কল্পকথার গল্প-মোটাতাজাকরণের বিবিধ প্রকল্প by আলী হাবিব

গল্পের দিন শেষ। আগের দিনে গল্প ছাড়া একেবারেই জমত না। আজকাল সব কিছু তো হাতের মুঠোয়। ডিজিটাল দুনিয়ায় গল্প শোনার মতো সময় কোথায়? আগের দিনে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াতে গল্প শোনাতেন মায়েরা। গ্রামে-মহল্লায়-পাড়ায় গল্পদাদুর দেখা পাওয়া যেত। সেই গল্পদাদুদের সংগ্রহে অনেক গল্প থাকত। আজকের দিনে সব কিছু খেয়ে ফেলেছে গেমস ও কমিকস। টিভি পর্দায় ২৪ ঘণ্টা চলছে কার্টুন শো। রামভক্ত হনুমান কিংবা মহাভারতের ভীষ্ম, কাউকেই আর বইয়ের পাতায় খোঁজা হয় না এখন।

টেলিভিশনের পর্দায় কার্টুন ছবি আজকের শিশুদের মন ও মনন_দুই-ই দখল করে রেখেছে। কাজেই বইয়ের পাতায় যেমন গল্প খোঁজা হয় না, তেমনি আগের মতো গল্পের আসরও হয়তো বসে না। হয়তো বসে, আমরা জানি না। জানার চেষ্টাই বা করি কজন? আজ বোধ হয় কেবল বইয়ের পাতায় আষাঢ়ে গল্পের খোঁজ পাওয়া যাবে। আষাঢ়ে গল্পের আসর কী আর বসে আজকাল? গ্রামের লোকেরও কি আগের মতো সময় আছে? আষাঢ় গেছে, পেরিয়ে যাচ্ছে মধ্য শ্রাবণ। বৃষ্টিহীন দিনযাপন আমাদের। তবু গল্প হোক।
দুই পালোয়ানের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। এক গ্রামে ছিল নাকি এক পালোয়ান। বিশালদেহী সেই পালোয়ানের ওজন ছিল ২২ মণ। তাঁর আসল নাম যে কী, সেটা কারো জানা নেই। সবাই তাকে জানত 'বাইশ মণ' পালোয়ান হিসেবে। আশপাশের গ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। ওই গ্রাম থেকে কয়েক গ্রাম দূরে আরেক গ্রামে ছিল আরেক পালোয়ানের বাস। তাঁর ওজন ছিল ২৩ মণ। সেই পালোয়ানের নাম 'তেইশ মণ' পালোয়ান। এই পালোয়ানদের সবার আবার একটা নিজস্ব লাইফস্টাইল ছিল। এঁরা বেশ নিশ্চিন্তে ঘুরতেন-ফিরতেন। বছরে এক-আধটা কুস্তির আসরে গিয়ে দু-চারজনকে ধরাশায়ী করে এই পালোয়ানদের বেশ ভালোই দিন কেটে যেত। যাহোক, আমাদের এই বাইশ মণ ও তেইশ মণ পালোয়ানের গল্পে ফিরে আসা যাক। 'তেইশ মণ' পালোয়ানের জানা ছিল না, তাঁর কাছাকাছি আরেক পালোয়ানের বাস। 'বাইশ মণ' পালোয়ানের কথা লোক মারফত শুনে আমাদের এই 'তেইশ মণ' পালোয়ানের মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। প্রশ্ন উঠতে পারে, 'বাইশ মণ' পালোয়ানের খবর 'তেইশ মণ' পালোয়ানের অজানা থাকল কেন? সে আমলে তো আর যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। আজকের দিনের মতো টিভি, এফএম রেডিও, ইন্টারনেট, ই-মেইল ছিল না। ফলে মানুষের দেওয়া তথ্যের ওপরই নির্ভর করতে হতো। 'বাইশ মণ' পালোয়ানের খবর নিতে একদিন সকালে 'তেইশ মণ' পালোয়ান সেই গ্রামে গিয়ে হাজির। কিন্তু মন্দ কপাল তাঁর, 'বাইশ মণ' সেদিন কোথায় লড়াই করতে যাওয়ায় তাঁদের দেখা হলো না। তবে দেখা হলো একদিন। দুজনের মধ্যে কে সেরা বা শক্তিশালী সেটা প্রমাণ করার জন্য মল্লযুদ্ধের আয়োজন করা হলো। এই দুই পালোয়ান যখন যুদ্ধে রত, তখন সেখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এক ক্ষুধার্ত ঈগল। সেই ঈগল ছোঁ মেরে দুই পালোয়ানকে তুলে নিল। উড়ে চলল। ঈগল ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে, কিন্তু দুই পালোয়ানের মল্লযুদ্ধের বিরাম নেই। ঈগল দেখল, মহাহাঙ্গামা। কোথায় একটু আরাম করে আহার করবে, উল্টো ওদের মারামারিতে ওড়াই কষ্টের ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। সে তখন দুই পালোয়ানকেই ছেড়ে দিল। ঈগলটা ওই সময় উড়ে যাচ্ছিল এক রাজবাড়ির ওপর দিয়ে। আর রাজবাড়ির ছাদে ওই সময় বৈকালিক বিহার করছিলেন রাজকুমারী। হঠাৎ রাজকুমারী 'চোখ গেল' বলে বসে পড়লেন। কী হলো? রাজকুমারীর চোখে কিছু একটা পড়েছে। কী পড়েছে? ডাকা হলো রাজবৈদ্য। তিনি এসে রাজকুমারীর চোখ থেকে যুদ্ধরত দুই পালোয়ানকে বের করে আনলেন। গল্পের শেষে প্রশ্ন, কে বড় পালোয়ান?
আজকের ছোট মনে আরো যে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সে প্রশ্নটা হচ্ছে_ওই ২২ কিংবা ২৩ মণ ওজনের পালোয়ানদের ওজন কি এমনিতেই অমন হতো? নাকি তাদের খাইয়েদাইয়ে অমন মোটা ও তাজা করা হতো। কারণ আজকের দিনে সবাই তো মোটাতাজাকরণের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আগে তো গরু মোটাতাজাকরণের অনেক গল্প শোনা যায়। গরুর হাটে মোটাতাজা গরুও দেখতে পাওয়া যায়। গরু মোটাতাজাকরণ এখন বেশ লাভজনক একটি ব্যবসা। এই ব্যবসা করে অনেকে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মোটাতাজা করে ফেলেছেন বলে শোনা যায়। আবার বিপাকেও নাকি পড়েছেন অনেকে।
মানুষের জন্য মোটা হয়ে যাওয়াটা একটা রোগ। এ রোগের প্রধান দাওয়াই হচ্ছে না খাওয়া। কিন্তু একবার যাদের খাওয়া অভ্যাস হয়ে যায়, তাদের মুখ চলতেই থাকে, বন্ধ হয় না। খেতে না পারলে ভালো লাগে না। ভালো লাগে খেতে। ডাক্তারি শাস্ত্রে এর একটা নামও আছে, বুলিমিয়া। আমরা বরং মোটাতাজাকরণ নিয়ে আলোচনা করি। সে আমলের 'বাইশ মণ' বা 'তেইশ মণ' পালোয়ানদের কিন্তু তৈরি করতে হতো। রাজাদের শখ বলে কথা। নিজেদের নাম বাইরে প্রচারের জন্য সে আমলে রাজারা অমন পালোয়ান পুষতেন। পালোয়ানদের মোটাতাজা করতেন। কিন্তু আজকের দিনে কী হচ্ছে?
আমের মৌসুম চলেই গেল প্রায়। এই মাসটা গেলে আর আম পাওয়া যাবে না। তাতে আমজনতার কিছু এসে যায় না। এ মৌসুমেও অনেকের মুখে এক টুকরো আম পড়েনি। এ দুর্ভাগ্যের কথা কে কাকে আর শোনাবে! আমও এখন আর আমজনতার নয়। আমের যা দাম ছিল এবার, তাতে আম কিনতে গিয়ে নিজের দামটাও যাচাই করে নেওয়া গেছে বাজারে। এই যখন অবস্থা, তখনই আবার চমকে ওঠার মতো আরেক খবর। শোনা যাচ্ছে, এবার নাকি আমও মোটাতাজা করা হয়েছে। আমজনতার হাত ফসকে বেরিয়ে গিয়ে আমও কি না মোটাতাজা হয়ে গেল!
না, মোটাতাজাকরণের এটা তো আর শেষ কথা নয়। মোটাতাজাকরণ আগেও ছিল। এখনো আছে। রাজরাজড়ার কৃপায় সে আমলেও যেমন মোটাতাজা প্রকল্প ছিল, এখনো আছে। এখনকার মোটাতাজাকরণের মানুষগুলো হয়তো মল্লযুদ্ধ করে না, কিন্তু নিজেদের মোটাতাজা করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। এই মোটাতাজা করার পেছনে নানা কারণ থাকে। নিজেদের কর্ম ও অপকর্মের ভাগ দেওয়া শুধু নয়, নিজেদের একটা তালেবে এলেম গোষ্ঠী তৈরি করতেও এই মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের জুড়ি নেই। বাংলাদেশে মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের শুরু অনেক আগে থেকেই। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। মোটাতাজাকরণ প্রকল্প চলে আসছে।
মোটাতাজাকরণের বড় উপকারিতা হচ্ছে, মোটাতাজারা পাশে পাশে থাকে। সময়মতো পা চাটে। হুকুম দিলে কথা শোনে। কাউকে ডাণ্ডাপেটা করে আসতে বললে দ্বিধা করে না। এভাবে আমাদের সমাজে মোটতাজাকরণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা আজও রয়ে গেছে।
রুপালি পর্দার তন্বী নায়িকারা আজকাল নিজেদের শরীর কমিয়ে জিরো ফিগারে নিয়ে আসছেন। নায়করা সিঙ্ প্যাক থেকে এইট প্যাকে পাকাচ্ছেন পেশি। আর আমাদের সমাজের নীতিনির্ধারকরা ব্যস্ত মোটাতাজাকরণ নিয়ে। মোটাতাজা তালেবে এলেম ছাড়া তাদের চলছে না। মোটাতাজাকরণ প্রকল্পও তাই এখনো টিকে আছে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.