চরাচর-পালকির ইতিকথা by সাইফুল ইসলাম খান

পালকি চলেরে! অঙ্গ টলেরে!/আর দেরি কত? আরো কতদূর?'_ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকিতে চড়ে গন্তব্যে পেঁৗছানোর ভাবনা এখন আর নেই। গত শতাব্দীর শেষ দশকে দেশের কোথাও কোথাও পালকির ব্যবহার দেখা গেলেও বর্তমান শতকের শুরু থেকেই পালকি যেন অমাবস্যার চাঁদ।


বর্তমান প্রজন্ম চলচ্চিত্রে পালকি দেখলেও পালকি নামক বাহনটির সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। বর্তমানে বিলুপ্ত, কিন্তু একসময় বহুল ব্যবহৃত অভিজাত শ্রেণীর প্রিয় বাহনের নাম ছিল পালকি। পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'পালঙ্ক' শব্দ থেকে। যার অর্থ শয্যা বা বিছানা। এটি মনুষ্যচালিত চাকাবিহীন বাহন। উপমহাদেশে পালকির প্রচলন কখন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও বাল্মীকির রামায়ণে পালকির উল্লেখ আছে। সে হিসাবে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তখনকার সময় যান্ত্রিক যানবাহন না থাকায় অভিজাত শ্রেণী ও ধনিক সম্প্রদায়ের প্রধান বাহন ছিল পালকি। সাধারণ মানুষ শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য ভাড়া করা পালকি ব্যবহার করত। উপমহাদেশের বাইরে প্রাচীন রোমে পালকির প্রচলন ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে পালকি ছিল অভিজাত শ্রেণীর প্রধান বাহন। লেখক ও ব্রিটেনের রাজা অষ্টম হেনরি আমৃত্যু পালকিতে চড়তেন। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, মিসর, আমেরিকাসহ পৃথিবীর সর্বত্র পালকির ব্যবহার ছিল। অবশ্য সব দেশেই পালকি ব্যবহার করত অভিজাত সম্প্রদায়। এমনকি অভিজাত শ্রেণী ছাড়া পালকি ব্যবহার করা অনেক দেশে নিষিদ্ধ ছিল। দেশভেদে পালকির ভিন্ন ভিন্ন নামও ছিল। জিয়াও, প্যালানকিন, সিডান চেয়ার, গামা ইত্যাদি নামে পরিচিত পালকিকে প্রাচীন রোমে বলা হতো লেকটিকা। সাধারণত একটি বা দুটি লম্বা বাঁশ বা কাঠের দণ্ডে বড় চেয়ার বা খাট ঝুলিয়ে এবং কাঠ, বাঁশ বা কাপড় দিয়ে আবৃত করে পালকি তৈরি করা হতো। সামাজিক বা অর্থনৈতিক মর্যাদাভেদে পালকিতে কারুকাজ থাকত। ঐতিহ্যগতভাবে চীন ও থাইল্যান্ডের পালকিতে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ থাকলেও ব্রিটেনের পালকিগুলো হতো অপেক্ষাকৃত বড় ও বিলাসবহুল। উপমহাদেশে পালকি বহনকারীদের ডাকা হতো বেহারা নামে। বেহারা পেশাজীবীরা ছিলেন খুবই বিশ্বস্ত ও অনুগত। কাঁধে পালকি বহনের সময় তাঁরা 'হুন হুনা হুন' জাতীয় গান গুন গুন করে গাইতেন। পালকি বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বেহারাগোষ্ঠীও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কালক্রমে তাঁরা ঢোল-বাদক বা মুচির (জুতা সেলাইয়ের) পেশায় জড়িয়ে পড়েন। ঊনিশ শতকের শেষার্ধে যান্ত্রিক যানবাহন উৎপাদনে ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। মোটরগাড়ি ও রিকশা আবিষ্কার হয় এবং রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে পালকির ব্যবহার। বর্তমানে ভারতের কিছু কিছু এলাকায়, যেমন_অমরনাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের বহনের জন্য ভাড়া করা পালকি দেখা যায়। আধুনিককালে বিয়ের পর নব বর-বধূ গাড়িতে পাশাপাশি বসেন; কিন্তু সেকালের বর-বধূ পালকিতে বসতেন মুখোমুখি হয়ে। পালকি যুগের সে মধুর মুহূর্তগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.