সময়ের প্রতিধ্বনি-হিনা রাব্বানির দিল্লি সফর এবং পাক-ভারত সম্পর্ক by মোস্তফা কামাল
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের দিল্লি সফর সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন এভাবে, 'তাঁর সফরের ফলে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে। আমি খুশি হয়েছি এবং আমাদের রোডম্যাপ অনুযায়ী তাঁর সফরটি ফলপ্রসূ হয়েছে।'
দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পাকিস্তানের নবীন এবং প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানির দিল্লি সফরকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে ভারত। বলা যায়, শুরুতেই তিনি চমক দিয়েছেন। উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে বীজ তিনি দিল্লিতে রোপণ করে গেছেন, তা পরিচর্যা করলে সুফল নিশ্চয়ই আসবে। ভারতীয় গণমাধ্যমও হিনা রাব্বানির সফরকে অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে। পাকিস্তান ঠিক এটাই চেয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে যে বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান, তা কাটানোর লক্ষ্যে ভারতীয় মনোভাবের পরিবর্তন আশা করেছিল। কাজেই হিনার জন্য ভারত সফর ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করেছেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
হিনা রাব্বানি খার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন ভারত সফরের ঠিক আগ মুহূর্তে। তাঁকে ২০ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দিল্লি সফর করেন। ২৭ জুলাই তিনি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এর আগে তিনি অল্প সময়ের জন্য আফগানিস্তানে যান। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশেদ মেহমুদ কোরেশির পদত্যাগের পর চলতি বছরের ১৩ ফেব্রয়ারি অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানিকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।
পাঞ্জারের সামন্ত পরিবারের মেয়ে হিনা রাব্বানির বাবা গোলাম নূর রাব্বানি খারও একজন রাজনীতিক ছিলেন। তাঁর চাচা গোলাম মোস্তফা খার ছিলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেন লাহোর ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটিতে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগে (কায়েদে আজম) যোগ দেন। ২০০২ সালে তিনি ওই দলের টিকিটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন এবং দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি ইউসুফ রাজা গিলানি সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
পাকিস্তানে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক প্রচারণার ভয়ে যে নারী নির্বাচনী পোস্টারে নিজের ছবিটি পর্যন্ত ব্যবহার করেননি, সেই নারীই হলেন পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, বিনয়ী ব্যবহারই নয়, তাঁর সৌন্দর্য-রূপলাবণ্য, পোশাক-আশাক, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ নিয়েও ভারতীয় মিডিয়ায় বেশ লেখালেখি হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকার শিরোনাম ছিল, 'ভারতকে মুগ্ধ করলেন তরুণী হিনা'।
তা ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এমনও বলেছেন, 'আপনি যে দেখতে সুন্দরী শুধু সে কারণে নয়, বরং আপনি যে নতুন বৈচিত্র্যময় মাত্রা নিয়ে এসেছেন, সে কারণে ভারতের অর্ধেক মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।'
হিনা রাব্বানিকে নিয়ে ভারতের বিশেষ আগ্রহ দেখে মনে হয়েছে, কংগ্রেস জোট সরকারও পাকিস্তানের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর সম্পর্কের অবসান চেয়েছিল। তারা স্রেফ একটা সুযোগ খুঁজছিল। হিনাকে পাঠিয়ে পাকিস্তান যে নমনীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে, তা রীতিমতো লুফে নিয়েছে ভারত। আসলে উভয় দেশের সরকারই বৈরী সম্পর্কের অবসান চেয়েছে। শুধু একটা শুভ উদ্যোগের অভাব ছিল। আর সেই কাজটিই করে দিয়েছেন হিনা। তিনি সুন্দর চেহারার দম্ভ নয়, বরং বিনয় দিয়ে জয় করলেন ভারতীয়দের মন।
যদিও আমরা সবাই খুব ভালো করেই জানি, ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক এবং আমলারা ব্রিটিশদের কূটনৈতিক চালে ঘুরপাক খাচ্ছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় ব্রিটিশরা সীমানা টানতে গিয়ে কাশ্মীরকে বিরোধপূর্ণ করে রেখেছিল। সেই বিরোধের খেসারত দিতে হচ্ছে উপমহাদেশকে। কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অন্তত তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো সমস্যা তো লেগেই আছে। এখনো পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, ভারত পাকিস্তানের শত্রু। এই ধারণার ফলে পাকিস্তান সরকারও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অতি সতর্কতা অবলম্বন করে। এই অতি সতর্কতার কারণে দুই দেশের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয় না। ফলে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েই চলছে।
এই সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকেই দুই দেশ দারিদ্র্য বিমোচনের মতো কর্মসূচিতে হাত না দিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়েই চলেছে। উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হচ্ছে এবং শক্তি প্রদর্শন করছে। প্রতিরক্ষা ব্যয়-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে ১ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন রুপি (এক লাখ ৬৪ হাজার ৪১৩ কোটি রুপি)। যা আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। ভারত ২০১৬ সাল নাগাদ ১১২ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারতের ৭০ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্রই আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চলতি বছর ১১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে ছয়টি সাবমেরিন কিনেছে। চলতি বছর ২৫০ থেকে ৩০০ অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট কেনার কথা রয়েছে। যার মূল্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এ বছর প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তানের বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ৪৯৫ বিলিয়ন রুপি। এই বাজেট আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি। অথচ উপমহাদেশের উন্নয়নকে কুরে কুরে খাচ্ছে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য। এ অঞ্চলের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে অগ্রসর হতে পারছে না। এখন থেকে প্রতিবছর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে যদি ব্যয় করা হয়; তাহলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দরিদ্র মানুষের কথা চিন্তা করে ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের উচিত, উভয় দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলতেই থাকবে। নিকট অতীতেও আমরা দুই দেশের মধ্যে তা দেখতে পেয়েছি।
সাম্প্রতিককালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দায়ী করে ভারত। আর সেসব হামলার সঙ্গে নাকি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাত রয়েছে। তা ছাড়া ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে বোমা হামলার ঘটনায় ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য কাসাবকে মৃত্যুদণ্ড দেন ভারতের আদালত। এই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতেও পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়ে আসছে ভারত। এ বিষয়টি পাকিস্তানের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে ইতিপূর্বে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছে।
আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান সরকার। ওই ঘটনায় পাকিস্তানের ওপর দিয়ে যেন সুনামি বয়ে যায়। গভীর খাদের কিনারে এসে ঠেকে দেশটি। জঙ্গিবাদ যখন দেশটিকে একেবারে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান।
আসিফ আলী জারদারি সরকার পাকিস্তানের ভাবমূর্তিকে টেনে ধরার প্রক্রিয়া হিসেবে হিনা রাব্বানিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানকে নতুন রূপে উপস্থাপনের একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। সেই চেষ্টার 'ট্রাম কার্ড' হচ্ছেন হিনা। এতে সফল হলে আপাতত বেঁচে যাবে পাকিস্তান। হিনার প্রথম 'পারফরমেন্স' দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানকে নতুন একটা ভাবমূর্তি দিতে পারেন তিনি। তিনি কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করতে পেরেছেন। ভারতের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ।
এ কারণেই ভারত প্রতিবারের মতো এবার নাকি জঙ্গি হামলা এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গ খুব একটা তোলেনি। খুবই ভাসা ভাসাভাবে ইস্যুগুলো তোলা হয়। অর্থাৎ ভারত সরকারও হিনার শান্তি উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখিয়েছে। পুরনো ইস্যুগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। এতে ভারতের ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে। ভারতের এই উপলব্ধি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষত সারাতে সহায়তা করবে বলে মনে করি।
পরিশেষে বলতে চাই, পাকিস্তান যে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে তার জন্য দেশটিকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতার ঘাটতি থাকলে পাকিস্তানকে হোঁচট খেতে হবে। এখন পাকিস্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পাকিস্তান জঙ্গিবাদের ঝাণ্ডা বয়ে বেড়াবে নাকি নতুন পাকিস্তান সৃষ্টি করবে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
হিনা রাব্বানি খার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন ভারত সফরের ঠিক আগ মুহূর্তে। তাঁকে ২০ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দিল্লি সফর করেন। ২৭ জুলাই তিনি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এর আগে তিনি অল্প সময়ের জন্য আফগানিস্তানে যান। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশেদ মেহমুদ কোরেশির পদত্যাগের পর চলতি বছরের ১৩ ফেব্রয়ারি অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানিকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।
পাঞ্জারের সামন্ত পরিবারের মেয়ে হিনা রাব্বানির বাবা গোলাম নূর রাব্বানি খারও একজন রাজনীতিক ছিলেন। তাঁর চাচা গোলাম মোস্তফা খার ছিলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেন লাহোর ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটিতে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগে (কায়েদে আজম) যোগ দেন। ২০০২ সালে তিনি ওই দলের টিকিটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন এবং দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি ইউসুফ রাজা গিলানি সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
পাকিস্তানে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক প্রচারণার ভয়ে যে নারী নির্বাচনী পোস্টারে নিজের ছবিটি পর্যন্ত ব্যবহার করেননি, সেই নারীই হলেন পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, বিনয়ী ব্যবহারই নয়, তাঁর সৌন্দর্য-রূপলাবণ্য, পোশাক-আশাক, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ নিয়েও ভারতীয় মিডিয়ায় বেশ লেখালেখি হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকার শিরোনাম ছিল, 'ভারতকে মুগ্ধ করলেন তরুণী হিনা'।
তা ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এমনও বলেছেন, 'আপনি যে দেখতে সুন্দরী শুধু সে কারণে নয়, বরং আপনি যে নতুন বৈচিত্র্যময় মাত্রা নিয়ে এসেছেন, সে কারণে ভারতের অর্ধেক মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।'
