
বলছিলাম, অভিবাসনের কথা। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ দেশান্তরি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বিশ্বায়নের কথা বলে দুনিয়াজুড়ে বাণিজ্য আর পণ্য বেচাকেনার দেশগুলো বিশ্বায়ন মানে, বিশ্বজনীনতা মানে না। ওয়ান প্ল্যানেট বা একক ও অভিন্ন দুনিয়ার স্লোগান হচ্ছে_ধার্যবিষয়ক। সম্পদের সুষমবণ্টন, ন্যায্য হিস্যা, প্রকৃতি সুরক্ষা, পরিবেশ ভারসাম্য বা এ-জাতীয় কোনো কিছুর বেলায় কিন্তু হিজ হিজ, হুজ হুজ, অর্থাৎ যার, যার, তার, তার। স্বার্থপরতার এই জঘন্য খেলাতেই গড়ে উঠেছে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামের অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় এক পরিচয় বলয়। কেন এই থার্ড ক্লাস বা তৃতীয় বিশ্ব নাম? আদপে কি তাই?
রাজনীতির এত ক্ষমতা রাষ্ট্রদূতের মতো উজ্জ্বল ও চমৎকার একটি পদকেও অমেরুদণ্ডি করে তুলতে পেরেছে। জানতাম চৌকস, বুদ্ধিময়, মেধাবী ও উৎসুক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাজনীতিপ্রবণদেরই এ পদে যাওয়ার কথা। ওই যে পাল্টে যাওয়া নিয়ম অনিয়মের সে ভেলায় চড়ে সাবেক আর্মি অফিসাররাই এ পদে সবচেয়ে বেশি অধিষ্ঠিত। একসময় গণতন্ত্র চর্চা বলে আসলেই কিছু ছিল না। আমরা জন্মেছি পাকিস্তানের পেট চিরে। ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক তো দূরের কথা, জনশাসনেও বিশ্বাসী নয়। সে দেশে কয়েক বছর পর পর ক্ষমতাসীন প্রভুরা নাজেল হয়। আবির্ভাব ঘটে কথিত ত্রাণকর্তার, এই সব ত্রাণকর্তা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, চৈনিক বিপ্লবীরাও কেন জানি এ তথ্যে বিশ্বাস করতেন। ওই নল যার কাছে, তারা ভাবে আমরাই পারি। দেশ রাষ্ট্র জনগণ প্রচলিত নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে তারা। তাদের ধারণা, দেশপ্রেমের সোল এজেন্সিও তাদের। হম্বিতম্বি আর গর্জনের ভেতর ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি-দুঃশাসন অবসানের নামে ইয়ং জেনারেশনও সুশীল সমাজের ওপর চোটপাট। যতবার তারা ক্ষমতা নেয়, রাস্তাঘাটে বন্দুক-কামান-স্টেনগান নিয়ে প্রহরারত সৈন্য-সামন্ত দেখে মনে হয় দেশে যুদ্ধ চলছে। ওই সব সান্ত্রি-সিপাইদের অন্যান্য কাজের ভেতর একটি মূল কাজ তরুণদের চুল কাটাতে বাধ্য করা। মাথার চুলের সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলার কী সম্পর্ক, তা আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমার ধারণা, নিজেদের মাথায় চুল না থাকার কারণে অথবা রাখতে না পারার নিয়মে অতিষ্ঠ হয়েই এরা লম্বা চুল বা মাঝারি কেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালোবাসে, ওই পর্যন্তই। একসময় গণজাগরণ বা জনইচ্ছার দাপটে লেজ গুটিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে হয় তাদের। সাধারণ সেনা বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা দাবার ঘুঁটি। তারা আমাদের স্বজন, ফলে তারা আসে আর যায়, কিন্তু কেউকেটা বা ত্রাণকর্তা নামে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন বিভোর মাতবর ও তার সহযোগীরা? তারা তখন যেনতেন প্রকারে সমঝোতায় আসতে ব্যস্ত। ওই সমঝোতা অনুযায়ী তাদের পাঠানো হয় দেশের বাইরে, তারাই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত। পাকিস্তান ভাঙলেও এ নিয়ম ভাঙেনি।
এ জাতীয় প্রক্রিয়া এখনো সচল। আমাদের দেশটি পাকিস্তান নয় এবং তা কোনো দিনও হওয়ার নয়। তবু মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের খুঁটি ধরে টান দেওয়ার প্রবণতা দেখি, রাজনীতির উদগ্র আর মারমুখী অবস্থানকে পুঁজি করে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাতন্ত্রের আবির্ভাব আর তার সুফলে রাষ্ট্রদূত পদটির সিংহভাগই এদের দখলে। এতে রাজনীতিরও লাভ। ক্ষমতাসীনরা ভাবেন এ বা ও ইনিবা তিনি দেশে না থাকলেই মঙ্গল, ক্ষমতা নিরাপদ, অভ্যুত্থানের ভয় নেই। ভয় নেই অন্ধকারে গদি হারানোরও। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে দেখুন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তালিকা নিলে একজন আর্মি অফিসার খুঁজে পাওয়া যাবে? পাশাপাশি আমাদের চিত্রটি দেখে মনে হবে, দেশের সিভিল সোসাইটিতে কূটনৈতিক হওয়ার মতো যোগ্য কোনো মানুষ নেই।
এ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রদূত পদটির ঔজ্জ্বল্য ও বিস্তারকে বিঘ্ন করেছে, যোগ্যতা বলে যেকোনো পেশা বা শ্রেণীর মানুষই এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তার বদলে অপপ্রক্রিয়া নির্বাসন বা স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রেরিত দূত না পারে দেশের পাশে দাঁড়াতে না জাতির হিতসাধন করতে। অথচ বাংলাদেশ এখন অগ্রসরমাণ উন্নয়ন অভিযাত্রী একটি দেশ, তার প্রবৃদ্ধি তার অর্জন, মানুষের পরিশ্রমলব্ধ কর্মকাণ্ডের সুফল তাকে দুনিয়াময় অন্যভাবে পরিচিত করতে সাহায্য করছে। একসময় শুধু শ্রমিক বা শ্রম রপ্তানি করার জন্য বেছে নেওয়া হলেও আজ শ্রম, মেধা, শ্রমিক শিল্প, উৎপাদিত পণ্যসহ সেবার জন্যও বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো কনজারভেটিভ বা সংরক্ষণবাদী সমাজ ও দেশে বাংলাদেশের পণ্য আজ দ্রুত জনপ্রিয় ও নিত্যব্যবহার্য হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের এই কালে রাষ্ট্রদূত বা দেশের রাজ প্রতিনিধির কাজ অনেক বড়, অনেক সুদূরপ্রসারী, সঠিক লবিং ঠিক জায়গামতো পেঁৗছুতে পারলে জনশক্তি ও সম্পদ রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন এক জগৎ বা জগতের দুয়ার খোলা সম্ভব। দেশের মানুষের বিদেশে কষ্টার্জিত আয় ও উপার্জন ভোগকারীদের দায়িত্ব প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সভা-সমিতি ও সেমিনার উদ্বোধন নয়, নয় প্রবাসী বাঙালির মেলা, খেলা বা গোষ্ঠীবদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠান। পিঠা উৎসবের মতো লঘু বিষয়ের অতিথি হয়ে বক্তৃতা দেওয়া। আজকাল এটাই রেওয়াজ ও নিয়ম। এমন একটি দেশের নাম বলুন, যে দেশে নিয়োজিত আমাদের রাষ্ট্রদূত শ্রম, শ্রমিক ও রপ্তানিজাত অনিয়ম বিশৃঙ্খলতা বা আদম ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো মতবিনিময় বা সর্বদলীয় সমাবেশ করেছেন। বলুন, কোনো দেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের কি বাধ্য করতে অথবা বোঝাতে পেরেছেন এবং তাঁদের মাঠে নামিয়ে এসব বিষয়ের বিরোধিতা করাতে পেরেছেন?
অথচ এদের পূর্বসূরি আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূতরাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো জটিল বিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রবল বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কোয়ালিটি বা গুণগত মানের ফারাকের জন্য দায়ী যে রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়, তার কাছেই এর প্রতিকার জমা। দফায় দফায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা বা হোমরা-চোমরাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ ও সিঅফ করার রেওয়াজ বন্ধ করে প্রকৃত কাজে মন দিতে বাধ্য করলে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস ও প্রবাসী জনগণ এক ও অভিন্ন হয়ে দেশের কাজে লাগতে পারবে। এমন জরুরি বিষয় উপেক্ষিত না থাকাই মঙ্গল। নিশ্চয়ই তা পুনর্বার বলতে হবে না।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
বলছিলাম, অভিবাসনের কথা। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ দেশান্তরি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বিশ্বায়নের কথা বলে দুনিয়াজুড়ে বাণিজ্য আর পণ্য বেচাকেনার দেশগুলো বিশ্বায়ন মানে, বিশ্বজনীনতা মানে না। ওয়ান প্ল্যানেট বা একক ও অভিন্ন দুনিয়ার স্লোগান হচ্ছে_ধার্যবিষয়ক। সম্পদের সুষমবণ্টন, ন্যায্য হিস্যা, প্রকৃতি সুরক্ষা, পরিবেশ ভারসাম্য বা এ-জাতীয় কোনো কিছুর বেলায় কিন্তু হিজ হিজ, হুজ হুজ, অর্থাৎ যার, যার, তার, তার। স্বার্থপরতার এই জঘন্য খেলাতেই গড়ে উঠেছে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামের অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় এক পরিচয় বলয়। কেন এই থার্ড ক্লাস বা তৃতীয় বিশ্ব নাম? আদপে কি তাই?
রাজনীতির এত ক্ষমতা রাষ্ট্রদূতের মতো উজ্জ্বল ও চমৎকার একটি পদকেও অমেরুদণ্ডি করে তুলতে পেরেছে। জানতাম চৌকস, বুদ্ধিময়, মেধাবী ও উৎসুক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাজনীতিপ্রবণদেরই এ পদে যাওয়ার কথা। ওই যে পাল্টে যাওয়া নিয়ম অনিয়মের সে ভেলায় চড়ে সাবেক আর্মি অফিসাররাই এ পদে সবচেয়ে বেশি অধিষ্ঠিত। একসময় গণতন্ত্র চর্চা বলে আসলেই কিছু ছিল না। আমরা জন্মেছি পাকিস্তানের পেট চিরে। ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক তো দূরের কথা, জনশাসনেও বিশ্বাসী নয়। সে দেশে কয়েক বছর পর পর ক্ষমতাসীন প্রভুরা নাজেল হয়। আবির্ভাব ঘটে কথিত ত্রাণকর্তার, এই সব ত্রাণকর্তা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, চৈনিক বিপ্লবীরাও কেন জানি এ তথ্যে বিশ্বাস করতেন। ওই নল যার কাছে, তারা ভাবে আমরাই পারি। দেশ রাষ্ট্র জনগণ প্রচলিত নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে তারা। তাদের ধারণা, দেশপ্রেমের সোল এজেন্সিও তাদের। হম্বিতম্বি আর গর্জনের ভেতর ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি-দুঃশাসন অবসানের নামে ইয়ং জেনারেশনও সুশীল সমাজের ওপর চোটপাট। যতবার তারা ক্ষমতা নেয়, রাস্তাঘাটে বন্দুক-কামান-স্টেনগান নিয়ে প্রহরারত সৈন্য-সামন্ত দেখে মনে হয় দেশে যুদ্ধ চলছে। ওই সব সান্ত্রি-সিপাইদের অন্যান্য কাজের ভেতর একটি মূল কাজ তরুণদের চুল কাটাতে বাধ্য করা। মাথার চুলের সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলার কী সম্পর্ক, তা আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমার ধারণা, নিজেদের মাথায় চুল না থাকার কারণে অথবা রাখতে না পারার নিয়মে অতিষ্ঠ হয়েই এরা লম্বা চুল বা মাঝারি কেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালোবাসে, ওই পর্যন্তই। একসময় গণজাগরণ বা জনইচ্ছার দাপটে লেজ গুটিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে হয় তাদের। সাধারণ সেনা বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা দাবার ঘুঁটি। তারা আমাদের স্বজন, ফলে তারা আসে আর যায়, কিন্তু কেউকেটা বা ত্রাণকর্তা নামে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন বিভোর মাতবর ও তার সহযোগীরা? তারা তখন যেনতেন প্রকারে সমঝোতায় আসতে ব্যস্ত। ওই সমঝোতা অনুযায়ী তাদের পাঠানো হয় দেশের বাইরে, তারাই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত। পাকিস্তান ভাঙলেও এ নিয়ম ভাঙেনি।
