চরাচর-চিরঞ্জীব জহির রায়হান by মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
মরে গিয়েও যাঁরা মরেন না বরং হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকেন, এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাঁদের মধ্যে 'হাজার বছর ধরে'র লেখক জহির রায়হান অন্যতম। এই অসামান্য মানুষটি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং মুক্তিকামী মানুষের সহচর। তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক পাস করেন। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সিনেমা, যান্ত্রিক, খাড়ছাড়া ইত্যাদি পত্রিকায়ও কাজ করেন। পেশাজীবনের ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন প্রবাহ পত্রিকায়। অবশ্য এর এক বছর আগে ১৯৫৫ সালেই তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। আর চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন ১৯৫৭ সালে 'জাগো হুয়া সাবেরা' সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৬০ সালে পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম ছবি তৈরি করেন 'কখনো আসেনি'। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমাও তৈরি হয় এই মহান কারিগরের হাতে ১৯৬৪ সালে। সিনেমার নাম ছিল সঙ্গম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির আমতলার সমাবেশে। ভাষা আন্দোলন তাঁর মনে যে ছাপ ফেলে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর তৈরি বিখ্যাত ও অনন্য সিনেমা 'জীবন থেকে নেয়া'য়। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় অবস্থান নেন। তাঁর নির্মিত জীবন থেকে নেয়া ছবির তখন বেশ কয়টি মহড়া হয় কলকাতায়। যা দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋতি্বক ঘটক। পাকিস্তান আমলে তাঁর 'কখনো আসেনি', 'বাহানা' প্রভৃতি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রও বহুল প্রশংসিত। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র 'স্টপ জেনোসাইড' ও 'নন্দিত তথ্যচিত্র'। নিদারুণ অর্থকষ্টে থাকা সত্ত্বেও জহির রায়হান মহড়া থেকে আসা সব টাকা দিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকায় ফেরেন। স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে আলবদর বাহিনীর হাতে বন্দি ও নিখোঁজ হন তাঁর ভাই শহীদুল্লা কায়সার। নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে বের হন তিনি ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মিরপুরের দিকে। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। মিরপুর ছিল মূল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে বিহারি-অধ্যুষিত এলাকা। তখন এমন তথ্য পাওয়া গেছে যে বিহারিদের সঙ্গে ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে জহির রায়হানকে হত্যা করে। তিনি দুবার সংসার পাতেন। প্রথমবার চলচ্চিত্র নায়িকা সুমিতা দেবীর সঙ্গে। এই ঘরে তাঁর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। এই দুজনই এখন প্রখ্যাত নাট্যনির্মাতা। পরে তিনি সংসার পাতেন আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচন্দার সঙ্গে। এই ঘরের কনিষ্ঠ পুত্র তপু রায়হানও সিনেমায় অভিনয় করেন। বাংলাদেশের টিভি নাটকের অন্যতম বিখ্যাত নায়িকা শমী কায়সার তাঁর নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে। জহির রায়হান তাঁর তৈরি করা সব শিল্পের নামকরণে ছিলেন সার্থক। তাঁর সৃষ্টির সুন্দর নামকরণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তাঁর সিনেমা জীবন থেকে নেয়ার কথা। এমন সুন্দর নামকরণ সিনেমা জগতে বড়ই বিরল। তাঁর তৈরি উপন্যাসগুলোতেও এর প্রমাণ মেলে_'শেষ বিকেলের মেয়ে', 'হাজার বছর ধরে', 'আরেক ফাল্গুন', 'বরফ গলা নদী', 'আর কত দিন' ইত্যাদি। সূর্যগ্রহণ দিয়ে যার শুরু, সেই জহির রায়হান আমাদের বাংলাদেশের এমন একজন সূর্য হয়ে আছেন, যে সূর্যে কোনো দিন গ্রহণ লাগার নয়। চির জ্বলন্ত সেই প্রতিভার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
No comments