ঋণভিত্তিক পশ্চিমা জীবন ও বাংলাদেশ-অর্থনীতি by আবু এনএম ওয়াহিদ
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে উন্নয়ন অর্থনীতিতে পড়েছিলাম ডবিল্গউ ডবিল্গউ রস্টোর গ্রোথ থিওরি। রস্টো বলেছেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পাঁচটি ধাপ আছে। যেমন_ প্রিমিটিভ স্টেজ (আদিম স্তর), প্রিকন্ডিশন ফর টেক অফ (উড্ডয়নের পূর্বাবস্থা), টেক অফ (উড্ডয়ন), ড্রাইভ টুয়ার্ড ম্যাচিউরিটি (পরিপূর্ণতার দিকে যাত্রা) এবং দি এজ অব হাই ম্যাস কন্জাম্পশন (ভোগবিলাসের রমরমা অবস্থা)।
রস্টোর থিওরি অনুযায়ী আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের কিছু দেশ বর্তমানে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার শেষ স্তরে এসে ভোগবিলাসে জীবনযাপন করছে। এই ভোগবিলাসের মধ্যেই এসব দেশে আরেকটা কথা বেশ চালু আছে, 'একজন মানুষ যখন জন্মায় তখন তার মাতা-পিতা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেন ক্রেডিট কার্ড দিয়ে এবং যখন সে মারা যায় তখন তার ওয়ারিশরা দাফনকাফন বা ফিউনার্যাল খরচের জন্য চার্জ করেন আবার সেই ক্রেডিট কার্ড।' অন্যভাবে বলতে গেলে এসব দেশের মানুষ জন্মায় ঋণের মধ্যে, সারাজীবন ঋণ করে দেদার ঘি খায় এবং যখন পরপারের ডাক পড়ে তখন ঋণ করেই কবরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
অর্থাৎ এ দেশে নগদানগদ কারবার খুব একটা হয় না। ছেলেমেয়েরা চাকরি-বাকরি এবং রুজি-রোজগার শুরু করার আগে থেকেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলেজ এমনকি হাইস্কুল পড়ূয়া শিক্ষার্থীর ওয়ালেটে বা পার্সে একাধিক স্টোর ও মেজর ক্রেডিট কার্ডের ছড়াছড়ি দেখা যায়। মেজর ক্রেডিট কার্ড বলতে বোঝায়_ ভিসা, মাস্টার কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস এবং ডিস্কভার। এ ছাড়া প্রতিটি বড় স্টোরের রয়েছে নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সুবিধা হলো সবসময় ওয়ালেটে নগদ টাকা রাখতে হয় না। যখন-তখন যে কোনো স্টোরে গিয়ে ইচ্ছামতো কেনাকাটা করতে হলে পকেটে টাকা আছে কি-না এই চিন্তার দরকার পড়ে না। সরেজমিনে স্টোর কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প আছে_ যেমন নগদ কিংবা চেক ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অনলাইন অথবা টেলিফোন কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডের কোনো বিকল্প নেই। এখানে ক্রেডিট কার্ড ক্রেতা-বিক্রেতা দু'পক্ষের জন্যই সমানভাবে উপযোগী এবং আবশ্যক।
ক্রেডিট কার্ডের আরেকটা লুকানো কিংবা অন্তর্নিহিত সুবিধা আছে, যেটা কার্ড ব্যবহারকারী সবসময় বুঝে উঠতে পারে না এবং এই সুবিধা কার্ড ব্যবহারকারীর জন্য ইতিবাচক নয় বরং নেতিবাচক। বিক্রেতা এবং যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাডটি ইস্যু করে এখানে তাদের একচেটিয়া সুবিধা। ওয়ালেটে ক্রেডিট কার্ডের উপস্থিতি তার ব্যবহারকারীকে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় এবং দেখাদেখি খরচ বা কন্পিকিউয়াস কন্জাম্পশনে প্ররোচিত করে থাকে। ক্রেতা-ভোক্তাদের অহেতুক খরচের প্রবণতাকে উস্কে দেয়। এতে বাড়তি সুবিধা হয় বিক্রেতা কোম্পানি বা স্টোরগুলোর এবং ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়িং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। বিক্রেতা স্টোর বা কোম্পানির ব্যবসা, আয় এবং মুনাফা বাড়ে। ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়িং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এবং বাড়তি সুদ আদায়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ক্রেডিট কার্ডের আবিষ্কার ও তাকে দুনিয়াব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে এই মোটিভেশন যে একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ দেশে মানুষের খরচ প্রবণতা বাড়ানোর জন্য আরও নানা ধরনের ফন্দিফিকির আছে। যেমন_ প্রায় প্রতিদিন ডাকযোগে প্রত্যেকের মেইল বক্সে এসে জমা হয় একাধিক ডিসকাউন্ট কুপন। এসব কুপনের উদ্দেশ্য ব্যাংক লোন থেকে শুরু করে গাড়ির অয়েল চেঞ্জ, ঘরের পল্গাম্বিং, মাথার চুল ও বাগানের ঘাস কাটা, টয়লেট পেপার, জুতা-স্যান্ডেল, কাপড়চোপড় এবং যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়া। এগুলো মানুষের যা প্রয়োজন তা কিনতে এবং যার কোনো প্রয়োজন নেই তাও কিনতে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে। এসব কুপনের ফাঁদে পড়ে মাঝে মধ্যে এমন জিনিসও আমি কিনেছি যা কোনো দিনই ব্যবহার করিনি বা কাজে লাগাইনি।
এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে চাকচিক্যময় বড় বড় শপিং মল। সেখানে একই ছাদের নিচে সব ধরনের প্রয়োজনীয় এবং শৌখিন জিনিসপত্রের দোকানপাটের সঙ্গে আছে খাওয়াদাওয়ার (ফুড কোর্ট) আয়োজন এবং বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা। অনেক সময় মানুষ ছুটির দিনে সেখানে সপরিবারে বেড়াতে যায়। ক্রেডিট কার্ডের সুবাদে পকেটে টাকা আছে কি-না তা ভুলেও ভাবতে হয় না। তা ছাড়া দোকানের ভেতরে গেলে সবসময় লেগে থাকে বিভিন্ন দ্রব্যের দামের ওপর সেল বা মূল্যছাড়ের ছড়াছড়ি। বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে ১০, ২০, ৫০, ৬০, এমনকি ৮০, ৯০ শতাংশ ডিসকাউন্টেও জিনিস কেনা সম্ভব। এসব কারণে মলে হাঁটাহাঁটি ও ঘোরাঘুরি করার সময় দশটা জিনিস দেখলে একটা কিনতে ইচ্ছা করে। অনেক সময় লোভ সংবরণ করতে না পেরে ক্রেতা-ভোক্তারা দরকারি-বেদরকারি জিনিস কিনে ব্যাগ ভরে বাড়িতে নিয়ে আসেন। মনের অজান্তে সীমিত সম্পদের অপচয় করেন।
ঘরে বসে টেলিভিশন খুললেও পর্দায় অহরহ ভেসে ওঠে হাজারো রকমের রঙবেরঙের বাহারি বিজ্ঞাপন। এগুলোও মানুষকে সর্বদা কিনতে উৎসাহিত করে। এ দেশের সমাজ এবং বাজার ব্যবস্থায় এমন একটা পদ্ধতি গড়ে উঠেছে যাতে মানুষকে প্রতিনিয়ত খরচের জন্য দুই হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। খরচ এবং ভোগের ওপর গড়ে উঠেছে এ দেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। খরচের জন্য মানুষের হাতে টাকা না থাকলেও অসুবিধা নেই। একটা সামান্য চাকরি বা আয়ের ব্যবস্থা থাকলেই হলো। আপনার হাতে ধরিয়ে দেবে একগাদা ক্রেডিট কার্ড। আপনি টাকা ছাড়াই পল্গাস্টিক কার্ড ব্যবহার করে আয়ের এবং সঞ্চয়ের আগেই খরচ করতে থাকুন এবং সারাজীবন সুদে-আসলে আস্তে আস্তে পরিশোধ করতে থাকুন। আপনার কাছে সমাজ এবং বাজার ব্যবস্থার এটাই আবেদন। এভাবে খরচ করতে করতে মাঝে মধ্যে যখন লোকজন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন নূ্যনতম কিস্তিতেও ঋণ পরিশোধ করে সামাল দিতে পারে না, তখন লোকজন দেউলিয়া হয়। যখন এই দেউলিয়াপনা সংক্রামক রোগের মতো সারাদেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন অর্থনীতিতে নেমে আসে বিপর্যয়। আসে ফরক্লোজার, মন্দা, মহামন্দা ইত্যাদি। ঢুস খেয়ে মানুষের হুঁশ হয়। নতুন খরচ কমিয়ে ঋণ শোধ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ব্রেক ইভেনে আসে। এরপর প্রথম থেকে শুরু হয় আবার একই প্রক্রিয়া, একই সাইকেল। এ দেশের অর্থব্যবস্থা চক্রাকারে এভাবেই ঘুরছে যুগ যুগ ধরে। এটা পুঁজিবাদী সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর বিভীষিকা থেকে কারও মুক্তির কোনো উপায় নেই।
ঊনসত্তর দশকের শেষ দিকে প্রথম যখন এ দেশে আসি তখন এশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মার্কিন এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটা প্রধান পার্থক্য বুঝতে পারি। এশীয় সংস্কৃতিতে ক্রেতা-ভোক্তারা প্রথমে আয় করে, এরপর সঞ্চয় করে, এরপর বুঝে-শুনে সাবধানে খরচ করে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মানুষ আয়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো সময় আয়ের আগেই খরচ শুরু করে দেয়। অর্থাৎ তারা সঞ্চয়ের ধাপ লাফ দিয়ে পেরিয়ে আসে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের সাধারণ মানুষ সপ্তাহে পাঁচ দিন গাধার মতো কাজ করে। মাস পুরলে টাকা এসে ব্যাংকে জমা হয়। সারা মাস ইউটিলিটি বিল আর ক্রেডিট কার্ড বিল শোধ করতে সব টাকা চলে যায়। এভাবে টাকা আসে টাকা যায়। কর্মজীবী মানুষ টাকা হাত দিয়ে ছোঁয়া তো দূরের কথা চোখেও দেখে না। এভাবে কলুর বলদের মতো কেটে যায় তাদের জীবন। আজকাল পাশ্চাত্য জগতের এই ঢেউ বাংলাদেশে গিয়ে লাগছে। এ ব্যাপারে যারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে সাবধানে পা ফেলবে তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান। দিনের শেষে তারাই জয়ী হবে।
আবু এনএম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu
অর্থাৎ এ দেশে নগদানগদ কারবার খুব একটা হয় না। ছেলেমেয়েরা চাকরি-বাকরি এবং রুজি-রোজগার শুরু করার আগে থেকেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলেজ এমনকি হাইস্কুল পড়ূয়া শিক্ষার্থীর ওয়ালেটে বা পার্সে একাধিক স্টোর ও মেজর ক্রেডিট কার্ডের ছড়াছড়ি দেখা যায়। মেজর ক্রেডিট কার্ড বলতে বোঝায়_ ভিসা, মাস্টার কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস এবং ডিস্কভার। এ ছাড়া প্রতিটি বড় স্টোরের রয়েছে নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সুবিধা হলো সবসময় ওয়ালেটে নগদ টাকা রাখতে হয় না। যখন-তখন যে কোনো স্টোরে গিয়ে ইচ্ছামতো কেনাকাটা করতে হলে পকেটে টাকা আছে কি-না এই চিন্তার দরকার পড়ে না। সরেজমিনে স্টোর কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প আছে_ যেমন নগদ কিংবা চেক ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অনলাইন অথবা টেলিফোন কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডের কোনো বিকল্প নেই। এখানে ক্রেডিট কার্ড ক্রেতা-বিক্রেতা দু'পক্ষের জন্যই সমানভাবে উপযোগী এবং আবশ্যক।
