সেক্যুলার নরওয়েতে কেন এই সন্ত্রাসবাদ? by সাব্বির রহমান খান
গত ২২ জুলাই ঘটে গেছে শান্তির দেশ নরওয়েতে ইতিহাসের একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ড। সেই দেশে ভয়াবহ ও ব্যাপক এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্ববিবেককে। বিশ্ব মিডিয়ার সর্বশেষ খবরে মৃতের সংখ্যা ৯২ হলেও নরওয়ের পুলিশ জানিয়েছে, পুনঃ গণনায় এই সংখ্যা হয়তো কিছুটা কমতে পারে। ঘটনার পর এর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, সুইডেন, পোল্যান্ডসহ আরো অনেক দেশের উগ্রপন্থীদের সংশ্লিষ্টতার। শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বজুড়েই উগ্র জঙ্গিবাদ আজ সংগঠিত এবং একত্রিত।
সবার এখন একটাই প্রশ্ন, সন্ত্রাস দমনে যে দেশটি এবং মহাদেশটি বিশ্ব পরিমণ্ডলের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছে নিদ্রাহীনভাবে, সেই দেশ বা মহাদেশের ভেতরে কিভাবে ঘটতে পারে এই ঘটনাটি! শুরুতেই মুসলিম সন্ত্রাসবাদ বা আল-কায়েদার দিকে সন্দেহের তীর ছোড়া হলেও পরে দেখা গেল, ঘটনাটার জন্য দায়ী সে দেশেরই একজন উগ্রপন্থী, সাদা চামড়ার নরওয়েজিয়ান, যার সঙ্গে ইসলামপন্থীদের কোনো সংস্রবই নেই। বরং নরওয়েতে জোড়া হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত অ্যান্দারস বেরিং ব্রেইভিক একজন মুসলিমবিদ্বেষী, বর্ণবাদী হিসেবেই এই আক্রমণ চালিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। সনাতন ধারণায় নরওয়ের নিরাপত্তাবাহিনীর দৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের চেয়ে ইসলামী সন্ত্রাসবাদই তাদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে গণ্য হতো। সে দেশে চরম ডানপন্থী বা নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সংগঠনগুলোর উপস্থিতির বিষয়টি নাকচ না করা হলেও খুব যে একটা গ্রাহ্য করা হয়েছে, তার নমুনাও দেখা যায় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত দুই দশক ধরে ইউরোপে বর্ণবাদের পুনরুত্থান এবং এর দ্রুত প্রসার ঘটেছে অনেকটা বাধাহীনভাবেই। লোকচক্ষুর অন্তরালে বাড়তে বাড়তে বর্ণবাদী উগ্রপন্থীরা এত গভীরে তাদের শেকড় গেড়ে বসিয়েছে যে চাইলেই তা হুট করে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। ইউরোপের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি উগ্রপন্থীর উত্থান ঘটেছে, তার মধ্যে নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ আরো বেশ কিছু দেশ উল্লেখযোগ্য। নেদারল্যান্ডসে ২০১০-এর জুনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে উগ্রপন্থী বর্ণবাদী ফ্রিডম পার্টি তৃতীয় অবস্থান লাভ করে। একই বছর সেপ্টেম্বরে ইউরোপের সবচেয়ে লিবারেল এবং শান্তির দেশ খ্যাত সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনেও সে দেশের অভিবাসনবিরোধী উগ্রপন্থী সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি জাতীয় সংসদে ২০টি আসন লাভ করে সংসদের ভারসাম্য রক্ষাকারী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই অবস্থা। হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সে দেশের উগ্রপন্থী জবিক পার্টি আশাতীত ফল লাভ করে। এ ছাড়া ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া এবং ইতালির জাতীয় নির্বাচনগুলোয় সেসব দেশের উগ্রপন্থীদের অসাধারণ সাফল্য আশাতীত। ফ্রান্সও পিছিয়ে নেই। উগ্রপন্থীদের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উচ্ছেদ করেছে সে দেশে বসবাসরত রোমারদের। ইউরোপের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে জাতীয় রাজনীতিতে উগ্রপন্থীদের 'ইজম'কে হিসাবের বাইরে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মোদ্দাকথা, পশ্চিমা বিশ্বে উগ্রপন্থী পুনর্জাগরণ এবং নিজ নিজ দেশের মূল রাজনীতিতে তাদের বর্ণবাদী আক্রমণাত্মক অংশগ্রহণ বিশ্বরাজনীতিতে আশু এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন একাধিক বিশ্লেষক।
ইউরোপে উগ্রপন্থীদের উত্থান তথা তাদের দ্রুত বিস্তার লাভের মূল কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে প্রধানত দায়ী করা যায়। প্রথমত. ইসলামভীতি এবং দ্বিতীয়ত. অর্থনৈতিক মন্দা। প্রথমটাকে ইউরোপের রাজনীতিবিদদের দ্বারা অ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর মাছ জিইয়ে রাখার মতোই ধরে নেওয়া যায়। বিশ্লেষকের মতে, এই দুটি বিষয়কে পুঁজি করেই দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভকারী উগ্রপন্থী দলগুলো ভোটারদের এ কথা বলে বিশ্বাস করাতে সমর্থ হচ্ছে যে অভিবাসীদের কারণেই মূল ইউরোপীয়রা কাজ পাচ্ছে না; এবং মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে ইউরোপীয় উদার-সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। গত বছর ইতালির এক যাজক তো সাংবাদিকদের ডেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেই বসলেন যে ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানরা যে হারে বংশবৃদ্ধি করছে এবং পাশাপাশি মূল ইউরোপীয়রা যেভাবে বংশবৃদ্ধিতে অনীহা প্রকাশ করে চলেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানরাই ইউরোপ শাসন করবে। ইউরোপের যেকোনো দেশে জাতীয় নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই ইসলাম ও অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য। কিন্তু দেশগুলোর প্রগতিশীল বা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদরা নিজেদের ভোট হারানোর ভয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই চুপ থেকেছেন অথবা না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই_যার খেসারত দিতে হচ্ছে আজ। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি পার্লামেন্টের আসনের ভাগীদার আজ এই উগ্র ডানপন্থীরা। কট্টরবাদীরা স্বভাবতই অর্থনৈতিক মন্দার জন্য বলির পাঁঠা হিসেবে উপস্থাপন করছে অভিবাসীদের। ইউরোপে অভিবাসীদের বড় অংশটাই মুসলমান, যার কারণে সব দোষ পড়ছে তাদের ওপরেই।
ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিবাদের গোড়াপত্তন ইউরোপের মাটিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে বেশ পুরনো হওয়ায় ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ইহুদিবিদ্বেষ বিষয়টি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অপরিহার্য এক বিষয় হিসেবে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। গোড়াতে খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারক এবং পরবর্তী সময়ে চার্চের যাজকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে খ্রিস্টান সমপ্রদায়কে ইহুদিবাদের ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বভাবসুলভ প্রচারণাই হাজার বছর ধরে ইউরোপের মাটিতে লালন করা হয়েছে ইহুদিবিদ্বেষের।
কয়েক দশক ধরে নর্ডিক দেশগুলো নিজেদের ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে সুখী, সমৃদ্ধ এবং বহু সংস্কৃতির সহাবস্থানের প্রতীকী দেশ হিসেবে। স্বচিত্রায়িত ছবিটি দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারলেও বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোয় নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্কের পর ফিনল্যান্ডেও উগ্র ডানপন্থীদের হতবাক করা ফলাফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের সে চিত্র এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। ডেনমার্কের ফোলক পার্টি, সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি, নরওয়ের ফ্রেমস্কৃত পার্টি এবং ফিনল্যান্ডের প্রকৃত ফিনল্যান্ড পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার প্রায় এক ও অভিন্ন এবং তা হচ্ছে অভিবাসন তথা ইসলামবিরোধী। উলি্লখিত প্রতিটি পার্টিই নিজ নিজ দেশের জাতীয় সংসদে ভারসাম্য রক্ষাকারী দলের ভূমিকা পালন করছে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে বিশ্বজুড়ে ইসলামভীতি, বিশেষত ইউরোপে তার প্রসার মূলত ৯/১১ পরবর্তী পশ্চিমা শক্তির প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বের প্রথম সারির রাজনীতিবিদরা প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রচারণায় জেনে অথবা না জেনে ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদ এবং ভায়োলেন্সের সঙ্গে সমান্তরালকরণ করছে। কেউ কেউ আবার ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আইন করে বিভিন্ন বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে, যা পক্ষান্তরে বর্ণবাদ, উগ্র জঙ্গিবাদ এবং নব্য-নাৎসিবাদকে উৎসাহী করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিগত বছরগুলোতে ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলো সম্মুখীন হয়েছে অভিবাসনবিদ্বেষী এবং উগ্রপন্থী বর্ণবাদী দলগুলোর ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রার তিক্ত অভিজ্ঞতার। ঠিক একইভাবে ইউরোপের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থার এবং দ্রুত বর্ধমান অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের ইউরোপীয় সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে একীভূতকরণের ব্যর্থতার দায়ভারও দেশগুলোর প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা এড়াতে পারেন না। রাজনৈতিকভাবে মূলধারার রাজনীতিবিদদের উলি্লখিত সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধানের ব্যর্থতার কারণে সাধারণের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে, স্বাভাবিক কারণেই তার সদ্ব্যবহার করছে ইউরোপীয় উগ্র কট্টরপন্থীরা। বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে যুদ্ধকেই বেছে নেওয়া হয়েছে সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে। নরওয়ের অ্যান্দারস বেরিং ব্রেইভিক অনেকটা টাইম বোমার মতোই আবির্ভূত হয়েছে মাত্র। বাকিগুলো দেখার অপেক্ষায়!
লেখক : সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
sabbir.rahman@gmail.com
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত দুই দশক ধরে ইউরোপে বর্ণবাদের পুনরুত্থান এবং এর দ্রুত প্রসার ঘটেছে অনেকটা বাধাহীনভাবেই। লোকচক্ষুর অন্তরালে বাড়তে বাড়তে বর্ণবাদী উগ্রপন্থীরা এত গভীরে তাদের শেকড় গেড়ে বসিয়েছে যে চাইলেই তা হুট করে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। ইউরোপের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি উগ্রপন্থীর উত্থান ঘটেছে, তার মধ্যে নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ আরো বেশ কিছু দেশ উল্লেখযোগ্য। নেদারল্যান্ডসে ২০১০-এর জুনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে উগ্রপন্থী বর্ণবাদী ফ্রিডম পার্টি তৃতীয় অবস্থান লাভ করে। একই বছর সেপ্টেম্বরে ইউরোপের সবচেয়ে লিবারেল এবং শান্তির দেশ খ্যাত সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনেও সে দেশের অভিবাসনবিরোধী উগ্রপন্থী সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি জাতীয় সংসদে ২০টি আসন লাভ করে সংসদের ভারসাম্য রক্ষাকারী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই অবস্থা। হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সে দেশের উগ্রপন্থী জবিক পার্টি আশাতীত ফল লাভ করে। এ ছাড়া ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া এবং ইতালির জাতীয় নির্বাচনগুলোয় সেসব দেশের উগ্রপন্থীদের অসাধারণ সাফল্য আশাতীত। ফ্রান্সও পিছিয়ে নেই। উগ্রপন্থীদের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উচ্ছেদ করেছে সে দেশে বসবাসরত রোমারদের। ইউরোপের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে জাতীয় রাজনীতিতে উগ্রপন্থীদের 'ইজম'কে হিসাবের বাইরে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মোদ্দাকথা, পশ্চিমা বিশ্বে উগ্রপন্থী পুনর্জাগরণ এবং নিজ নিজ দেশের মূল রাজনীতিতে তাদের বর্ণবাদী আক্রমণাত্মক অংশগ্রহণ বিশ্বরাজনীতিতে আশু এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন একাধিক বিশ্লেষক।
ইউরোপে উগ্রপন্থীদের উত্থান তথা তাদের দ্রুত বিস্তার লাভের মূল কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে প্রধানত দায়ী করা যায়। প্রথমত. ইসলামভীতি এবং দ্বিতীয়ত. অর্থনৈতিক মন্দা। প্রথমটাকে ইউরোপের রাজনীতিবিদদের দ্বারা অ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর মাছ জিইয়ে রাখার মতোই ধরে নেওয়া যায়। বিশ্লেষকের মতে, এই দুটি বিষয়কে পুঁজি করেই দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভকারী উগ্রপন্থী দলগুলো ভোটারদের এ কথা বলে বিশ্বাস করাতে সমর্থ হচ্ছে যে অভিবাসীদের কারণেই মূল ইউরোপীয়রা কাজ পাচ্ছে না; এবং মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে ইউরোপীয় উদার-সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। গত বছর ইতালির এক যাজক তো সাংবাদিকদের ডেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেই বসলেন যে ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানরা যে হারে বংশবৃদ্ধি করছে এবং পাশাপাশি মূল ইউরোপীয়রা যেভাবে বংশবৃদ্ধিতে অনীহা প্রকাশ করে চলেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানরাই ইউরোপ শাসন করবে। ইউরোপের যেকোনো দেশে জাতীয় নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই ইসলাম ও অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য। কিন্তু দেশগুলোর প্রগতিশীল বা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদরা নিজেদের ভোট হারানোর ভয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই চুপ থেকেছেন অথবা না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই_যার খেসারত দিতে হচ্ছে আজ। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি পার্লামেন্টের আসনের ভাগীদার আজ এই উগ্র ডানপন্থীরা। কট্টরবাদীরা স্বভাবতই অর্থনৈতিক মন্দার জন্য বলির পাঁঠা হিসেবে উপস্থাপন করছে অভিবাসীদের। ইউরোপে অভিবাসীদের বড় অংশটাই মুসলমান, যার কারণে সব দোষ পড়ছে তাদের ওপরেই।
ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিবাদের গোড়াপত্তন ইউরোপের মাটিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে বেশ পুরনো হওয়ায় ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ইহুদিবিদ্বেষ বিষয়টি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অপরিহার্য এক বিষয় হিসেবে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। গোড়াতে খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারক এবং পরবর্তী সময়ে চার্চের যাজকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে খ্রিস্টান সমপ্রদায়কে ইহুদিবাদের ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বভাবসুলভ প্রচারণাই হাজার বছর ধরে ইউরোপের মাটিতে লালন করা হয়েছে ইহুদিবিদ্বেষের।
কয়েক দশক ধরে নর্ডিক দেশগুলো নিজেদের ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে সুখী, সমৃদ্ধ এবং বহু সংস্কৃতির সহাবস্থানের প্রতীকী দেশ হিসেবে। স্বচিত্রায়িত ছবিটি দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারলেও বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোয় নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্কের পর ফিনল্যান্ডেও উগ্র ডানপন্থীদের হতবাক করা ফলাফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের সে চিত্র এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। ডেনমার্কের ফোলক পার্টি, সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি, নরওয়ের ফ্রেমস্কৃত পার্টি এবং ফিনল্যান্ডের প্রকৃত ফিনল্যান্ড পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার প্রায় এক ও অভিন্ন এবং তা হচ্ছে অভিবাসন তথা ইসলামবিরোধী। উলি্লখিত প্রতিটি পার্টিই নিজ নিজ দেশের জাতীয় সংসদে ভারসাম্য রক্ষাকারী দলের ভূমিকা পালন করছে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে বিশ্বজুড়ে ইসলামভীতি, বিশেষত ইউরোপে তার প্রসার মূলত ৯/১১ পরবর্তী পশ্চিমা শক্তির প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বের প্রথম সারির রাজনীতিবিদরা প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রচারণায় জেনে অথবা না জেনে ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদ এবং ভায়োলেন্সের সঙ্গে সমান্তরালকরণ করছে। কেউ কেউ আবার ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আইন করে বিভিন্ন বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে, যা পক্ষান্তরে বর্ণবাদ, উগ্র জঙ্গিবাদ এবং নব্য-নাৎসিবাদকে উৎসাহী করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিগত বছরগুলোতে ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলো সম্মুখীন হয়েছে অভিবাসনবিদ্বেষী এবং উগ্রপন্থী বর্ণবাদী দলগুলোর ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রার তিক্ত অভিজ্ঞতার। ঠিক একইভাবে ইউরোপের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থার এবং দ্রুত বর্ধমান অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের ইউরোপীয় সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে একীভূতকরণের ব্যর্থতার দায়ভারও দেশগুলোর প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা এড়াতে পারেন না। রাজনৈতিকভাবে মূলধারার রাজনীতিবিদদের উলি্লখিত সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধানের ব্যর্থতার কারণে সাধারণের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে, স্বাভাবিক কারণেই তার সদ্ব্যবহার করছে ইউরোপীয় উগ্র কট্টরপন্থীরা। বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে যুদ্ধকেই বেছে নেওয়া হয়েছে সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে। নরওয়ের অ্যান্দারস বেরিং ব্রেইভিক অনেকটা টাইম বোমার মতোই আবির্ভূত হয়েছে মাত্র। বাকিগুলো দেখার অপেক্ষায়!
লেখক : সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
sabbir.rahman@gmail.com
No comments