ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা-টিআর ও কাবিখা কর্মসূচি স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের অধীন করা উচিত

এক
টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচির দুর্নীতি নিয়ে কালের কণ্ঠ গত ১৭ জুলাই প্রথম পৃষ্ঠায় 'দলীয় কর্মী পোষার টিআর ও কাবিখা' শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা সংস্কারের নামে গত ১০ বছরে টিআর ও কাবিখার ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে নির্মাণ করা যেত বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর মতো আরো দুটি সেতু।

বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও এসব কর্মসূচির কোনো জবাবদিহিতা নেই। এসব কর্মসূচিতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অবকাঠামো বদলে দেওয়া সম্ভব। একই দিনের কালের কণ্ঠে 'বিশেষ আয়োজন' পাতায় অস্তিত্বহীন রাস্তা ও প্রতিষ্ঠানের নামে কিভাবে কাবিখা ও টিআর লুটপাট হচ্ছে, তা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, 'এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা দরকার।' যদিও তিনি বিদ্যমান এজেন্টধর্মী স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উপায় সম্পর্কে কিছুই বলেননি।

দুই.
যত দূর জানা যায়, স্বাধীনতার পর বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর রিলিফ কার্যক্রমের হাত ধরে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচি আসে। সে সময় যুক্তি দেখানো হয়, বিনা মূল্যে রিলিফ দিলে মানুষ অলস হয়ে পড়বে। তা ছাড়া আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি বিনা পারিশ্রমিকে সাহায্য নিতে চান না। সে জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা উচিত। এর পর থেকে বিভিন্ন নামে ওইসব ত্রাণ কর্মসূচি চালু হয়। এর আগে দাতাদের অর্থে চললেও বর্তমানে প্রকল্পগুলো রাজস্ব অর্থের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য যে 'কাজ' সম্পন্ন করা নয়, তা বিভিন্ন সময় সরকারের দেওয়া বক্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন_খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলে সরকার বলে থাকে, 'খাদ্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে শিগগিরই কাবিখা ও টিআর কর্মসূচি চালু করা হবে' (একই যুক্তিতে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি চালু করা হয়)। অর্থাৎ আসল উদ্দেশ্য হলো, বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ সচল রাখা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রকল্পগুলো কোনো না কোনো স্থানীয় ইউনিটে অবস্থিত হলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী ও এমপিদের সুপারিশে প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা ছাড়া এমপিদের বিশেষ বরাদ্দ থেকেও ইউনিয়ন পর্যায়ে বরাদ্দ বিভাজন করা হয়। ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জেলা পর্যায়ে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (ডিআরও) এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রয়েছেন। একটি উপজেলায় জরিপ করে দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত কাবিখা ও টিআরের ডিও কেনার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই সিন্ডিকেটেরও পরিবর্তন ঘটে। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের অনুগ্রহ ছাড়া বরাদ্দ পাওয়া যায় না, সে কারণে বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কম দামে ব্যবসায়ীদের কাছে খাদ্য বিক্রি করতে বাধ্য থাকেন। আবার বরাদ্দকৃত মালের একটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দিতে হয়। ধরা যাক, একটি প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য দুই মেট্রিক টন খাদ্যশস্য (চাল) বরাদ্দ দেওয়া হলো। বাজারদর অনুযায়ী খাদ্যশস্যের দাম ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাতে এই অর্থের কিছু অংশ দেওয়ার কারণে প্রাক্কলন (এস্টিমেট) অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হতে হয়। ফলে এই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। যদিও মাস্টাররোল সমন্বয়ের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দেখানো হয়।

তিন.
একটি ইউনিয়নের ২০১০-১১ অর্থবছরের ত্রাণ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কাবিখা, টিআর ও ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি খাতে মোট ২০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ৪০ শতাংশ কাজও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্থানীয় ইউনিটগুলো একক কর্তৃপক্ষ না হওয়ায় ওই দুর্নীতির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে দায়ী করা মোটেই সমীচীন হবে না। সে জন্য দুই ধরনের সরকারব্যবস্থার অধীনে (কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার) প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে স্বশাসন দিয়ে সব স্থানীয় কাজ এসব ইউনিটের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে কোন রাস্তা বা প্রতিষ্ঠানটি সংস্কারযোগ্য, কোনটি নয় কিংবা ভুয়া প্রতিষ্ঠান তা স্থানীয় জনগণই বাছাই করতে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হলে স্থানীয় ইউনিটগুলোকে এককভাবে দায়ী করা সম্ভব হবে (বর্তমানে কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় একে অন্যকে দায়ী করে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ থাকে)। উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিএলজি (সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্ন্যান্স) দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণবিষয়ক গবেষক আবু তালেব প্রণীত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'র আলোকে প্রস্তুতকৃত স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস অনুযায়ী সরকারব্যবস্থা সাজানোর কথা বলে আসছে, যেটিতে থাকবে কেন্দ্রীয় সরকার আর অনেক স্বশাসিত স্থানীয় সরকার, যেমন সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে 'ইউনিয়ন সরকার' আর 'নগর সরকার' এবং সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে 'জেলা সরকার' অথবা 'বিভাগীয় সরকার'। এখানে সংক্ষেপে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন সরকারের কাঠামো ও কার্যক্রম উল্লেখ করা যেতে পারে। ইউনিয়ন প্রশাসন, ইউনিয়ন সংসদ ও ইউনিয়ন আদালত মিলে ইউনিয়ন সরকার গঠিত হবে। ইউনিয়নের মেম্বাররা ইউনিয়ন সংসদের সদস্য হবেন। চেয়ারম্যান নির্বাহী বিভাগের প্রধান হবেন। ইউনিয়ন আদালত পৃথকভাবে নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। ইউনিয়ন সরকারের বাইরে একটি নির্বাচনিক বোর্ড ও একজন ইউনিয়ন ন্যায়পাল থাকবেন। তা ছাড়া এই ইউনিয়ন প্রশাসন ও সংসদে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন চাওয়া হয়েছে। নগর সংসদে ইউনিয়নকেন্দ্রিক যাবতীয় উন্নয়নকাজ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। ইউনিয়ন সংসদে পাসকৃত প্রস্তাবগুলো ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন। ইউনিয়ন নির্বাহী বিভাগ ও ইউনিয়ন সংসদের কোনো সদস্য বিচারিক বিভাগের সদস্য হবেন না। বর্তমানে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা বিচারিক কাজ করে থাকেন। ইউনিয়ন নির্বাচনিক বোর্ড ইউনিয়ন সরকারের মেয়াদ শেষে নিজ উদ্যোগে নির্বাচনের আয়োজন করবে। ইউনিয়ন ন্যায়পাল ইউনিয়ন সরকারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করবেন। এই ব্যবস্থা গৃহীত হলে জনগণের ট্যাঙ্রে টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হরিলুট বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিচ থেকে ওপরমুখী হওয়ার পাশাপাশি জনগণের মনে প্রকৃত মালিকানাবোধ জাগ্রত হবে। যেহেতু সংবিধানে জনগণকেই দেশের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এই স্বীকৃতি অবশ্যই বাস্তবে প্রতিফলিত হতে হবে।

লেখকবৃন্দ যথাক্রমে : ডিরেক্টর ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢা.বি., সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং সদস্য, সিডিএলজি।

No comments

Powered by Blogger.