ক্রেডিট কার্ডের আরেকটা লুকানো কিংবা অন্তর্নিহিত সুবিধা আছে, যেটা কার্ড ব্যবহারকারী সবসময় বুঝে উঠতে পারে না এবং এই সুবিধা কার্ড ব্যবহারকারীর জন্য ইতিবাচক নয় বরং নেতিবাচক। বিক্রেতা এবং যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাডটি ইস্যু করে এখানে তাদের একচেটিয়া সুবিধা। ওয়ালেটে ক্রেডিট কার্ডের উপস্থিতি তার ব্যবহারকারীকে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় এবং দেখাদেখি খরচ বা কন্পিকিউয়াস কন্জাম্পশনে প্ররোচিত করে থাকে। ক্রেতা-ভোক্তাদের অহেতুক খরচের প্রবণতাকে উস্কে দেয়। এতে বাড়তি সুবিধা হয় বিক্রেতা কোম্পানি বা স্টোরগুলোর এবং ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়িং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। বিক্রেতা স্টোর বা কোম্পানির ব্যবসা, আয় এবং মুনাফা বাড়ে। ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়িং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এবং বাড়তি সুদ আদায়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ক্রেডিট কার্ডের আবিষ্কার ও তাকে দুনিয়াব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে এই মোটিভেশন যে একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ দেশে মানুষের খরচ প্রবণতা বাড়ানোর জন্য আরও নানা ধরনের ফন্দিফিকির আছে। যেমন_ প্রায় প্রতিদিন ডাকযোগে প্রত্যেকের মেইল বক্সে এসে জমা হয় একাধিক ডিসকাউন্ট কুপন। এসব কুপনের উদ্দেশ্য ব্যাংক লোন থেকে শুরু করে গাড়ির অয়েল চেঞ্জ, ঘরের পল্গাম্বিং, মাথার চুল ও বাগানের ঘাস কাটা, টয়লেট পেপার, জুতা-স্যান্ডেল, কাপড়চোপড় এবং যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়া। এগুলো মানুষের যা প্রয়োজন তা কিনতে এবং যার কোনো প্রয়োজন নেই তাও কিনতে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে। এসব কুপনের ফাঁদে পড়ে মাঝে মধ্যে এমন জিনিসও আমি কিনেছি যা কোনো দিনই ব্যবহার করিনি বা কাজে লাগাইনি।
এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে চাকচিক্যময় বড় বড় শপিং মল। সেখানে একই ছাদের নিচে সব ধরনের প্রয়োজনীয় এবং শৌখিন জিনিসপত্রের দোকানপাটের সঙ্গে আছে খাওয়াদাওয়ার (ফুড কোর্ট) আয়োজন এবং বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা। অনেক সময় মানুষ ছুটির দিনে সেখানে সপরিবারে বেড়াতে যায়। ক্রেডিট কার্ডের সুবাদে পকেটে টাকা আছে কি-না তা ভুলেও ভাবতে হয় না। তা ছাড়া দোকানের ভেতরে গেলে সবসময় লেগে থাকে বিভিন্ন দ্রব্যের দামের ওপর সেল বা মূল্যছাড়ের ছড়াছড়ি। বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে ১০, ২০, ৫০, ৬০, এমনকি ৮০, ৯০ শতাংশ ডিসকাউন্টেও জিনিস কেনা সম্ভব। এসব কারণে মলে হাঁটাহাঁটি ও ঘোরাঘুরি করার সময় দশটা জিনিস দেখলে একটা কিনতে ইচ্ছা করে। অনেক সময় লোভ সংবরণ করতে না পেরে ক্রেতা-ভোক্তারা দরকারি-বেদরকারি জিনিস কিনে ব্যাগ ভরে বাড়িতে নিয়ে আসেন। মনের অজান্তে সীমিত সম্পদের অপচয় করেন।
ঘরে বসে টেলিভিশন খুললেও পর্দায় অহরহ ভেসে ওঠে হাজারো রকমের রঙবেরঙের বাহারি বিজ্ঞাপন। এগুলোও মানুষকে সর্বদা কিনতে উৎসাহিত করে। এ দেশের সমাজ এবং বাজার ব্যবস্থায় এমন একটা পদ্ধতি গড়ে উঠেছে যাতে মানুষকে প্রতিনিয়ত খরচের জন্য দুই হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। খরচ এবং ভোগের ওপর গড়ে উঠেছে এ দেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। খরচের জন্য মানুষের হাতে টাকা না থাকলেও অসুবিধা নেই। একটা সামান্য চাকরি বা আয়ের ব্যবস্থা থাকলেই হলো। আপনার হাতে ধরিয়ে দেবে একগাদা ক্রেডিট কার্ড। আপনি টাকা ছাড়াই পল্গাস্টিক কার্ড ব্যবহার করে আয়ের এবং সঞ্চয়ের আগেই খরচ করতে থাকুন এবং সারাজীবন সুদে-আসলে আস্তে আস্তে পরিশোধ করতে থাকুন। আপনার কাছে সমাজ এবং বাজার ব্যবস্থার এটাই আবেদন। এভাবে খরচ করতে করতে মাঝে মধ্যে যখন লোকজন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন নূ্যনতম কিস্তিতেও ঋণ পরিশোধ করে সামাল দিতে পারে না, তখন লোকজন দেউলিয়া হয়। যখন এই দেউলিয়াপনা সংক্রামক রোগের মতো সারাদেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন অর্থনীতিতে নেমে আসে বিপর্যয়। আসে ফরক্লোজার, মন্দা, মহামন্দা ইত্যাদি। ঢুস খেয়ে মানুষের হুঁশ হয়। নতুন খরচ কমিয়ে ঋণ শোধ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ব্রেক ইভেনে আসে। এরপর প্রথম থেকে শুরু হয় আবার একই প্রক্রিয়া, একই সাইকেল। এ দেশের অর্থব্যবস্থা চক্রাকারে এভাবেই ঘুরছে যুগ যুগ ধরে। এটা পুঁজিবাদী সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর বিভীষিকা থেকে কারও মুক্তির কোনো উপায় নেই।
ঊনসত্তর দশকের শেষ দিকে প্রথম যখন এ দেশে আসি তখন এশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মার্কিন এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটা প্রধান পার্থক্য বুঝতে পারি। এশীয় সংস্কৃতিতে ক্রেতা-ভোক্তারা প্রথমে আয় করে, এরপর সঞ্চয় করে, এরপর বুঝে-শুনে সাবধানে খরচ করে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মানুষ আয়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো সময় আয়ের আগেই খরচ শুরু করে দেয়। অর্থাৎ তারা সঞ্চয়ের ধাপ লাফ দিয়ে পেরিয়ে আসে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের সাধারণ মানুষ সপ্তাহে পাঁচ দিন গাধার মতো কাজ করে। মাস পুরলে টাকা এসে ব্যাংকে জমা হয়। সারা মাস ইউটিলিটি বিল আর ক্রেডিট কার্ড বিল শোধ করতে সব টাকা চলে যায়। এভাবে টাকা আসে টাকা যায়। কর্মজীবী মানুষ টাকা হাত দিয়ে ছোঁয়া তো দূরের কথা চোখেও দেখে না। এভাবে কলুর বলদের মতো কেটে যায় তাদের জীবন। আজকাল পাশ্চাত্য জগতের এই ঢেউ বাংলাদেশে গিয়ে লাগছে। এ ব্যাপারে যারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে সাবধানে পা ফেলবে তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান। দিনের শেষে তারাই জয়ী হবে।
আবু এনএম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu
No comments