সমাজ-বিকৃতি যেভাবে জাতীয় সমস্যা হয়ে ওঠে by আলতাফ পারভেজ

ম্প্র্রতি জয়ধর, অরুণ, মেহেদী হাছান বা শাহরিয়াররা যা করছে সেসব অবশ্যই যৌন অপরাধ বা বিকৃতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এসব মানসিক অসুস্থতা মাত্র। প্রশ্ন হলো, এর চিকিৎসা কীভাবে হবে। কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া? আইনের বিধান আরও কঠোর করা? অভিযুক্তদের চাকরিচ্যুতি, চার্জশিট? হাস্যকর সব প্রেসক্রিপশন।


কেউ কেউ আইন-শৃঙ্খলা বিভাগের ঘাড়েও দোষ চাপাচ্ছেন। যৌন অতৃপ্তিজনিত সমস্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কী করার আছে ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় চাকরিচ্যুত শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে দায়ী করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পুরো দায় একজনের ওপর বর্তাতে পেরে 'সংশ্লিষ্ট' সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু যেদিন এ চার্জশিট জমা পড়ল সে দিনই রাজশাহীতে মেহেদী হাছান নামে এক প্রিন্সিপাল এবং পরের সপ্তাহে রাঙ্গুনিয়া কলেজের আরেক শিক্ষক একই অভিযোগে আটক হলেন। তার মানে দু'একটি চার্জশিটে থামানো যাচ্ছে না বিকৃত যৌনতার মহামারী। সে ক্ষেত্রে এই মহামারীর কারণ অনুসন্ধান জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত এরূপ অনুসন্ধানের জন্য?
যৌনতা জীবনের এক বড় সত্য। সত্যের মুখোমুখি হতে হয় সবাইকে। কিন্তু প্রাচ্যের রক্ষণশীলতা অনেক সময় সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়; ইতস্তত করে; সত্যকে ধামাচাপা দিতে চায়। সত্যের আগুন অবশ্য নেভে না তাতে। সে আগুনেই পুড়ছে এখন বাংলাদেশ।
মুক্তবাজারে যৌনতা মহামূল্যবান পণ্য। অনেক বাণিজ্যে যৌনতা অপরিহার্য পুঁজি। বাংলাদেশ মুক্তবাজারকে কবুল করেছে সানন্দে। কিন্তু যৌনতার প্রকাশে আপত্তি তার। ফ্রি ইকোনমিতে মনোজগৎ সঁপে দিয়ে ফ্রি চয়েজ আপত্তি বেমানান।
মুক্তবাজারে যৌনতা অবদমনের সুযোগ নেই। যদিও সেরকমই নির্দেশ 'সমাজ'-এর। তাতে ফল দাঁড়িয়েছে এই, গ্রাম-শহরে বিকৃত যৌনতার জোয়ার বইছে। রমনার অভিজাত স্কুল থেকে রাঙ্গুনিয়ার কলেজ পর্যন্ত সর্বত্র বিকৃতির অভিঘাত। কেবল দু'চারটি চার্জশিট দিয়ে অবদমিত যৌনতাকে খাঁচায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। যাবেও না নিশ্চিতভাবে। কিন্তু সেই সত্য 'সমাজ' বুঝবে কবে?
জয়ধর, মেহেদী হাছান কিংবা রাঙ্গুনিয়ার শাহরিয়ারদের নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া পুরোদস্তুর হিপোক্রেসিতে ভরা। আঁতকে ওঠার ভঙ্গি তার। সে যেন জানত না সমাজ এতটা 'নষ্ট'! সে নিজেই যেন নষ্টের বৃক্ষায়ন করেনি। আমরা কি ঘরে ঘরে 'শিলা কি জওয়ানি' দেখছি না?
'শিলা কি জওয়ানিতে' ক্যাটরিনা কাইফ স্রেফ একজন যৌন আবেদনময়ী নারী নন, তিনি মার্কেট ইকোনমির মুখপাত্র। ক্যাটরিনা যখন বলেন, 'আই নো ইউ ওয়ান্ট ইট, বাট ইউ নেভার গন-না গেট ইট; তেরি হাত কোভি না আনি...।' 'তোমরা আমাকে চাইছ, সে তো বুঝতে পারছি.. কিন্তু তোমরা আমাকে পাবে না...' একি শুধু যৌন উস্কানি? নাকি মার্কেট ইকোনমির মায়াজাল। বাংলাদেশ কতটা বুঝল শিলাকে! শিলা কিংবা মুক্তবাজারের সঙ্গে যৌনতা, বিশেষত অবদমিত যৌনতার যে বিস্তর রাজনৈতিক ও কারিগরি (!) যোগাযোগ আছে সে সত্য বুঝলে তো সমাজ তার চার্জশিট জয়ধরদের ওপর নাজেল করার আগে মুক্তবাজারের ওপর আরোপ করত। সেরূপ উপলব্ধির জ্ঞানগত তাগিদ বাংলাদেশে কবে তৈরি হবে কে জানে।
বিশ্বব্যাপী সেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ মার্কেট ইকোনমির মৌলিক অনুষঙ্গ। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, থিংকট্যাংক; আমাদের 'সমাজ' পুরোপুরি মার্কেট ইকোনমির কাছে সমর্পিত। সুতরাং আমাদের নবীন প্রজন্ম ক্যাটরিনাকে দেখার পর আরও কিছু খুঁজতে ইউটিউব ঘাঁটবে_ এতে চমকে ওঠার অবকাশ কোথায়? সম্প্র্রতি জয়ধর, অরুণ, মেহেদী হাছান বা শাহরিয়াররা যা করছে সেসব অবশ্যই যৌন অপরাধ বা বিকৃতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এসব মানসিক অসুস্থতা মাত্র। প্রশ্ন হলো, এর চিকিৎসা কীভাবে হবে। কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া? আইনের বিধান আরও কঠোর করা? অভিযুক্তদের চাকরিচ্যুতি, চার্জশিট? হাস্যকর সব প্রেসক্রিপশন। কেউ কেউ আইন-শৃঙ্খলা বিভাগের ঘাড়েও দোষ চাপাচ্ছেন। যৌন অতৃপ্তিজনিত সমস্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কী করার আছে।
কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী সেই ঘটনা হয়তো সমাজ ভুলতে বসেছে, যেখানে স্বামীর আড়ালে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নির্বিঘ্ন রাখতে নিরপরাধ সন্তানকে খুন করিয়েছিলেন এক তন্বী। তার নামেও হয়তো চার্জশিট হয়েছে, হয়তো কারাগারেই আছেন তিনি। এরূপ অতৃপ্তিজনিত অসুস্থতার কী ধরনের চিকিৎসা আছে সমাজের হাতে। বিয়েকে যে সমাজে চূড়ান্ত এক বন্ধন হিসেবে প্রতিনিয়ত কঠোরতর করা হচ্ছে_ সেখানে যৌন অতৃপ্তির পরও ওই বন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে বহু নিরপরাধ মানুষকে কোরবানি হতে হবে এটাই প্রাচ্যের নিয়তি। পরকীয়া এখানে 'পাপ', পতিতালয় 'অবৈধ', বন্ধুত্বে 'নিষেধাজ্ঞা'। এখানে প্রশংসিত হলো অবদমন। এ হলো প্রাকৃতিক সমস্যার অপ্রাকৃত চিকিৎসা। যা অকার্যকর হতে বাধ্য। আজকে তাই হচ্ছে। এখানে মানসিক রোগের চিকিৎসা খোঁজা হয় পেনাল কোডে।
আধুনিক বিশ্বে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। শৈশব থেকে সেখানে সহশিক্ষা। আমরা এখানে তাদের শুচি-শুদ্ধ রাখতে গড়েছি বালক-বালিকা বিদ্যালয়ের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও তার বিকাশমান তাৎপর্য কখনও বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করা হয় না শিক্ষার্থীদের কাছে। গুরুত্ব দেওয়া হয় তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে। ফলে বয়োপ্রাপ্তির পরই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে শুরু হয় পরস্পরকে নিয়ে অস্বাভাবিক শিহরণ। এই অস্বাভাবিকতা এক ধরনের ব্যাধি, যার জন্ম পরিবারে। যে কারণে আজকের যৌন 'অপরাধ' নামক সামাজিক ব্যাধির দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি বাবা-মাকেও। কাউন্সেলিং প্রয়োজন মানব-প্রকৃতিবিরোধী নৈতিক শিক্ষা সংস্কৃতির।
যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন, নিউইয়র্ক বা সিডনিতে অফিসে কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে দুই নারী-পুরুষ ধাক্কা খেলে একে ধাক্কা হিসেবেই দেখা হয়। ঢাকায় একটি অফিসে একই ঘটনা ঘটলে সেটা দেখা হবে শারীরিক সুখ লাভের চেষ্টা হিসেবে। এখানে পুরুষকে নারী দেখে যৌনকাতর প্রতিপক্ষ হিসেবে; ঠিক একইভাবে আশপাশের সব নারীর দিকে পুরুষ নজর রাখে 'যৌনবস্তু' হিসেবে। এই 'যোগাযোগ সংস্কৃতির' ধারাবাহিক ফল হবে আরও খারাপ।
এর মোকাবেলায় আমাদের 'শুচিশুভ্র' সমাজের হাতে কী দাওয়াই আছে? আরও কঠোর আইন? নারীদের খাঁচায় পুরে রাখা? আসলে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের আহম্মকি বাদ দিয়ে 'সমাজকে' চারপাশে তাকাতে হবে আজ। জীবন যাপনের ধরন বদলানো এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি পাল্টানো তার জন্য জরুরি। জয়ধর ও মেহেদি হাছানদের সংখ্যা অগণিত। তারা বাড়বে আরও বেশুমার। কেবল ক্যাটরিনা কাইফ বা ইউটিউবই সমস্যার উৎস নয়। সমস্যার মূলে রয়েছে শরীরকে অবজ্ঞা করে নৈতিকতা চর্চার হিপোক্রেসি।
আমাদের নৈতিকতা 'রক্তমাংস'-এর ওপর দাঁড়ায়নি। সেজন্য তাকে প্রতিদিন পেনাল কোডের ওপর ভর করতে হয়।

আলতাফ পারভেজ : লেখক, গবেষক
altafparvez@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.