এ জাতীয় প্রক্রিয়া এখনো সচল। আমাদের দেশটি পাকিস্তান নয় এবং তা কোনো দিনও হওয়ার নয়। তবু মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের খুঁটি ধরে টান দেওয়ার প্রবণতা দেখি, রাজনীতির উদগ্র আর মারমুখী অবস্থানকে পুঁজি করে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাতন্ত্রের আবির্ভাব আর তার সুফলে রাষ্ট্রদূত পদটির সিংহভাগই এদের দখলে। এতে রাজনীতিরও লাভ। ক্ষমতাসীনরা ভাবেন এ বা ও ইনিবা তিনি দেশে না থাকলেই মঙ্গল, ক্ষমতা নিরাপদ, অভ্যুত্থানের ভয় নেই। ভয় নেই অন্ধকারে গদি হারানোরও। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে দেখুন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তালিকা নিলে একজন আর্মি অফিসার খুঁজে পাওয়া যাবে? পাশাপাশি আমাদের চিত্রটি দেখে মনে হবে, দেশের সিভিল সোসাইটিতে কূটনৈতিক হওয়ার মতো যোগ্য কোনো মানুষ নেই।
এ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রদূত পদটির ঔজ্জ্বল্য ও বিস্তারকে বিঘ্ন করেছে, যোগ্যতা বলে যেকোনো পেশা বা শ্রেণীর মানুষই এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তার বদলে অপপ্রক্রিয়া নির্বাসন বা স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রেরিত দূত না পারে দেশের পাশে দাঁড়াতে না জাতির হিতসাধন করতে। অথচ বাংলাদেশ এখন অগ্রসরমাণ উন্নয়ন অভিযাত্রী একটি দেশ, তার প্রবৃদ্ধি তার অর্জন, মানুষের পরিশ্রমলব্ধ কর্মকাণ্ডের সুফল তাকে দুনিয়াময় অন্যভাবে পরিচিত করতে সাহায্য করছে। একসময় শুধু শ্রমিক বা শ্রম রপ্তানি করার জন্য বেছে নেওয়া হলেও আজ শ্রম, মেধা, শ্রমিক শিল্প, উৎপাদিত পণ্যসহ সেবার জন্যও বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো কনজারভেটিভ বা সংরক্ষণবাদী সমাজ ও দেশে বাংলাদেশের পণ্য আজ দ্রুত জনপ্রিয় ও নিত্যব্যবহার্য হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের এই কালে রাষ্ট্রদূত বা দেশের রাজ প্রতিনিধির কাজ অনেক বড়, অনেক সুদূরপ্রসারী, সঠিক লবিং ঠিক জায়গামতো পেঁৗছুতে পারলে জনশক্তি ও সম্পদ রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন এক জগৎ বা জগতের দুয়ার খোলা সম্ভব। দেশের মানুষের বিদেশে কষ্টার্জিত আয় ও উপার্জন ভোগকারীদের দায়িত্ব প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সভা-সমিতি ও সেমিনার উদ্বোধন নয়, নয় প্রবাসী বাঙালির মেলা, খেলা বা গোষ্ঠীবদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠান। পিঠা উৎসবের মতো লঘু বিষয়ের অতিথি হয়ে বক্তৃতা দেওয়া। আজকাল এটাই রেওয়াজ ও নিয়ম। এমন একটি দেশের নাম বলুন, যে দেশে নিয়োজিত আমাদের রাষ্ট্রদূত শ্রম, শ্রমিক ও রপ্তানিজাত অনিয়ম বিশৃঙ্খলতা বা আদম ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো মতবিনিময় বা সর্বদলীয় সমাবেশ করেছেন। বলুন, কোনো দেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের কি বাধ্য করতে অথবা বোঝাতে পেরেছেন এবং তাঁদের মাঠে নামিয়ে এসব বিষয়ের বিরোধিতা করাতে পেরেছেন?
অথচ এদের পূর্বসূরি আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূতরাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো জটিল বিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রবল বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কোয়ালিটি বা গুণগত মানের ফারাকের জন্য দায়ী যে রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়, তার কাছেই এর প্রতিকার জমা। দফায় দফায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা বা হোমরা-চোমরাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ ও সিঅফ করার রেওয়াজ বন্ধ করে প্রকৃত কাজে মন দিতে বাধ্য করলে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস ও প্রবাসী জনগণ এক ও অভিন্ন হয়ে দেশের কাজে লাগতে পারবে। এমন জরুরি বিষয় উপেক্ষিত না থাকাই মঙ্গল। নিশ্চয়ই তা পুনর্বার বলতে হবে না।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments