কালের পুরাণ-‘ভাড়াটে’ আতঙ্কে বিএনপি by সোহরাব হাসান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মাফিয়া-ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলেও দু-চারজন ভদ্রলোক আছেন বলেই এখনো মানুষ রাজনীতির প্রতি পুরো আস্থা হারায়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমরা সে ধরনের সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই জানি। কথাবার্তায় তিনি বেশ চৌকস, ব্যক্তিগত আক্রমণ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন।
প্রতিমন্ত্রী থাকাকালেও তাঁকে নিয়ে তেমন সমালোচনা হয়নি। কিন্তু ইদানীং তিনিও যথেষ্ট লাগামহীন কথাবার্তা বলছেন। জানি না এটি চাকরি রক্ষার পূর্বশর্ত কি না।
গত বুধবার ঢাকায় এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অর্থ পাচারের মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাক্ষীরা বলে দিয়েছেন, মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের কোনো সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় তারেক রহমানকে ফাঁসাতে সরকার বিদেশ থেকে সাক্ষী ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।’
ভাড়াটে লোক মানে টাকা দিয়ে কাউকে বিশেষ কাজ বা সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা।
মির্জা সাহেব যাঁকে ভাড়া করা সাক্ষী বলছেন, তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) কর্মকর্তা ডেবরা লাপ্রেভট। তিনি এসেছেন মুদ্রা পাচারের এক মামলায় আদালতের সমন পেয়ে।
বুধবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই এফবিআই কর্মকর্তা বলেছেন, গিয়াসউদ্দিন আল মানুনের সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে দুটি ভিসা ক্রেডিট কার্ড ছিল। যার একটি ব্যবহার করতেন মামুন নিজে, আরেকটি তারেক রহমান। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মামুন ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ৭৯ হাজার ৫৪২ দশমিক ৭৮৫ ডলার এবং তারেক রহমান একই কার্ডের মাধ্যমে ৫৪ হাজার ৯৮২ দশমিক ৪২ ডলার ব্যয় করেন। এসব অর্থ তাঁরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, জার্মানি, দুবাই ও গ্রিসে কেনাকাটায় এবং চিকিৎসায় ব্যয় করেছেন। (ইত্তেফাক, ১৭ নভেম্বর ২০১১)
তদন্তে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশি ব্যবসায়ী খাদিজা ইসলাম তাঁর সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সাত লাখ ৫০ হাজার ডলার টেলিগ্রাফি ট্রান্সফারের মাধ্যমে ২০০৩ সালের পয়লা আগস্ট মামুনের সিটি ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্টে জমা করেন। এসব বক্তব্যের সমর্থনে ডেবরা ২২৯ ও ৫৪ পৃষ্ঠার দুটি তথ্য-উপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করেন।
ডেবরা আদালতে আরও বলেছেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে এফবিআইয়ে কর্মরত আছি। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য ব্যাপারে তদন্তে সহায়তার জন্য অনুরোধ করে। এ ব্যাপারে মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চায় যে তারা বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করবে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই নিশ্চয়তা পেয়েই মুদ্রা পাচারের বিষয়টি তদন্তের জন্য আমার কাছে পাঠায়। এর পরই আমি তদন্তে নামি। বাংলাদেশ সরকার সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত সহায়তা চাইলে তারা কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়। পরে বাংলাদেশ সরকার যা আমার হাতে হস্তান্তর করে। আমি উভয় পক্ষের কাগজপত্র (ডকুমেন্ট) পর্যালোচনা করি।’ (ইত্তেফাক, ১৭ নভেম্বর ২০১১)
সত্যের মুখোমুখি হতে কেন ভয়?
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিদেশে অবৈধ অর্থের লেনদেন সংক্রান্ত মামলাটি কিন্তু বর্তমান সরকার করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে সময়েই মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তিও হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তে এফবিআই সহায়তা করে আসছে। এই তদন্ত করতে গিয়ে এফবিআই তারেক রহমান ও গিয়াস আল মামুনের অবৈধ অর্থের লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে তখনকার ও বর্তমানে ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা অন্যদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। সময়ে হয়তো তাদেরও অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসবে। একসময় তারেক-মামুনের বিষয়টি জল্পনা ছিল, এখন প্রমাণিত। এখন যাঁদের নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে, তাঁদেরটাও প্রমাণিত হবে, অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনো সরকারের আমলে।
মুদ্রা পাচার মামলার অভিযোগে বলা হয়, ‘২০০৩ সালে টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যাদেশ পেতে চায়নার মেসার্স হারবিন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ঘুষ নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এজেন্ট নির্মাণ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির চেয়ারপারসন খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাত লাখ মার্কিন ডলার নেওয়া হয়। গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তারেক রহমান ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোগী। দুজনই এই অবৈধ টাকার উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে ব্যবসা করতেন এবং বনানীর একই অফিসে বসতেন।’
এখন দেশবাসীই বিচার করুন এফবিআইয়ের কর্মকর্তা ডেবরা কী করে ভাড়াটে সাক্ষী হলেন? পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের কি এভাবে ভাড়া করে এনে আদালতে মুখস্থ কথা বলানো যায়? এফবিআই কি বাংলাদেশ সরকার বা অন্য কারও কথায় চলে?
আর এফবিআই কর্মকর্তারা এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছেন, তাও নয়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি সরকারই মামলার তদন্তে সহযোগিতার জন্য এফবিআই কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সে সময়ে বিএনপি কি তাঁদের ভাড়া করে এনেছিল? তাঁরা কি বিএনপি সরকারের ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন? করেননি। যতদূর জানি তারা ব্যবহূত অস্ত্রের ধরণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন, যা মামলার তদন্তে সহায়ক হয়েছে।
আমরা বুঝি না, যে দলে বাঘা বাঘা আইনজীবী আছেন, সে দল কেন মুদ্রা পাচারের মতো একটি মামুলি মামলা লড়তে ভয় পাচ্ছে। বিএনপি নেতাদের উচিত ছিল, যে কথাগুলো তাঁরা মাঠে বলছেন, সেগুলো আদালতে বলা এবং শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
সংসদ বর্জন, আদালত বর্জন
এত দিন বাংলাদেশের রাজনীতির অপরিহার্য অংশ হলো সংসদ বর্জন। যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা সংসদ বর্জন করেন। এবং এ জন্য যুক্তি দাঁড় করাতেও অসুবিধা হয় না। ক্ষমতায় গিয়ে আবার তাঁরাই সেই যুক্তিগুলো ভুলে যান। ইদানীং যুক্ত হয়েছে আদালত বর্জন। মামলার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিবাদী পক্ষের আপত্তি থাকতে পারে। সেসব আপত্তি তাঁরা আদালতে পেশ করবেন। বাদী ও সাক্ষীকে জেরা করবেন। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাবেন। কিন্তু এসব না করে আদালতের প্রতি আস্থা নেই বলে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে এখন আইনজীবীরা মিছিল করছেন। আদালত অঙ্গনকে তারা রাজপথ বানাচ্ছেন।
বুধবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আদালত বর্জন করেন দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর আইনজীবীরা। তাঁদের যুক্তি হলো আদালতের প্রধান বিচারক বিচারপতি নিজামুল হক যেহেতু ১৯৯৪ সালে গঠিত গণতদন্ত কমিশনের একজন আইনজীবী ছিলেন, সেহেতু তিনি বিচারকের আসনে বসতে পারেন না। তাঁদের এই যুক্তি যে ঠিক নয়, তা নিশ্চিত করলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তাঁর পাল্টা যুক্তি হলো, যিনি আইনজীবী হিসেবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হয়ে কাজ করছেন, ভবিষ্যতে যদি তিনি হাইকোর্টের বিচারক হন নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত কোনো মামলার বিচার কি করতে পারবেন না, একসময় তাঁদের আইনজীবী ছিলেন এই অজুহাতে? তা ছাড়া গণতদন্ত কমিশন আইনি কোনো সংস্থা নয়। এটি ছিল নাগরিকদের উদ্যোগ। যাঁরা নিজামুল হকের ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁরা আসলে কুযুক্তি দেখাচ্ছেন অথবা আদালত বর্জনের মওকা খুঁজছেন।
তখনো তাঁরা একই কথা বলেছিলেন
এ বছরের মাঝামাঝি আদালতের সমন পেয়ে কর্নেল আবু তাহের ফাঁসির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলায় সাক্ষী হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। ১৯৭৬ সালের ঘটনা সম্পর্কে তিনি যা জানতেন, বলেছেন। সে সময়ও বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই সরকার আমেরিকা থেকে সাংবাদিক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। লিফশুলজের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। এমনকি ৭ নভেম্বরের ঘটনা মূল্যায়নেও তাঁর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আছে। তাই বলে তিনি ভাড়া খাটতে বাংলাদেশে এসেছেন—এ অভিযোগ কি বিশ্বাসযোগ্য? আসলে যাঁরা ভাড়া খাটতে অভ্যস্ত তাঁরাই অন্যকে ভাড়াটে ভাবেন।
বিএনপির নেতাদের জানা উচিত, এই লিফশুলজই মুজিব হত্যার নেপথ্য সত্য উদ্ঘাটন করতে ৩৬ বছর ধরে নিরলস অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সম্পৃক্ততার কথা বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন। তাই বলে মার্কিন সরকার বা সেই দেশের কোনো রাজনীতিক তাঁকে ভাড়াটে সাংবাদিক বলে অভিহিত করেননি। এখানেই বাংলাদেশ ও আমেরিকার রাজনীতিকদের মধ্যে পার্থক্য।
বিএনপি এখন ‘ভাড়াটে’ আতঙ্কে ভুগছে। বিদেশি সাক্ষী আনলে বলে, সরকার ভাড়া করে এনেছে। বিদেশি সাংবাদিক এলে বলে, সরকার ভাড়া করে এনেছে। বিদেশের সঙ্গে চুক্তি করলে বলে, সরকার দেশ বিক্রি করে দিয়েছে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। এ ভাবেই চলে আসছে কথিত গণতন্ত্রের মহড়া।
কোন তরুণ নেতৃত্ব চাইছে বিএনপি?
বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ দল। তারা একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল এবং ভবিষ্যতেও যাওয়ার আশা করে। ক্ষমতার রাজনীতি করে। সে ক্ষেত্রে তাদের উচিত অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু তারা যদি বরাবরের মতো বিতর্কিত ও পরিত্যক্ত ‘তরুণ নেতৃত্ব’কে নিয়ে এগোতে চায়, মানুষ গ্রহণ করবে না। খালেদা জিয়া যখন তরুণ নেতৃত্বের হাতে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিয়ে পরামর্শকের ভূমিকায় যেতে চান, স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, কোন সেই তরুণ নেতৃত্ব? বিদেশে মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত? জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক? বোমা-গ্রেনেডবাজি রাজনীতির উদ্ভাবক?
দেশবাসী তরুণ নেতৃত্ব চায়। কিন্তু পারিবারিক উত্তরাধিকারের নামে চাপিয়ে দেওয়া বিতর্কিত ও পরিত্যক্তদের নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
গত বুধবার ঢাকায় এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অর্থ পাচারের মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাক্ষীরা বলে দিয়েছেন, মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের কোনো সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় তারেক রহমানকে ফাঁসাতে সরকার বিদেশ থেকে সাক্ষী ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।’
ভাড়াটে লোক মানে টাকা দিয়ে কাউকে বিশেষ কাজ বা সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা।
মির্জা সাহেব যাঁকে ভাড়া করা সাক্ষী বলছেন, তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) কর্মকর্তা ডেবরা লাপ্রেভট। তিনি এসেছেন মুদ্রা পাচারের এক মামলায় আদালতের সমন পেয়ে।
বুধবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই এফবিআই কর্মকর্তা বলেছেন, গিয়াসউদ্দিন আল মানুনের সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে দুটি ভিসা ক্রেডিট কার্ড ছিল। যার একটি ব্যবহার করতেন মামুন নিজে, আরেকটি তারেক রহমান। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মামুন ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ৭৯ হাজার ৫৪২ দশমিক ৭৮৫ ডলার এবং তারেক রহমান একই কার্ডের মাধ্যমে ৫৪ হাজার ৯৮২ দশমিক ৪২ ডলার ব্যয় করেন। এসব অর্থ তাঁরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, জার্মানি, দুবাই ও গ্রিসে কেনাকাটায় এবং চিকিৎসায় ব্যয় করেছেন। (ইত্তেফাক, ১৭ নভেম্বর ২০১১)
তদন্তে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশি ব্যবসায়ী খাদিজা ইসলাম তাঁর সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সাত লাখ ৫০ হাজার ডলার টেলিগ্রাফি ট্রান্সফারের মাধ্যমে ২০০৩ সালের পয়লা আগস্ট মামুনের সিটি ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্টে জমা করেন। এসব বক্তব্যের সমর্থনে ডেবরা ২২৯ ও ৫৪ পৃষ্ঠার দুটি তথ্য-উপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করেন।
ডেবরা আদালতে আরও বলেছেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে এফবিআইয়ে কর্মরত আছি। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য ব্যাপারে তদন্তে সহায়তার জন্য অনুরোধ করে। এ ব্যাপারে মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চায় যে তারা বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করবে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই নিশ্চয়তা পেয়েই মুদ্রা পাচারের বিষয়টি তদন্তের জন্য আমার কাছে পাঠায়। এর পরই আমি তদন্তে নামি। বাংলাদেশ সরকার সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত সহায়তা চাইলে তারা কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়। পরে বাংলাদেশ সরকার যা আমার হাতে হস্তান্তর করে। আমি উভয় পক্ষের কাগজপত্র (ডকুমেন্ট) পর্যালোচনা করি।’ (ইত্তেফাক, ১৭ নভেম্বর ২০১১)
সত্যের মুখোমুখি হতে কেন ভয়?
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিদেশে অবৈধ অর্থের লেনদেন সংক্রান্ত মামলাটি কিন্তু বর্তমান সরকার করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে সময়েই মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তিও হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তে এফবিআই সহায়তা করে আসছে। এই তদন্ত করতে গিয়ে এফবিআই তারেক রহমান ও গিয়াস আল মামুনের অবৈধ অর্থের লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে তখনকার ও বর্তমানে ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা অন্যদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। সময়ে হয়তো তাদেরও অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসবে। একসময় তারেক-মামুনের বিষয়টি জল্পনা ছিল, এখন প্রমাণিত। এখন যাঁদের নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে, তাঁদেরটাও প্রমাণিত হবে, অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনো সরকারের আমলে।
মুদ্রা পাচার মামলার অভিযোগে বলা হয়, ‘২০০৩ সালে টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যাদেশ পেতে চায়নার মেসার্স হারবিন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ঘুষ নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এজেন্ট নির্মাণ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির চেয়ারপারসন খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাত লাখ মার্কিন ডলার নেওয়া হয়। গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তারেক রহমান ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোগী। দুজনই এই অবৈধ টাকার উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে ব্যবসা করতেন এবং বনানীর একই অফিসে বসতেন।’
এখন দেশবাসীই বিচার করুন এফবিআইয়ের কর্মকর্তা ডেবরা কী করে ভাড়াটে সাক্ষী হলেন? পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের কি এভাবে ভাড়া করে এনে আদালতে মুখস্থ কথা বলানো যায়? এফবিআই কি বাংলাদেশ সরকার বা অন্য কারও কথায় চলে?
আর এফবিআই কর্মকর্তারা এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছেন, তাও নয়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি সরকারই মামলার তদন্তে সহযোগিতার জন্য এফবিআই কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সে সময়ে বিএনপি কি তাঁদের ভাড়া করে এনেছিল? তাঁরা কি বিএনপি সরকারের ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন? করেননি। যতদূর জানি তারা ব্যবহূত অস্ত্রের ধরণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন, যা মামলার তদন্তে সহায়ক হয়েছে।
আমরা বুঝি না, যে দলে বাঘা বাঘা আইনজীবী আছেন, সে দল কেন মুদ্রা পাচারের মতো একটি মামুলি মামলা লড়তে ভয় পাচ্ছে। বিএনপি নেতাদের উচিত ছিল, যে কথাগুলো তাঁরা মাঠে বলছেন, সেগুলো আদালতে বলা এবং শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
সংসদ বর্জন, আদালত বর্জন
এত দিন বাংলাদেশের রাজনীতির অপরিহার্য অংশ হলো সংসদ বর্জন। যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা সংসদ বর্জন করেন। এবং এ জন্য যুক্তি দাঁড় করাতেও অসুবিধা হয় না। ক্ষমতায় গিয়ে আবার তাঁরাই সেই যুক্তিগুলো ভুলে যান। ইদানীং যুক্ত হয়েছে আদালত বর্জন। মামলার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিবাদী পক্ষের আপত্তি থাকতে পারে। সেসব আপত্তি তাঁরা আদালতে পেশ করবেন। বাদী ও সাক্ষীকে জেরা করবেন। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাবেন। কিন্তু এসব না করে আদালতের প্রতি আস্থা নেই বলে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে এখন আইনজীবীরা মিছিল করছেন। আদালত অঙ্গনকে তারা রাজপথ বানাচ্ছেন।
বুধবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আদালত বর্জন করেন দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর আইনজীবীরা। তাঁদের যুক্তি হলো আদালতের প্রধান বিচারক বিচারপতি নিজামুল হক যেহেতু ১৯৯৪ সালে গঠিত গণতদন্ত কমিশনের একজন আইনজীবী ছিলেন, সেহেতু তিনি বিচারকের আসনে বসতে পারেন না। তাঁদের এই যুক্তি যে ঠিক নয়, তা নিশ্চিত করলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তাঁর পাল্টা যুক্তি হলো, যিনি আইনজীবী হিসেবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হয়ে কাজ করছেন, ভবিষ্যতে যদি তিনি হাইকোর্টের বিচারক হন নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত কোনো মামলার বিচার কি করতে পারবেন না, একসময় তাঁদের আইনজীবী ছিলেন এই অজুহাতে? তা ছাড়া গণতদন্ত কমিশন আইনি কোনো সংস্থা নয়। এটি ছিল নাগরিকদের উদ্যোগ। যাঁরা নিজামুল হকের ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁরা আসলে কুযুক্তি দেখাচ্ছেন অথবা আদালত বর্জনের মওকা খুঁজছেন।
তখনো তাঁরা একই কথা বলেছিলেন
এ বছরের মাঝামাঝি আদালতের সমন পেয়ে কর্নেল আবু তাহের ফাঁসির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলায় সাক্ষী হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। ১৯৭৬ সালের ঘটনা সম্পর্কে তিনি যা জানতেন, বলেছেন। সে সময়ও বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই সরকার আমেরিকা থেকে সাংবাদিক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। লিফশুলজের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। এমনকি ৭ নভেম্বরের ঘটনা মূল্যায়নেও তাঁর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আছে। তাই বলে তিনি ভাড়া খাটতে বাংলাদেশে এসেছেন—এ অভিযোগ কি বিশ্বাসযোগ্য? আসলে যাঁরা ভাড়া খাটতে অভ্যস্ত তাঁরাই অন্যকে ভাড়াটে ভাবেন।
বিএনপির নেতাদের জানা উচিত, এই লিফশুলজই মুজিব হত্যার নেপথ্য সত্য উদ্ঘাটন করতে ৩৬ বছর ধরে নিরলস অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সম্পৃক্ততার কথা বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন। তাই বলে মার্কিন সরকার বা সেই দেশের কোনো রাজনীতিক তাঁকে ভাড়াটে সাংবাদিক বলে অভিহিত করেননি। এখানেই বাংলাদেশ ও আমেরিকার রাজনীতিকদের মধ্যে পার্থক্য।
বিএনপি এখন ‘ভাড়াটে’ আতঙ্কে ভুগছে। বিদেশি সাক্ষী আনলে বলে, সরকার ভাড়া করে এনেছে। বিদেশি সাংবাদিক এলে বলে, সরকার ভাড়া করে এনেছে। বিদেশের সঙ্গে চুক্তি করলে বলে, সরকার দেশ বিক্রি করে দিয়েছে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। এ ভাবেই চলে আসছে কথিত গণতন্ত্রের মহড়া।
কোন তরুণ নেতৃত্ব চাইছে বিএনপি?
বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ দল। তারা একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল এবং ভবিষ্যতেও যাওয়ার আশা করে। ক্ষমতার রাজনীতি করে। সে ক্ষেত্রে তাদের উচিত অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু তারা যদি বরাবরের মতো বিতর্কিত ও পরিত্যক্ত ‘তরুণ নেতৃত্ব’কে নিয়ে এগোতে চায়, মানুষ গ্রহণ করবে না। খালেদা জিয়া যখন তরুণ নেতৃত্বের হাতে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিয়ে পরামর্শকের ভূমিকায় যেতে চান, স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, কোন সেই তরুণ নেতৃত্ব? বিদেশে মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত? জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক? বোমা-গ্রেনেডবাজি রাজনীতির উদ্ভাবক?
দেশবাসী তরুণ নেতৃত্ব চায়। কিন্তু পারিবারিক উত্তরাধিকারের নামে চাপিয়ে দেওয়া বিতর্কিত ও পরিত্যক্তদের নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments