আপনি যখন সাংবাদিক by জাহিরুল ইসলাম

'মারি হালা। মারি হালা। পুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাই। তোরা মারছ্ না কা?' পুলিশের নির্দেশে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের কিশোর মিলন হত্যাকাণ্ডের এই বর্বর কাহিনী মানুষ জানতে পারে মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে।


পুলিশের সরবরাহকৃত তথ্যমতে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত কিশোর মিলন যে ওইদিন কোম্পানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হওয়া আর পাঁচজন ডাকাতের সঙ্গী ছিল না সেই সত্য প্রকাশ করা সম্ভব হয় ওই ভিডিওচিত্রের বদৌলতে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ওই ভিডিও ফুটেজ প্রচারের পর সবার টনক নড়ে। পুলিশের উপস্থিতিতেও কী নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে তা সবাই অবলোকন করে। শুধু এই ঘটনাই নয়, নাগরিক সাংবাদিকতার বদৌলতে এরকম অনেক লোমহর্ষক অথবা চমকপ্রদ ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত জানতে পারছে বিশ্ববাসী।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের যে তিনটি দেশের স্বৈরাচারকে উৎখাত করা হলো তার পেছনে অনেক অবদান রয়েছে এই নাগরিক সাংবাদিকতার। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের যেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি অথবা যেসব বিষয় তাদের নাগালের বাইরে ছিল, স্থানীয় নাগরিকরাই সেসব ঘটনার বিবরণ স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিও ফুটেজসহ সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে সরবরাহ করেছেন। সেসব প্রকাশও করা হয়েছিল গুরুত্ব সহকারে। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের জন্য এসব ছিল অনুপ্রেরণা। তথ্য আদান-প্রদানে মানুষের এভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশে সফল হয়েছে গণজাগরণ।
বাস্তবিকভাবেই সাংবাদিকতা এখন শুধু আর পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নিতান্ত শখের বশে একজন মানুষের তোলা ছবি, ভিডিওচিত্র কিংবা বিশেষ কোনো খবর সংবাদমাধ্যমগুলোতে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিচ্ছে। বিশ্বের নামি সংবাদমাধ্যমগুলোতেও নাগরিক সাংবাদিকতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন ব্রেকিং নিউজের শেষে লেখা হচ্ছে_ আপনি যদি এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় ওই এলাকায় অবস্থান করে থাকেন, এই ঘটনা সম্পর্কে যদি বাড়তি কিছু জানেন অথবা আপনার কাছে যদি কোনো স্থির কিংবা ভিডিওচিত্র থাকে তাহলে সেটা পাঠিয়ে দিন।
বাংলাদেশেও একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এখন 'আপনিও হতে পারেন সাংবাদিক' শিরোনামে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আহ্বান করা হচ্ছে নাগরিকদের মোবাইল অথবা ক্যামেরায় ধারণ করা সংবাদ মূল্য আছে এ রকম ভিডিওচিত্রের। সংবাদপত্রগুলোও পাঠকের ক্যামেরায় তোলা এক্সক্লুসিভ ছবি ছাপছে। এর পাশাপাশি ব্লগ এবং সামাজিক নেটওয়ার্কের বদৌলতেও নাগরিক সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি ক্রমেই বাড়ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সংবাদ আদান-প্রদান এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। যে কোনো ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ মানুষ জেনে যাচ্ছে সহজেই। কোনো ঘটনা আবার মূলধারার মিডিয়াতে না এলে তা চলে যাচ্ছে বিকল্প মিডিয়ায়।
সাংবাদিকতার সঙ্গে নাগরিক সাংবাদিকতার সম্পর্ক অনেক পুরনো হলেও প্রযুক্তির অভাবে তা এতদিন জনপ্রিয়তা পায়নি। সংবাদমাধ্যমও ছিল অনেকটা একমুখী। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকলেও তা ছিল সীমাবদ্ধ এবং এর পরিধি ছিল অনেক সীমিত। কিন্তু সময় বদলেছে। সংবাদমাধ্যমও এখন অনেক ক্ষেত্রেই টু-ওয়ে পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এখন সংবাদ ছাপা, প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক-পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। মিডিয়া হাউসগুলো ইচ্ছা করলেই যা ইচ্ছা তা-ই করার সুযোগ পাচ্ছে না। আর যারা যা ইচ্ছা তা-ই করছে জনগণ সেটা কীভাবে নিচ্ছে সেটাও আর গোপন থাকছে না। তাই নাগরিক সাংবাদিকতা শুধু সাংবাদিকতার উন্নয়ন নয়, হলুদ সাংবাদিকতা সম্পর্কেও সতর্ক করে দিচ্ছে। সংবাদের মোড়কে পাঠক ও দর্শককে ঠকানোর যে ধারা এতদিন অব্যাহত ছিল সেই সুযোগও তিরোহিত হচ্ছে ক্রমেই।
zahirul.du@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.