হিনা রাব্বানিকে নিয়ে ভারতের বিশেষ আগ্রহ দেখে মনে হয়েছে, কংগ্রেস জোট সরকারও পাকিস্তানের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর সম্পর্কের অবসান চেয়েছিল। তারা স্রেফ একটা সুযোগ খুঁজছিল। হিনাকে পাঠিয়ে পাকিস্তান যে নমনীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে, তা রীতিমতো লুফে নিয়েছে ভারত। আসলে উভয় দেশের সরকারই বৈরী সম্পর্কের অবসান চেয়েছে। শুধু একটা শুভ উদ্যোগের অভাব ছিল। আর সেই কাজটিই করে দিয়েছেন হিনা। তিনি সুন্দর চেহারার দম্ভ নয়, বরং বিনয় দিয়ে জয় করলেন ভারতীয়দের মন।
যদিও আমরা সবাই খুব ভালো করেই জানি, ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক এবং আমলারা ব্রিটিশদের কূটনৈতিক চালে ঘুরপাক খাচ্ছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় ব্রিটিশরা সীমানা টানতে গিয়ে কাশ্মীরকে বিরোধপূর্ণ করে রেখেছিল। সেই বিরোধের খেসারত দিতে হচ্ছে উপমহাদেশকে। কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অন্তত তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো সমস্যা তো লেগেই আছে। এখনো পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, ভারত পাকিস্তানের শত্রু। এই ধারণার ফলে পাকিস্তান সরকারও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অতি সতর্কতা অবলম্বন করে। এই অতি সতর্কতার কারণে দুই দেশের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয় না। ফলে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েই চলছে।
এই সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকেই দুই দেশ দারিদ্র্য বিমোচনের মতো কর্মসূচিতে হাত না দিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়েই চলেছে। উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হচ্ছে এবং শক্তি প্রদর্শন করছে। প্রতিরক্ষা ব্যয়-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে ১ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন রুপি (এক লাখ ৬৪ হাজার ৪১৩ কোটি রুপি)। যা আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। ভারত ২০১৬ সাল নাগাদ ১১২ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারতের ৭০ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্রই আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চলতি বছর ১১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে ছয়টি সাবমেরিন কিনেছে। চলতি বছর ২৫০ থেকে ৩০০ অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট কেনার কথা রয়েছে। যার মূল্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এ বছর প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তানের বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ৪৯৫ বিলিয়ন রুপি। এই বাজেট আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি। অথচ উপমহাদেশের উন্নয়নকে কুরে কুরে খাচ্ছে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য। এ অঞ্চলের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে অগ্রসর হতে পারছে না। এখন থেকে প্রতিবছর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে যদি ব্যয় করা হয়; তাহলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দরিদ্র মানুষের কথা চিন্তা করে ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের উচিত, উভয় দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলতেই থাকবে। নিকট অতীতেও আমরা দুই দেশের মধ্যে তা দেখতে পেয়েছি।
সাম্প্রতিককালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দায়ী করে ভারত। আর সেসব হামলার সঙ্গে নাকি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাত রয়েছে। তা ছাড়া ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে বোমা হামলার ঘটনায় ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য কাসাবকে মৃত্যুদণ্ড দেন ভারতের আদালত। এই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতেও পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়ে আসছে ভারত। এ বিষয়টি পাকিস্তানের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে ইতিপূর্বে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছে।
আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান সরকার। ওই ঘটনায় পাকিস্তানের ওপর দিয়ে যেন সুনামি বয়ে যায়। গভীর খাদের কিনারে এসে ঠেকে দেশটি। জঙ্গিবাদ যখন দেশটিকে একেবারে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান।
আসিফ আলী জারদারি সরকার পাকিস্তানের ভাবমূর্তিকে টেনে ধরার প্রক্রিয়া হিসেবে হিনা রাব্বানিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানকে নতুন রূপে উপস্থাপনের একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। সেই চেষ্টার 'ট্রাম কার্ড' হচ্ছেন হিনা। এতে সফল হলে আপাতত বেঁচে যাবে পাকিস্তান। হিনার প্রথম 'পারফরমেন্স' দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানকে নতুন একটা ভাবমূর্তি দিতে পারেন তিনি। তিনি কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করতে পেরেছেন। ভারতের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ।
এ কারণেই ভারত প্রতিবারের মতো এবার নাকি জঙ্গি হামলা এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গ খুব একটা তোলেনি। খুবই ভাসা ভাসাভাবে ইস্যুগুলো তোলা হয়। অর্থাৎ ভারত সরকারও হিনার শান্তি উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখিয়েছে। পুরনো ইস্যুগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। এতে ভারতের ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে। ভারতের এই উপলব্ধি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষত সারাতে সহায়তা করবে বলে মনে করি।
পরিশেষে বলতে চাই, পাকিস্তান যে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে তার জন্য দেশটিকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতার ঘাটতি থাকলে পাকিস্তানকে হোঁচট খেতে হবে। এখন পাকিস্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পাকিস্তান জঙ্গিবাদের ঝাণ্ডা বয়ে বেড়াবে নাকি নতুন পাকিস্তান সৃষ্টি করবে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments