পরমাণুশক্তি-ফুকুশিমার গ্রামের মানুষ ও একটি সম্মেলন by তানভীর মোকাম্মেল

গত বছরের মার্চে যখন জাপানের সুনামির অবিশ্বাস্য সব ফুটেজ এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্ন্যুৎপাতি বিস্ফোরণ টেলিভিশনে দেখাচ্ছিল, আরও সবার মতো, গভীর আতঙ্ক নিয়ে ভেবেছি ফুকুশিমার মানুষের কী হলো! তাই যখন ফুকুশিমায় যাওয়ার এবং ওখানকার মানুষের সহমর্মিতা জানানোর একটা সুযোগ এল, তখন ব্যাগ গোছাতে মুহূর্তমাত্র দেরি করিনি।


ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করল মানুষের শক্তির সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃতির রুদ্ররূপের কাছে মানুষের অসহায়ত্ব। আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল আমাদের বর্তমান সভ্যতার অন্যতম আরেক অভিশাপকে—করপোরেট লোভ। হিটাচি ও মিতসুবিশি জাপানের দুই বড় কোম্পানি ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অনেক অনেক লাভবান হয়েছে, কিন্তু ফুকুশিমাবাসীর জীবনে যেদিন মহাপ্রলয় নেমে এল, সেদিন থেকে তাদের আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি! পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনা পৃথিবীতে আগেও ঘটেছে—রাশিয়ার চেরনোবিলে, আমেরিকার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে। কিন্তু হিরোশিমা ও নাগাসাকির জাপানেই যখন আবার কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে, তখন তা মেরুদণ্ড শিরশির করা এক দে জা ভ্যু-র অনুভূতি দিতে বাধ্য!
ফুকুশিমা ও চারপাশের অঞ্চলে আমাদের সফরটা ছিল দুই দিনের। ওখানে গিয়ে সবকিছু দেখেশুনে মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে গেল। প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলি—
‘আগুন বাতাস জল, আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে
তোমাকে দিল রূপ—
কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিল তারা।’
ফুকুশিমা এখন সে রকম এক অভিশপ্ত নির্জন জায়গায় পরিণত হয়েছে, যেখানে মায়ের দুধ ও শিশুদের মূত্রেও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন স্থানীয় কৃষক, জনপ্রতিনিধি, গৃহবধূ থেকে শুরু করে গ্রামের অনেক মানুষ। তাঁরা অনুযোগ করলেন, দুর্গত মানুষকে ওই অঞ্চল থেকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াতেই ছিল এক অমানবিক ছাপ। ফুকুশিমার এক কবি ওয়াকামাৎসু জোতারু আমাদের সঙ্গে দেখা করে এ ঘটনা নিয়ে তাঁর লেখা একটি কবিতা শোনালেন—
‘দু ঘণ্টা সময়ের মাঝে
হারিয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ হাজার মানুষ
ফুটবল খেলা শেষে দলবদ্ধ দর্শকের মতো তারা যায়নি, তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হলো
শিকড়সুদ্ধ, তাদের জন্মমাটি থেকে!’
শুধু মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গৃহপালিত পশুপ্রাণীও। মেরে ফেলা হয়েছে তেজস্ক্রিয়ার দূষণে আক্রান্ত অসংখ্য গরু ও অন্যান্য পশু।
এরপর আমরা গেলাম মিনামিসোমা নামের আরেক জায়গায়, পারমাণবিক দুর্ঘটনায় যে অঞ্চলটিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এখানে ২০ কিলোমিটার একটা জায়গা ‘অতি বিপজ্জনক’ চিহ্নিত করে আলাদা করে রাখা হয়েছে, যেখানে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয় না।
‘হিবাকুশি’ জাপানে এক অভিশপ্ত অসুখের নাম। হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার শিকার অনেক মানুষের শরীরেই এ রোগ দেখা যায়। ফুকুশিমা ও মিনামিসোমাতে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত এই রোগে আক্রান্ত কিছু মানুষ আজ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেরই দেখলাম, রাষ্ট্রশক্তি ও পারমাণবিক করপোরেট শক্তির মধ্যে যে অশুভ আঁতাত, জাপানে গড়ে উঠেছিল তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। উভয় এলাকার মানুষেরই দাবি দেখলাম, ‘টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি’ (টেপকো), যে কোম্পানিটি ফুকুশিমার বিদ্যুতের প্রধান ভোক্তা এবং জাপান সরকার যেন এই বিস্ফোরণসংক্রান্ত সব তথ্য জনসাধারণকে সম্পূর্ণভাবে জানায়। জনগণ বুঝতে পারছে বিদ্যুতের অজুহাতে কোম্পানিগুলো যা চেয়েছে, তা সব সময় জনগণের কল্যাণ ততটা নয়, নিজেদের মুনাফাটাকে বাড়ানো। উভয় অঞ্চলেরই ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের এখন দাবি যে তাঁরা আবার তাঁদের নিজ নিজ গ্রাম ও শহরে ফিরে গিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক জীবন চালাতে চান এবং এ ব্যাপারে তাঁরা দেখলাম বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এরপর আমরা গেলাম ইয়োকোহামা শহরে। ওখানে ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি পরমাণু শক্তিবিরোধী এক সম্মেলন হলো। সারা পৃথিবী থেকে শ-খানেক শিল্পী-সাহিত্যিক-গবেষক-অধ্যাপক এসেছিলেন, এসেছিলেন নানা ধরনের শান্তিকর্মী ও শান্তি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আর এসেছিলেন প্রায় ১০ হাজার জাপানি নারী-পুরুষ। এক বিশাল হলভরা দর্শকের মধ্যে আমাকেও বক্তৃতা করতে হলো। আমাদের দক্ষিণ এশিয়া যে পারমাণবিক বিপদের ঝুঁকিমুক্ত নয়, সে কথা বললাম। পরে সম্মেলন থেকে একটা ঘোষণাপত্রও তৈরি করা হলো। সবারই একই কথা, বিশ্বকে সব রকম পরমাণু অস্ত্র ও পরমাণু শক্তি থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
মানুষের মেধা অনেক মহৎ ও কার্যকর জিনিস সৃষ্টি করেছে, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি নিঃসন্দেহে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর। পারমাণবিক শক্তি আসলেই এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, যা মানুষের সৃষ্ট হলেও মানুষের চেয়ে যেন বেশি শক্তিধর! ফুকুশিমার দুঃখজনক ঘটনা আবারও যেন মনে করাল যে আমরা ইতিহাস থেকে কিছুই শিখি না! এটা চরম একটা মিথ্যা যে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র নিরাপদ। এটা কখনোই নিরাপদ ছিল না এবং সরকারি বা কোম্পানিগুলোর বেতনভুক্ত ‘বিশেষজ্ঞরা’(!) যতই বলুন, আদৌ নিরাপদ নয়।
এটা দুঃখজনক যে বাংলাদেশ সরকার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির লক্ষ্যে রুশদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছে। রূপপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের যে অঞ্চলে, তা খুবই ঘনবসতির এক এলাকা। চারদিকে তিন ফসলি উর্বর সব কৃষিজমি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আরও বিপদ, পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য যে লাখ লাখ গ্যালন পানি লাগে, তা নেওয়া হবে পদ্মা নদী থেকে। এখন বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নদীপ্রবাহ পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল। পদ্মার পানি দূষিত হলে গোটা দক্ষিণবঙ্গের কৃষি ও পরিবেশের জন্য তা মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে।
এটা আমরা বুঝি যে আমাদের তেল নেই ও জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা সামান্য। প্রাকৃতিক গ্যাস কিছু ছিল বটে, কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও অতিব্যবহারের ফলে তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। অপরদিকে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অসীম। ফলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টি এসেছে। কিন্তু দেখতে হবে, একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমরা যেন আরও বড় একটা সমস্যার গুহায় ঢুকে না পড়ি! তা ছাড়া বাংলাদেশে সাধারণভাবে নিরাপত্তাচেতনা কম। প্রতিবার যখন কোনো পোশাক কারখানায় আগুন লাগে, অনিবার্যভাবে দেখা যায় গেট তালাবদ্ধ এবং দারোয়ান চাবি নিয়ে অন্য কোথাও! এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নারীশ্রমিক এ ধরনের তালাবদ্ধ কারখানায় আগুনে পুড়ে বা সিঁড়িতে পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। সে রকম এক দেশে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের মতো একটা দানবের হাত থেকে আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
তা ছাড়া আমাদের দেশে অত বিশাল আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেমন প্রয়োজন কি আছে যে আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগবেই? কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে গ্রামে। ফলে কেন্দ্রায়িত কোনো সুবিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আমাদের প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা ৬৪ হাজার গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। ফলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কিছু নয়।
তবে কেবল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এই উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অঘোষিত পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে, তাতেও আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বৈকি! কারণ, তেমন কিছু ঘটলে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের মানুষই পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ার হাত থেকে নিরাপদ থাকবে না। পাকিস্তান নিয়ে দুশ্চিন্তাটা আরও বেশি; কারণ, পারমাণবিক বোতামকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার ব্যাপারে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে সে দেশে। আর তা ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতার খুব কাছাকাছি অবস্থানেই আছে ধর্মান্ধ উগ্র সব মৌলবাদী শক্তি, যারা মানবজীবনের কোনো তোয়াক্কাই করে না!
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাওয়ার বিকল্প সে ক্ষেত্রে কী? মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। সূর্যের আলো, বায়ুশক্তি ও সাগরের জলের কাছে আমাদের যেতে হবে শক্তির উৎসের সন্ধানে; কৃত্রিমভাবে তৈরি পারমাণবিক কোনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের কাছে নয়। ফুকুশিমা থেকে বাসে চেপে ফিরতে ফিরতে বিরান কৃষিমাঠগুলো দেখার সময় জীবনানন্দেরই কয়েকটি লাইন যেন ঘুরছিল মাথায়—
‘সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন—
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!’
ফুকুশিমায় থাকার সময় সে স্বপ্নের কিছু রূপও কিন্তু দেখেছি। দেখেছি চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও ফুকুশিমার মানুষ কীভাবে আবার তাঁদের জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত। তাঁরা হাল ছেড়ে দেননি। মানুষের মাঝে টিকে থাকার, লড়ে যাওয়ার যে অদম্য এক প্রাণশক্তি রয়েছে এবং সে শক্তি যে প্রকৃতির বিপর্যয়, করপোরেট লোভ বা রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য—এসব কিছুর চেয়েও অনেক বড়, তার পরিচয়ও আমি ফুকুশিমাতেই পেয়েছি।
হিরোশিমা, নাগাসাকি, চেরনোবিল—এসব নাম যখন উচ্চারিত হয়, বুকের ভেতর একটা গভীর বিষণ্নতার অনুভূতি কাজ করতে থাকে। ফুকুশিমার ক্ষেত্রে আমার কিন্তু সে রকমটি ঘটেনি। কারণ, ওখানকার মানুষ দেখেছি হার মেনে নেননি। লক্ষ করেছি, শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও ফুকুশিমায় মানুষের অদম্য এক প্রাণশক্তি। মানুষের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার এই যে অকুতোভয় স্পৃহা, তাকে তো সম্মান জানাতেই হয়। ওই যে, হ্যাঁ, জীবনানন্দই বলেছিলেন—
‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়।’
তানভীর মোকাম্মেল: লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা।

No comments

Powered by Blogger.