কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-ভোগদুর্ভোগের প্রকার-প্রকৃতি by রণজিৎ বিশ্বাস

মানুষের ভোগদুর্ভোগের প্রকার-প্রকৃতি বলুন। মানুষের ভোগদুর্ভোগ ও দুর্দশার প্রকার-প্রকৃতি অজস্র রকম ও রকম রকম এবং কিসিমে কিসিমে আলাদা রকম। যতটা আমি বুঝেছি, এক এক করে বলছি। আপনার মনের সঙ্গে মেলে কি না দেখুন। বলুন, দেখি মেলে কি না। তবে আপনার স্বভাবমতো কথাকে জটিল করবেন না।


এক ধরনের দুর্ভোগ আছে, যখন শত্রু হাসে মিত্র কাঁদে; আরেক ধরনের দুর্ভোগ আছে, মানুষ যখন দুর্দশাগ্রস্তকে দেখে উল্লসিত হয়; তৃতীয় এক ধরনের দুর্ভোগ আছে, যখন ভোক্তাকে দেখে মানুষ ভাবে যা হচ্ছে ঠিকই তো হচ্ছে, এর চেয়ে ভালো এই লোকের প্রাপ্য আর কীই বা হতে পারে! আরেক ধরনের দুর্ভোগ আছে, ভোক্তাকে দেখে মানুষ ভাবে_এই ভোগভোগান্তি ওর জন্য কিছু নয়, ওর আরো ভোগা উচিত ছিল।
লাজ-শরমের প্রকার-প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে?
আছে। লাজ-শরমের সঙ্গে কাটা কানের তুলনাটি বড় চমৎকার।
বোঝা খুব কঠিন হবে মনে হচ্ছে। যার এক কান কাটা, মনে করুন বাঁ কান, সে হাঁটে রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে, যে লোকের ডান কান কাটা সে হাঁটে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে, যার দুই কান কাটা সে হাঁটে রাস্তার মাঝ বরাবর।
বহু চর্চিত কিছু আজকাল দেখছি, মানুষ মানছে না।
যেমন?
যেমন_'ভালো কথা অল্পই ভালো, নইলে তা ভিড়ের ঠেলায় মাঝারি হয়ে যায়' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), যেমন_'দশবার বললে একটি মিথ্যা সত্যে পরিণত হয়।' (গোয়েবলস)।
না মানার কারণ আছে। কারণ কিছু কিছু ভালো জিনিস এখন বারবার বলতে হচ্ছে। যেমন_রাজাকার-আলবদর-আলশামস, ধর্মান্ধ মানুষ, ধর্ম ব্যবসায়ী, সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িক এবং তালেগোলে মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধীরা, জন্মপরিচয়ের কারণে মানুষকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চনাকারীরা মানুষ নয়, তারা মানবেতর প্রণীত নয়, তারা পাশবেতর, তারা কীটানুকীট। আপনি নিজেই বলুন, এই কথাটি মানবার মতো কি না।
মানবার মতো।
এই কথাটি সত্য কি না?
সত্য।
তাহলে কথাটি বার দুইবার বলে ছেড়ে দিলে হবে? কথাটি মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য ও তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত এবং শ্রদ্ধাশীল করার জন্য সত্য ও সত্যাতিসত্য এই কথাটি বারবার বলতে হবে না? এ ধরনের কথা কি কখনো ভিড়ের ঠেলায় মাঝারি হবে? বাকি রইল গোয়েবলসের কথা। একটি মিথ্যাকে দশবার বলে সত্যে পরিণত করার কথা।
এটি যে হয় না, সত্য যে সব সময় সত্যই থাকে, সত্যের মাছের টুকরোকে যে শাকের বোঝায় ঢাকা যায় না, তার এক জাজ্বল্যমান প্রমাণ তো আমাদের সমাজ। এই সমাজই তো শত গোয়েবলসের প্রচারণার মুখে হাতের সবচেয়ে খর্ব ও স্থূল আঙুলটি দেখিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে_পাঠকর্মকে কখনো ঘোষণা হিসেবে চালানো যাবে না। বুঝিয়ে দিয়েছে, চোখের আঠাপর্দা যাদের নেই, তারা চালানোর চেষ্টা করে নিজেদের হাস্যকরই শুধু করে তুলতে পারে, সফল হতে পারে না, নিজেদের ভূমিকাকে তারা শুধু কৌতুককরই করে তুলতে পারে।
নিজেদের ভূমিকা ও আচরণকে যারা হাস্যকর করে তোলে তাদের সব আচরণই কি ক্ষুব্ধ করে?
সব আচরণ একই রকম ক্ষুব্ধ করে না।
কিছু কিছু আছে সাধারণভাবে ক্ষুব্ধ করে, কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ করে।
তাদের কোন আচরণ সম্প্রতি আপনাকে খুব বেশি বিক্ষুব্ধ করেছে?
দেশের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থটি ওরা বড় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর হেলা-অবহেলা করার ঘোষণা দিয়েছে। জিনিসপত্র ও বিশ্বাস-আদর্শ ইত্যাদিকে হেলা-অবহেলা করা যায়। কখনো কখনো তা করা উচিতও। যেমন_আমরা মৌলবাদ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদিকে হেলা-অবহেলাই শুধু করি না, ঘৃণাও করি, প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করি। ছুড়ে ফেলার বিষয়টিও আমরা করি এবং তার সঙ্গে আমাদের পরিচিতিও আছে। যেমন_মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুসংস্কার, একনায়কত্ব, স্বৈরতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের জগদ্দল পাথর হেলায়-অবহেলায়, ঘৃণায় বিবমিষায় ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে আমরা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করেছি; তাই বলে কোনো পবিত্র গ্রন্থকে তো হেলায়-অবহেলায় কোথাও ছুড়ে ফেলার দুঃসাহস দেখাতে পারি না। অথবা অশিক্ষিত কিংবা ঊনশিক্ষিত কেউ তা দেখিয়ে ফেললে নির্বোধের মতো আমরা হাততালি দিতে পারি না। এই কথাগুলো সবাই বুঝতে পারে না। সবাইকে তা বুঝতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.