নতুন করে সীমান্ত নির্ধারণের পরামর্শ এবং ভারতের কমান্ডো by শাহ আহমদ রেজা
না, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি। ১৯ ডিসেম্বর তার দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ‘অপারগতা’র কারণে সে সফর স্থগিত করা হয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে; নিন্দুকরাও সুযোগ নিতে ছাড়েনি।
অন্যদিকে কথা বাড়তে না বাড়তেই ‘অপারগ’ ভারত তার সক্ষমতার কথা জানান দিয়েছে। বলেছে, জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে শেখ হাসিনাকে বরণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দিল্লি। একই সঙ্গে অন্য একটি সুখবরও শুনিয়েছেন ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। বলেছেন, শুধু ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ নয়, এবার সফরে গেলে শেখ হাসিনাকে ‘ইন্দিরা গান্ধী গোল্ড প্লাক’ও দেয়া হবে। এই ‘গোল্ড প্লাক’ দেবে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি। সুখবরটি পিনাক রঞ্জন নিজে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, মন খারাপ করে ফেলা প্রধানমন্ত্রীর মন ভালো হয়ে গেছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাস জানুয়ারির ১১ তারিখে সত্যিই তিনি দিল্লি সফরে যাচ্ছেন।
এ সবই অবশ্য শুধু ‘জানা’ যাচ্ছে, এর-ওর কাছে ‘শোনা’ যাচ্ছে! এভাবেই ‘জানা’ ও ‘শোনা’ গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকালে বন্দিবিনিময়, অপরাধ দমনে পারস্পরিক আইনি সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত নেই। সবই হচ্ছে ভারতের একার স্বার্থে। ভারত সেই সঙ্গে করিডোরের সুবিধা পাওয়ার চেষ্টাকেও সর্বাত্মক করেছে। অন্যদিকে কথা থাকলেও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুরোধ উপেক্ষিত থাকারই সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর অবশ্য বর্তমান পর্যায়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় নয়। সফরের ঠিক প্রাক্কালে নতুন একটি বিষয়কে ছুড়ে দিয়ে গেছেন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিককে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে হঠাত্ই বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত নতুন করে চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। প্রধান কারণ হিসেবে পিনাক রঞ্জন ছিটমহলের সমস্যা তুলে ধরেছেন। তার হিসাবে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫৫টি এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১০টি ছিটমহল রয়েছে। এগুলোর অধিবাসীরা থাকে এক দেশে কিন্তু চাষাবাদ করার জন্য তাদের অন্য দেশে যাতায়াত করতে হয়। ছিটমহলগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থান একই রকমের এবং ছিটমহলবাসীরা নাকি যে যেখানে আছে সে সেখানেই থাকতে চায়। সুতরাং পিনাক রঞ্জনের মতে, দু’দেশের সীমান্ত এমনভাবে নির্ধারণ করা দরকার যাতে যে ছিটমহল যে দেশের মধ্যে রয়েছে, সেটা সে দেশেরই ভাগে পড়ে। এভাবে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখা হলেই নাকি চিরদিনের জন্য সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! এ ব্যাপারে পিনাক রঞ্জনের কাছে নতুন কিছু তথ্যও জানা গেছে। তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে নাকি দুই প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে দু’বার বৈঠক করেছেন। একবার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে, দ্বিতীয়বার কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে। ফলে আলোচনা এগিয়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে এ আলোচনার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটবে এবং পিনাক রঞ্জনরা ‘সারপ্রাইজ’ দেবেন—বাংলাদেশের জনগণকে একেবারে চমকে দেবেন।
বিষয়টি আসলেও ‘চমকে’ ওঠার মতোই। কারণ প্রথমত, নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার—এমন খবর এই প্রথম শোনা গেল। দ্বিতীয় কারণটি ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা। বিস্তারিত উল্লেখে যাওয়ার পরিবর্তে এখানে একটিমাত্র তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ীকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। কথা ছিল বেরুবাড়ীর বিনিময়ে ভারত তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তর করবে। কিন্তু নিজে বেরুবাড়ীর দখল নিলেও আজ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা দেয়নি। প্রতারণার কৌশল হিসেবে ভারত আইনের মারপ্যাঁচ কষেছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ভারতের লোকসভা এখনও অনুমোদন করেনি। এর ফলে বাংলাদেশের দুই ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করার জন্য ভারতের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তিনবিঘার মধ্য দিয়ে করিডোর দিলেও ভারত ঘড়ি ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশীদের যাতায়াত।
ফারাক্কা বাঁধ চালু করাসহ আরও অনেক ব্যাপারেও ভারত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। বস্তুত পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতি কমিয়ে আনা পর্যন্ত এমন কোনো বিষয়ের উল্লেখ করা যাবে না, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেছে। নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার কথা শুনে ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টিও হয়েছে সে কারণেই। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয়, প্রভাবশালী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে দেশ প্রতারণা করার সাহস দেখিয়েছে, সেই ভারতের কাছে শেখ হাসিনার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাত্ নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে সত্যি তেমন কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশকে নির্ঘাত জটিলতায় পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত তো হতে হবেই। কারণ এমন ভাবনা মোটেই সঠিক নয় যে, ভারত বাংলাদেশের প্রাপ্য ৫৫টি ছিটমহলই ‘ভালোয় ভালোয়’ বুঝিয়ে দেবে। বেরুবাড়ীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বরং ধরে নেয়া যায়, নিজের প্রাপ্য ‘কড়ায়গণ্ডায়’ বুঝে নিলেও বাংলাদেশকে দেয়ার প্রশ্নে ভারত ‘নতুন করে’ প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় নেবে। সেভাবেই ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করবে। প্রয়োজনে বিষয়টিকে তিনবিঘার মতো উচ্চ আদালতে নিয়ে ঝুলিয়ে দেবে। ওদিকে ভারতের লোকসভা তো রয়েছেই!
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের প্রাক্কালে অন্য একটি বিশেষ খবরেও দেশপ্রেমিকদের মধ্যে ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এ খবরের মূলকথা হলো, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাকি মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়, সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নাকি অযোগ্য! এমন এক চিন্তার ভিত্তিতেই ভারত বাংলাদেশে তার কমান্ডো বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই এবং কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক আমার দেশে ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ভারত সরকার সে দেশের ‘সশস্ত্র সীমা বল’ বা এসএসবির অন্তত ৫০ জন কমান্ডোকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কমান্ডোরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের কোনো ভিআইপি বাংলাদেশ সফরে এলে তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও কমান্ডো দলটি নিয়োজিত থাকবে। ভিআইপিরা যেখানে যাবেন, সেখানেই তাদের সঙ্গে থাকবে এসএসবির কমান্ডোরা। কমান্ডোদের ইতোমধ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। এখন চলছে অপেক্ষার পালা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পরই কমান্ডোদের ঢাকায় পাঠানো হবে। অন্য কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রে এভাবে কমান্ডো পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ সম্পর্কে আনন্দবাজার জানিয়েছে, বাংলাদেশের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভারতের আস্থা নেই। তাছাড়া গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকারই জানিয়েছিল, পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ঢাকার দূতাবাসের ওপর হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। বাংলাদেশে তখন তিনজন কথিত লস্কর সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তথ্য নাকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই বাংলাদেশকে দিয়েছিল। অর্থাত্ বাংলাদেশ নিজের নিরাপত্তার জন্য এফবিআইয়ের ওপর নির্ভর করেছে। উল্লেখ্য, এসএসবির কমান্ডোদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেয়েও দুর্ধর্ষ মনে করা হয় এবং এসএসবি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। বিদেশে পরিচালিত গোপন সশস্ত্র মিশনেও ‘র’-এর গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ভারত এসএসবির কমান্ডোদের ব্যবহার করে থাকে।
এখানে কিছু বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, কমান্ডোদের পাঠানোর প্রশ্নে ‘অনুমোদন’ নেয়া হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, বাংলাদেশের নয়। অর্থাত্ বাংলাদেশকে তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। এমন ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়। উদাহরণ হিসেবে সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সফরকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সেবার দীপু মনির সফর শেষে ১১ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে যে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তার কপি গভীর রাত পর্যন্তও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছেনি। ফ্যাক্সযোগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে বিবৃতির কপি পাঠিয়েছিল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও অনুসৃত নিয়ম হলো, এ ধরনের যুক্ত বিবৃতি সংশ্লিষ্ট দুই দেশের রাজধানী থেকে দেশ দুটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একযোগে প্রকাশ করবে। অন্যদিকে দীপু মনির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে নয়াদিল্লি থেকে যুক্ত বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সেকথা যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের এ ঘটনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছিল।
লক্ষণীয় দ্বিতীয় বিষয় হলো, এসএসবির কমান্ডোদের পাঠানোর সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে একই সঙ্গে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিডিআর ও পুলিশ এবং এনএসআই ও ডিজিএফআইসহ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর যোগ্যতা সম্পর্কেও অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাহিনীগুলো এতটাই অযোগ্য, দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যে, তাদের ওপর ভারতীয়দের নিরাপত্তার ব্যাপারে আস্থা রাখা যায় না। এখানেই দেশপ্রেমিকদের মধ্যে আপত্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এমন একটি প্রচারণাকে শক্তিশালী করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও কম ‘রসদ’ জোগানো হয়নি। বিদ্রোহের দোহাই দিয়ে সরকার একদিকে বিডিআরকে তছতছ করে ফেলেছে; অন্যদিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডজন ডজন সেনা অফিসারকে বরখাস্ত করে ও অকালীন অবসরে পাঠিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে ফেলেছে। কিছুসংখ্যক অফিসারকে সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত করার চেষ্টার ফলেও সেনাবাহিনীতে নিরাপত্তাহীনতা প্রবল হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি রয়েছে জঙ্গি সম্পর্কিত বানোয়াট প্রচারণা। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা থেকে জঙ্গিদের নিয়ে কিছুদিন ধরে রীতিমত শোরগোল তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে আজকাল শুধু পাকিস্তানের ‘লস্কর’রা নয়, ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’রাও ধরা পড়ছে! অথচ অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নয়! তাদের কারও নাম নেই ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’দের তালিকায়। চট্টগ্রামে আটক তিন যুবকের ব্যাপারেও প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, তারা সত্যিই পাকিস্তানের ‘লস্কর’! অন্যদিকে এসব কথিত জঙ্গিকে নিয়েই হইচই করা হয়েছে। এমনভাবেই প্রচারণা চালানো হয়েছে যেন বাংলাদেশ ভারতীয় ও পাকিস্তানি জঙ্গি এবং সন্ত্রাসীতে ছেয়ে গেছে! এ ধরনের প্রচারণা চালানোর প্রধান উদ্দেশ্য বিশ্বকে একথাই জানানো যে, বাংলাদেশের বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। বাংলাদেশে তাই অন্য দেশের কমান্ডো ও সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে দেয়া দরকার!
এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে ভারত। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এসএসবির কমান্ডোদের পাঠানোর মতো পরিস্থিতি আসলে সুচিন্তিতভাবেই তৈরি করা হয়েছে। কারণ প্রমাণিত সত্য হলো, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলতে যা বোঝায়, ভারতের তুলনায় তার কিছুই নেই বাংলাদেশে। অন্যদিকে ভারতের সন্ত্রাস পরিস্থিতি এক কথায় ভীতিকর। দেশটির ৬০৮টি জেলার মধ্যে ২৩১টি জেলায় অর্থাত্ দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকাতেই জঙ্গিরা হত্যা-সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ভারতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংখ্যা ২৭০টি। হত্যা-সন্ত্রাসের কারণে ভারতের প্রধান আটটি রাজ্যকে ‘লাল অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেনা ও পুলিশসহ ভারতে ৫৪ হাজার ৯৬৯ জন সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছে। এত বেশি হত্যাকাণ্ডের কথা বিশ্বের কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। অর্থাত্ সন্ত্রাসে ভারত নিজেই যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। সেই ভারতই এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে!
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারও ভারতের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। এখানে অরবিন্দ রাজখোয়া, শশধর চৌধুরী ও চিত্রাবন হাজারিকাসহ উলফা নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তারা সীমান্তে গিয়ে বিএসএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে প্রচারণা চালানো হলেও তাদের মুখ থেকেই জানা গেছে, প্রত্যেককে আসলে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ধরে নিয়ে গেছে ‘সাদা পোশাকধারী’রা। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই না জানার কথা প্রকাশ করায় পরিষ্কার হয়েছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকজনই উলফা নেতাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। বাংলাদেশে যে ‘র’-এর ব্যাপক তত্পরতা রয়েছে, তার বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে। পার্থক্য হলো, এতদিন ‘র’ গোপনে তত্পরতা চালিয়ে এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন-সহযোগিতা পাওয়ায় ‘র’ এখন আর কোনো রাখঢাক রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। পাশাপাশি এসএসবির কমান্ডোরা যদি ঢাকায় এসে যায় এবং ভারতের দূতাবাস ও ভারতীয় ভিআইপিদের নিরাপত্তা বিধানের নামে যদি দেশজুড়ে তত্পরতা চালাতে শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মোটেও অক্ষুণ্ন থাকবে কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
এ সবই অবশ্য শুধু ‘জানা’ যাচ্ছে, এর-ওর কাছে ‘শোনা’ যাচ্ছে! এভাবেই ‘জানা’ ও ‘শোনা’ গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকালে বন্দিবিনিময়, অপরাধ দমনে পারস্পরিক আইনি সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত নেই। সবই হচ্ছে ভারতের একার স্বার্থে। ভারত সেই সঙ্গে করিডোরের সুবিধা পাওয়ার চেষ্টাকেও সর্বাত্মক করেছে। অন্যদিকে কথা থাকলেও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুরোধ উপেক্ষিত থাকারই সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর অবশ্য বর্তমান পর্যায়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় নয়। সফরের ঠিক প্রাক্কালে নতুন একটি বিষয়কে ছুড়ে দিয়ে গেছেন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিককে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে হঠাত্ই বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত নতুন করে চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। প্রধান কারণ হিসেবে পিনাক রঞ্জন ছিটমহলের সমস্যা তুলে ধরেছেন। তার হিসাবে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫৫টি এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১০টি ছিটমহল রয়েছে। এগুলোর অধিবাসীরা থাকে এক দেশে কিন্তু চাষাবাদ করার জন্য তাদের অন্য দেশে যাতায়াত করতে হয়। ছিটমহলগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থান একই রকমের এবং ছিটমহলবাসীরা নাকি যে যেখানে আছে সে সেখানেই থাকতে চায়। সুতরাং পিনাক রঞ্জনের মতে, দু’দেশের সীমান্ত এমনভাবে নির্ধারণ করা দরকার যাতে যে ছিটমহল যে দেশের মধ্যে রয়েছে, সেটা সে দেশেরই ভাগে পড়ে। এভাবে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখা হলেই নাকি চিরদিনের জন্য সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! এ ব্যাপারে পিনাক রঞ্জনের কাছে নতুন কিছু তথ্যও জানা গেছে। তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে নাকি দুই প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে দু’বার বৈঠক করেছেন। একবার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে, দ্বিতীয়বার কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে। ফলে আলোচনা এগিয়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে এ আলোচনার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটবে এবং পিনাক রঞ্জনরা ‘সারপ্রাইজ’ দেবেন—বাংলাদেশের জনগণকে একেবারে চমকে দেবেন।
বিষয়টি আসলেও ‘চমকে’ ওঠার মতোই। কারণ প্রথমত, নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার—এমন খবর এই প্রথম শোনা গেল। দ্বিতীয় কারণটি ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা। বিস্তারিত উল্লেখে যাওয়ার পরিবর্তে এখানে একটিমাত্র তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ীকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। কথা ছিল বেরুবাড়ীর বিনিময়ে ভারত তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তর করবে। কিন্তু নিজে বেরুবাড়ীর দখল নিলেও আজ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা দেয়নি। প্রতারণার কৌশল হিসেবে ভারত আইনের মারপ্যাঁচ কষেছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ভারতের লোকসভা এখনও অনুমোদন করেনি। এর ফলে বাংলাদেশের দুই ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করার জন্য ভারতের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তিনবিঘার মধ্য দিয়ে করিডোর দিলেও ভারত ঘড়ি ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশীদের যাতায়াত।
ফারাক্কা বাঁধ চালু করাসহ আরও অনেক ব্যাপারেও ভারত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। বস্তুত পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতি কমিয়ে আনা পর্যন্ত এমন কোনো বিষয়ের উল্লেখ করা যাবে না, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেছে। নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার কথা শুনে ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টিও হয়েছে সে কারণেই। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয়, প্রভাবশালী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে দেশ প্রতারণা করার সাহস দেখিয়েছে, সেই ভারতের কাছে শেখ হাসিনার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাত্ নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে সত্যি তেমন কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশকে নির্ঘাত জটিলতায় পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত তো হতে হবেই। কারণ এমন ভাবনা মোটেই সঠিক নয় যে, ভারত বাংলাদেশের প্রাপ্য ৫৫টি ছিটমহলই ‘ভালোয় ভালোয়’ বুঝিয়ে দেবে। বেরুবাড়ীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বরং ধরে নেয়া যায়, নিজের প্রাপ্য ‘কড়ায়গণ্ডায়’ বুঝে নিলেও বাংলাদেশকে দেয়ার প্রশ্নে ভারত ‘নতুন করে’ প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় নেবে। সেভাবেই ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করবে। প্রয়োজনে বিষয়টিকে তিনবিঘার মতো উচ্চ আদালতে নিয়ে ঝুলিয়ে দেবে। ওদিকে ভারতের লোকসভা তো রয়েছেই!
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের প্রাক্কালে অন্য একটি বিশেষ খবরেও দেশপ্রেমিকদের মধ্যে ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এ খবরের মূলকথা হলো, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাকি মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়, সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নাকি অযোগ্য! এমন এক চিন্তার ভিত্তিতেই ভারত বাংলাদেশে তার কমান্ডো বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই এবং কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক আমার দেশে ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ভারত সরকার সে দেশের ‘সশস্ত্র সীমা বল’ বা এসএসবির অন্তত ৫০ জন কমান্ডোকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কমান্ডোরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের কোনো ভিআইপি বাংলাদেশ সফরে এলে তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও কমান্ডো দলটি নিয়োজিত থাকবে। ভিআইপিরা যেখানে যাবেন, সেখানেই তাদের সঙ্গে থাকবে এসএসবির কমান্ডোরা। কমান্ডোদের ইতোমধ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। এখন চলছে অপেক্ষার পালা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পরই কমান্ডোদের ঢাকায় পাঠানো হবে। অন্য কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রে এভাবে কমান্ডো পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ সম্পর্কে আনন্দবাজার জানিয়েছে, বাংলাদেশের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভারতের আস্থা নেই। তাছাড়া গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকারই জানিয়েছিল, পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ঢাকার দূতাবাসের ওপর হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। বাংলাদেশে তখন তিনজন কথিত লস্কর সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তথ্য নাকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই বাংলাদেশকে দিয়েছিল। অর্থাত্ বাংলাদেশ নিজের নিরাপত্তার জন্য এফবিআইয়ের ওপর নির্ভর করেছে। উল্লেখ্য, এসএসবির কমান্ডোদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেয়েও দুর্ধর্ষ মনে করা হয় এবং এসএসবি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। বিদেশে পরিচালিত গোপন সশস্ত্র মিশনেও ‘র’-এর গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ভারত এসএসবির কমান্ডোদের ব্যবহার করে থাকে।
এখানে কিছু বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, কমান্ডোদের পাঠানোর প্রশ্নে ‘অনুমোদন’ নেয়া হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, বাংলাদেশের নয়। অর্থাত্ বাংলাদেশকে তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। এমন ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়। উদাহরণ হিসেবে সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সফরকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সেবার দীপু মনির সফর শেষে ১১ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে যে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তার কপি গভীর রাত পর্যন্তও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছেনি। ফ্যাক্সযোগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে বিবৃতির কপি পাঠিয়েছিল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও অনুসৃত নিয়ম হলো, এ ধরনের যুক্ত বিবৃতি সংশ্লিষ্ট দুই দেশের রাজধানী থেকে দেশ দুটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একযোগে প্রকাশ করবে। অন্যদিকে দীপু মনির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে নয়াদিল্লি থেকে যুক্ত বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সেকথা যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের এ ঘটনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছিল।
লক্ষণীয় দ্বিতীয় বিষয় হলো, এসএসবির কমান্ডোদের পাঠানোর সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে একই সঙ্গে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিডিআর ও পুলিশ এবং এনএসআই ও ডিজিএফআইসহ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর যোগ্যতা সম্পর্কেও অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাহিনীগুলো এতটাই অযোগ্য, দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যে, তাদের ওপর ভারতীয়দের নিরাপত্তার ব্যাপারে আস্থা রাখা যায় না। এখানেই দেশপ্রেমিকদের মধ্যে আপত্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এমন একটি প্রচারণাকে শক্তিশালী করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও কম ‘রসদ’ জোগানো হয়নি। বিদ্রোহের দোহাই দিয়ে সরকার একদিকে বিডিআরকে তছতছ করে ফেলেছে; অন্যদিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডজন ডজন সেনা অফিসারকে বরখাস্ত করে ও অকালীন অবসরে পাঠিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে ফেলেছে। কিছুসংখ্যক অফিসারকে সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত করার চেষ্টার ফলেও সেনাবাহিনীতে নিরাপত্তাহীনতা প্রবল হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি রয়েছে জঙ্গি সম্পর্কিত বানোয়াট প্রচারণা। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা থেকে জঙ্গিদের নিয়ে কিছুদিন ধরে রীতিমত শোরগোল তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে আজকাল শুধু পাকিস্তানের ‘লস্কর’রা নয়, ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’রাও ধরা পড়ছে! অথচ অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নয়! তাদের কারও নাম নেই ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’দের তালিকায়। চট্টগ্রামে আটক তিন যুবকের ব্যাপারেও প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, তারা সত্যিই পাকিস্তানের ‘লস্কর’! অন্যদিকে এসব কথিত জঙ্গিকে নিয়েই হইচই করা হয়েছে। এমনভাবেই প্রচারণা চালানো হয়েছে যেন বাংলাদেশ ভারতীয় ও পাকিস্তানি জঙ্গি এবং সন্ত্রাসীতে ছেয়ে গেছে! এ ধরনের প্রচারণা চালানোর প্রধান উদ্দেশ্য বিশ্বকে একথাই জানানো যে, বাংলাদেশের বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। বাংলাদেশে তাই অন্য দেশের কমান্ডো ও সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে দেয়া দরকার!
এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে ভারত। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এসএসবির কমান্ডোদের পাঠানোর মতো পরিস্থিতি আসলে সুচিন্তিতভাবেই তৈরি করা হয়েছে। কারণ প্রমাণিত সত্য হলো, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলতে যা বোঝায়, ভারতের তুলনায় তার কিছুই নেই বাংলাদেশে। অন্যদিকে ভারতের সন্ত্রাস পরিস্থিতি এক কথায় ভীতিকর। দেশটির ৬০৮টি জেলার মধ্যে ২৩১টি জেলায় অর্থাত্ দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকাতেই জঙ্গিরা হত্যা-সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ভারতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংখ্যা ২৭০টি। হত্যা-সন্ত্রাসের কারণে ভারতের প্রধান আটটি রাজ্যকে ‘লাল অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেনা ও পুলিশসহ ভারতে ৫৪ হাজার ৯৬৯ জন সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছে। এত বেশি হত্যাকাণ্ডের কথা বিশ্বের কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। অর্থাত্ সন্ত্রাসে ভারত নিজেই যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। সেই ভারতই এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে!
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারও ভারতের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। এখানে অরবিন্দ রাজখোয়া, শশধর চৌধুরী ও চিত্রাবন হাজারিকাসহ উলফা নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তারা সীমান্তে গিয়ে বিএসএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে প্রচারণা চালানো হলেও তাদের মুখ থেকেই জানা গেছে, প্রত্যেককে আসলে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ধরে নিয়ে গেছে ‘সাদা পোশাকধারী’রা। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই না জানার কথা প্রকাশ করায় পরিষ্কার হয়েছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকজনই উলফা নেতাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। বাংলাদেশে যে ‘র’-এর ব্যাপক তত্পরতা রয়েছে, তার বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে। পার্থক্য হলো, এতদিন ‘র’ গোপনে তত্পরতা চালিয়ে এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন-সহযোগিতা পাওয়ায় ‘র’ এখন আর কোনো রাখঢাক রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। পাশাপাশি এসএসবির কমান্ডোরা যদি ঢাকায় এসে যায় এবং ভারতের দূতাবাস ও ভারতীয় ভিআইপিদের নিরাপত্তা বিধানের নামে যদি দেশজুড়ে তত্পরতা চালাতে শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মোটেও অক্ষুণ্ন থাকবে কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments