সমকালীন প্রসঙ্গ-একটি মৃত্যু ও অনেক প্রশ্ন by তারেক শামসুর রেহমান
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। কেননা তিনি 'অভিযুক্ত আসামি' ছিলেন। পুলিশ তার 'দায়িত্ব' পালন করেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গ্রেফতারের পর কিছুটা মানবিক হলে তো ক্ষতির কিছু ছিল না। যে লোকটি এক রকম সুস্থই ছিলেন বাসাতে অর্থাৎ গ্রেফতারের সময়, তিনি গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে 'অসুস্থ' হয়ে যান কী ভাবে?
শেষ পর্যন্ত অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদ মারা গেলেন। হাইকোর্টে হাতাহাতি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও পরিবেশ নষ্টের কারণে যে ১৪ জন বিএনপিপন্থি আইনজীবীর নামে পুলিশ মামলা করেছিল তিনি ছিলেন তাদের একজন। ১৩ জন অভিযুক্ত আইনজীবী নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ ও পরে জামিন পেলেও প্রয়াত অ্যাডভোকেট জামিন নিতে পারেননি। কেননা তিনি তখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত জামিন না নিয়েই তিনি চলে গেলেন এমন এক 'রাজ্যে' যেখান থেকে কেউ কোনোদিন আর ফিরে আসে না। অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। অভিযোগ উঠেছে, গ্রেফতারের পর তার ওপর নির্যাতন করা হয়। তার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হয়েই তিনি মারা গেছেন। আমরা জানি না, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যখন দাবি করেন পুলিশের অত্যাচারেই এমইউ আহমেদের মৃত্যু হয়েছে, তখন এটিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। কেননা তিনি 'অভিযুক্ত আসামি' ছিলেন। পুলিশ তার 'দায়িত্ব' পালন করেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গ্রেফতারের পর কিছুটা মানবিক হলে তো ক্ষতির কিছু ছিল না। যে লোকটি এক রকম সুস্থই ছিলেন বাসাতে অর্থাৎ গ্রেফতারের সময়, তিনি গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে 'অসুস্থ' হয়ে যান কী ভাবে? আমি ঠিক জানি না, প্রয়াত অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদ অতীতে কখনও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি-না? কিংবা তিনি নিয়মিত হার্টের ডাক্তারের কাছে যেতেন কি-না? তবে দুটো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে হার্টের অসুস্থতার কথা বলা হয়েছে। তার স্ত্রী নিশ্চয়ই পুলিশকে এ তথ্য দিয়েছিলেন। তারপরও তাকে হাসপাতালে ভর্তি না করা এবং ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া_ নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এখন। পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি, আইজিপি মহোদয় হার্টের সমস্যার কথা বলেছেন। তাহলে তো তাকে আগে হাসপাতালে নেওয়ার কথা। সুতরাং নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে তা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, প্রয়াত অ্যাডভোকেট আহমেদকে 'ইলেকট্রিক শক' দেওয়া হয়েছিল। তার শরীরে (বাম হাতের কব্জি) ইলেকট্রিক শকের দাগ রয়েছে। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা নিন্দনীয় এবং একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদেরই শাস্তি হওয়া উচিত। একমাত্র তার চিকিৎসকরাই বলতে পারবেন অভিযোগটি সত্য কি-না। ইদানীং বড় বড় হাসপাতালে রোগীদের 'রোগের ইতিহাস' লেখা থাকে। রোগীকে যখন ভর্তি করানো হয় তখন রোগীর অবস্থাও রেকর্ড করা হয়। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও স্কয়ার হাসপাতালের রিপোর্ট রয়েছে। এই রেকর্ড ফাইল প্রয়াত আহমেদের পরিবারের কাছে থাকার কথা। রিপোর্টে অবশ্যই শরীরে 'ইলেকট্রিক শক'-এর দাগের কথা উল্লেখ থাকবে। তারা এটা প্রকাশ করতে পারেন। তাকে যারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন কিংবা শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যার কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তিনিও বলতে পারেন এ বিষয়ে। তৃতীয়ত, প্রয়াত আহমেদ পুলিশ দেখলে চমকে উঠতেন। একজন স্বাভাবিক লোকের পুলিশ দেখে চমকে ওঠার কথা নয়। পুলিশ এমন কিছু করেছিল, যা এমইউ আহমেদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। এখানেই এসে যায় 'ইলেকট্রিক শক'-এর বিষয়টি। চতুর্থত, ওই দিন গ্রেফতারের (১১ আগস্ট রাত দেড়টা) পর এমইউ আহমেদ ৪ ঘণ্টা ছিলেন ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে (সকালের খবর, ২৭ আগস্ট)। কিন্তু পুলিশের ডিসি-ডিবি (উত্তর) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গ্রেফতার হওয়ার পর অ্যাডভোকেট আহমেদ ডিবি কার্যালয়ে ছিলেন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট (যুগান্তর, ২৭ আগস্ট)। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি কোনো তথ্য গোপন করছেন? একটি সুষ্ঠু তদন্ত হলেই সত্য বেরিয়ে আসবে। পঞ্চমত, পুলিশ কথা আদায় করার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা অত্যাচার করে। কথা আদায়ের নামে এই যে 'টর্চার', পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটি নেই। পুলিশ প্রয়োজনে 'লাই ডিটেক্টর' ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু টর্চার কেন? পুলিশের সংস্কারের কথা উঠেছে। ইউএনডিপির ফান্ডও রয়েছে। নতুন প্রযুক্তি ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এখানে জরুরি। প্রায়ই দেখা যায় পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে অনেকে অনেক কথা স্বীকার করে। কিন্তু আদালতে গিয়ে তা আবার অস্বীকার করে। সুতরাং স্ট্র্যাটেজিতে কিছুটা পরিবর্তন প্রয়োজন। ষষ্ঠত, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। এটি যুক্তিযুক্ত। ঘটনার গভীরতা বিশ্লেষণ করে ও প্রয়াত এমইউ আহমেদের সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সরকার হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে এ ধরনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। এতে করে সরকার তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে। পুলিশের স্বার্থেই পুলিশ এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইতে পারে। কেননা পুলিশের বিরুদ্ধে ইদানীং যেসব অভিযোগ উঠেছে, তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। লিমন, কাদের, মিলনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি। আমরা বলেছি, পুলিশের ভেতরে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা সুবিধাবাদী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য তারা এমন সব 'কাণ্ড' করেন, যা সমগ্র পুলিশ প্রশাসনকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়। ফারুকের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়নি। 'অপরাধ'কে পুলিশ প্রশাসন সমর্থন করেছে। এটি ভালো নয়। 'ক্রাইমস আনসিন এক্সট্রা জুডিসিয়াল এক্সিকিউশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টটিতে র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এতে করে কি বহির্বিশ্বে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে? আমরা বারবার বলে আসছি, বহির্বিশ্বে পুলিশ তথা র্যাবের কর্মকাণ্ড মনিটর করা হচ্ছে। একজন বা দু'জন পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অতি উৎসাহীরা পুলিশ বাহিনীতে থেকে এমন সব কাণ্ড ঘটান, যা বহির্বিশ্বে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাও পর্যবেক্ষণ করবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। প্রয়াত এমইউ আহমেদের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে 'লোক দেখানো' ময়নাতদন্তের। যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, তিনি একজন সহযোগী অধ্যাপক। একজন সিনিয়র শিক্ষক। তিনি 'লোক দেখানো' ময়নাতদন্ত করবেন না_ এ বিশ্বাস আমার আছে।
আসলে অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের হাসপাতালে মৃত্যু নিয়ে যে ঘটনা ঘটল, তা এ দেশের রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। দুটি বড় দল, বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা এ মৃত্যুকে নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপি যখন বলছে, 'পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড' ও 'মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া'র কথা, তখন আওয়ামী লীগের দু'একজন নেতাও বলছেন 'লাশ নিয়ে রাজনীতি' করার কথা। অ্যাটর্নি জেনারেলও অনেকটা এ সুরেই কথা বলছেন। তবে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য যথেষ্ট 'ম্যাচিউরড'। তিনি বলেছেন সুষ্ঠু বিচারের কথা। আমরাও তেমনটি চাই। তবে একটা কথা, যে 'ঘটনার' জন্য প্রয়াত এমইউ আহমেদ অভিযুক্ত হয়েছিলেন অর্থাৎ আদালতে বিশৃঙ্খলা, এই বিশৃঙ্খলা যেন আমরা পরিহার করি। আদালত একটি পবিত্র জায়গা, স্লোগান দেওয়ার জায়গা নয়। বিচারের জন্য আমরা সেখানে যাই। এই মৃত্যু আমাদের মধ্যে উপলব্ধিবোধের জন্ম দিক_ আদালতে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা 'মৃত্যুর'ও কারণ হতে পারে কখনও সখনও। অতীতে এ ধরনের ঘটনা হয়েছে বলে আবার হবে_ এই মানসিকতা থাকা ভালো নয়। অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তিনি যদি হৃদরোগের অসুস্থতার কারণেও মারা গিয়ে থাকেন, তারপরও সেই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক, যাতে সব প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে যাব।
ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। কেননা তিনি 'অভিযুক্ত আসামি' ছিলেন। পুলিশ তার 'দায়িত্ব' পালন করেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গ্রেফতারের পর কিছুটা মানবিক হলে তো ক্ষতির কিছু ছিল না। যে লোকটি এক রকম সুস্থই ছিলেন বাসাতে অর্থাৎ গ্রেফতারের সময়, তিনি গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে 'অসুস্থ' হয়ে যান কী ভাবে? আমি ঠিক জানি না, প্রয়াত অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদ অতীতে কখনও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি-না? কিংবা তিনি নিয়মিত হার্টের ডাক্তারের কাছে যেতেন কি-না? তবে দুটো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে হার্টের অসুস্থতার কথা বলা হয়েছে। তার স্ত্রী নিশ্চয়ই পুলিশকে এ তথ্য দিয়েছিলেন। তারপরও তাকে হাসপাতালে ভর্তি না করা এবং ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া_ নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এখন। পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি, আইজিপি মহোদয় হার্টের সমস্যার কথা বলেছেন। তাহলে তো তাকে আগে হাসপাতালে নেওয়ার কথা। সুতরাং নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে তা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, প্রয়াত অ্যাডভোকেট আহমেদকে 'ইলেকট্রিক শক' দেওয়া হয়েছিল। তার শরীরে (বাম হাতের কব্জি) ইলেকট্রিক শকের দাগ রয়েছে। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা নিন্দনীয় এবং একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদেরই শাস্তি হওয়া উচিত। একমাত্র তার চিকিৎসকরাই বলতে পারবেন অভিযোগটি সত্য কি-না। ইদানীং বড় বড় হাসপাতালে রোগীদের 'রোগের ইতিহাস' লেখা থাকে। রোগীকে যখন ভর্তি করানো হয় তখন রোগীর অবস্থাও রেকর্ড করা হয়। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও স্কয়ার হাসপাতালের রিপোর্ট রয়েছে। এই রেকর্ড ফাইল প্রয়াত আহমেদের পরিবারের কাছে থাকার কথা। রিপোর্টে অবশ্যই শরীরে 'ইলেকট্রিক শক'-এর দাগের কথা উল্লেখ থাকবে। তারা এটা প্রকাশ করতে পারেন। তাকে যারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন কিংবা শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যার কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তিনিও বলতে পারেন এ বিষয়ে। তৃতীয়ত, প্রয়াত আহমেদ পুলিশ দেখলে চমকে উঠতেন। একজন স্বাভাবিক লোকের পুলিশ দেখে চমকে ওঠার কথা নয়। পুলিশ এমন কিছু করেছিল, যা এমইউ আহমেদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। এখানেই এসে যায় 'ইলেকট্রিক শক'-এর বিষয়টি। চতুর্থত, ওই দিন গ্রেফতারের (১১ আগস্ট রাত দেড়টা) পর এমইউ আহমেদ ৪ ঘণ্টা ছিলেন ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে (সকালের খবর, ২৭ আগস্ট)। কিন্তু পুলিশের ডিসি-ডিবি (উত্তর) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গ্রেফতার হওয়ার পর অ্যাডভোকেট আহমেদ ডিবি কার্যালয়ে ছিলেন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট (যুগান্তর, ২৭ আগস্ট)। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি কোনো তথ্য গোপন করছেন? একটি সুষ্ঠু তদন্ত হলেই সত্য বেরিয়ে আসবে। পঞ্চমত, পুলিশ কথা আদায় করার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা অত্যাচার করে। কথা আদায়ের নামে এই যে 'টর্চার', পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটি নেই। পুলিশ প্রয়োজনে 'লাই ডিটেক্টর' ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু টর্চার কেন? পুলিশের সংস্কারের কথা উঠেছে। ইউএনডিপির ফান্ডও রয়েছে। নতুন প্রযুক্তি ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এখানে জরুরি। প্রায়ই দেখা যায় পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে অনেকে অনেক কথা স্বীকার করে। কিন্তু আদালতে গিয়ে তা আবার অস্বীকার করে। সুতরাং স্ট্র্যাটেজিতে কিছুটা পরিবর্তন প্রয়োজন। ষষ্ঠত, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। এটি যুক্তিযুক্ত। ঘটনার গভীরতা বিশ্লেষণ করে ও প্রয়াত এমইউ আহমেদের সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সরকার হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে এ ধরনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। এতে করে সরকার তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে। পুলিশের স্বার্থেই পুলিশ এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইতে পারে। কেননা পুলিশের বিরুদ্ধে ইদানীং যেসব অভিযোগ উঠেছে, তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। লিমন, কাদের, মিলনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি। আমরা বলেছি, পুলিশের ভেতরে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা সুবিধাবাদী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য তারা এমন সব 'কাণ্ড' করেন, যা সমগ্র পুলিশ প্রশাসনকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়। ফারুকের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়নি। 'অপরাধ'কে পুলিশ প্রশাসন সমর্থন করেছে। এটি ভালো নয়। 'ক্রাইমস আনসিন এক্সট্রা জুডিসিয়াল এক্সিকিউশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টটিতে র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এতে করে কি বহির্বিশ্বে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে? আমরা বারবার বলে আসছি, বহির্বিশ্বে পুলিশ তথা র্যাবের কর্মকাণ্ড মনিটর করা হচ্ছে। একজন বা দু'জন পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অতি উৎসাহীরা পুলিশ বাহিনীতে থেকে এমন সব কাণ্ড ঘটান, যা বহির্বিশ্বে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাও পর্যবেক্ষণ করবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। প্রয়াত এমইউ আহমেদের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে 'লোক দেখানো' ময়নাতদন্তের। যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, তিনি একজন সহযোগী অধ্যাপক। একজন সিনিয়র শিক্ষক। তিনি 'লোক দেখানো' ময়নাতদন্ত করবেন না_ এ বিশ্বাস আমার আছে।
আসলে অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের হাসপাতালে মৃত্যু নিয়ে যে ঘটনা ঘটল, তা এ দেশের রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। দুটি বড় দল, বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা এ মৃত্যুকে নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপি যখন বলছে, 'পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড' ও 'মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া'র কথা, তখন আওয়ামী লীগের দু'একজন নেতাও বলছেন 'লাশ নিয়ে রাজনীতি' করার কথা। অ্যাটর্নি জেনারেলও অনেকটা এ সুরেই কথা বলছেন। তবে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য যথেষ্ট 'ম্যাচিউরড'। তিনি বলেছেন সুষ্ঠু বিচারের কথা। আমরাও তেমনটি চাই। তবে একটা কথা, যে 'ঘটনার' জন্য প্রয়াত এমইউ আহমেদ অভিযুক্ত হয়েছিলেন অর্থাৎ আদালতে বিশৃঙ্খলা, এই বিশৃঙ্খলা যেন আমরা পরিহার করি। আদালত একটি পবিত্র জায়গা, স্লোগান দেওয়ার জায়গা নয়। বিচারের জন্য আমরা সেখানে যাই। এই মৃত্যু আমাদের মধ্যে উপলব্ধিবোধের জন্ম দিক_ আদালতে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা 'মৃত্যুর'ও কারণ হতে পারে কখনও সখনও। অতীতে এ ধরনের ঘটনা হয়েছে বলে আবার হবে_ এই মানসিকতা থাকা ভালো নয়। অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তিনি যদি হৃদরোগের অসুস্থতার কারণেও মারা গিয়ে থাকেন, তারপরও সেই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক, যাতে সব প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে যাব।
ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments