চালচিত্র-মনমোহন-সফরের ফলআউট, যানজট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা by শুভ রহমান
আবার যানজট। এবার আরো দুঃসহ মনে হচ্ছে। কয়েক দিন একটু স্বস্তিতে থাকার কারণেই এবার কষ্টটা আরো বেশি লাগছে। সামনে আরেকটা ঈদ পর্যন্ত তা বেড়েই চলবে। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় আজও বের হলো না। অথচ ওদিকে মেট্রো রেল, দাঁতভাঙা শব্দের এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ে করার শুধু পাঁয়তারা চলছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ভাদ্রের প্রচণ্ড গুমোট। তার মধ্যেই আসছে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পর দেশে এখন একটা মিশ্র অবস্থা বিরাজ করছে। সফরকে আমরা বলেছিলাম ঐতিহাসিক। বলেছিলাম, এ সফর দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে একটা রেড লেটার ডের, একটা স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দুই দেশের সম্পর্কের ওপর এ সফর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে। কিছু আপাত-ব্যর্থতা সত্ত্বেও এ সফরের সাফল্য অপরিসীম। যারা নিজেদের সাফল্য ঠিকভাবে দেখতে পায় না, তারা সত্যিই হতভাগ্য।
এ দেশের রাজনীতিতে এখনো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা চলছে। গায়ের জোরেই মনমোহনের সফরকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা হচ্ছে। স্কেপগোট করা হচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। সব দোষ তাঁর। তাঁকে সরালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, আমরা ক্ষমতায় গেলে তিস্তার পানি চুক্তি করে ফেলব। এখন একটা 'যুদ্ধ' শুরু করতে হবে। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে যুদ্ধই। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সে রকম কথাই বলেছেন। হরতাল ছাড়া অন্য সব কর্মসূচি_বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ, রোড মার্চ, শোভাযাত্রা, লংমার্চ ইত্যাদি করবে বিএনপি। সেই সঙ্গে চেয়ারপারসন সারা দেশ সফর করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ_এসব দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে বিএনপি। গণমানুষের সমর্থন তারা কতটা পাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে কাগজে বেরিয়েছে, আওয়ামী লীগ নাকি সে আন্দোলনকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
আন্দোলন কতটা হবে, কেমন হবে, আদৌ হবে কি না_তা দেশবাসীরও জানা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সবাইকে কেমন একটা নির্লিপ্তই মনে হচ্ছে। তেমন একটা উৎসাহী মনে হচ্ছে না।
তবে এটা স্পষ্ট যে 'স্ট্রাইক দ্য আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট' নীতি অনুসরণ করে বিএনপি আন্দোলনে নামছে। সদ্য তিস্তা চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর দেশে সৃষ্ট একটা নেতিবাচক অবস্থা, একটা হতাশাজনক অবস্থাকেই বিএনপি ব্যাংক করতে চাইছে। আর সে জন্যই 'গিভ দ্য ডগ এ ব্যাড নেম বিফোর ইউ ওয়ান্ট টু স্ট্রাইক ইট' নীতিও অনুসরণ করে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে।
বলছে, দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে হবে। চিরকালই তারা দেশ বিক্রির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে থাকে। তার পরও ২০০৮ সালে গণমানুষের বিপুল ভোটেই জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
দিদির ইস্যু!
তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য দায়ী প্রকৃতপক্ষে কে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, না আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ও দূরদর্শিতার অভাব, দক্ষতার অভাব, দুই উপদেষ্টার ওপর নির্ভরতাই এ জন্য দায়ী কি না, নাকি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরই এটা কূটকৌশল মাত্র_এসব নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে দুই দেশেই। সাধারণের মধ্যে, আবার প্রচারমাধ্যমেও। শিগগিরই তিস্তা চুক্তি হবে_এমন আশাবাদ মহাজোট সরকারের দুই মন্ত্রী সৃষ্টি করলেও তার ওপরও মানুষ তেমন ভরসা রাখতে পারছে না। তিন মাসের মধ্যেই চুক্তি হবে_এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী এবং পানিসম্পদমন্ত্রী। ওদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীও গত ৭ সেপ্টেম্বরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত নৈশ ভোজেও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসার কারণেই এ অচলাবস্থা, তিনি কিন্তু মুখ খুলছেন না। তাঁর নীরবতার কারণ সম্পর্কেও নানা গুঞ্জন চলছে দুই দেশে। পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমও 'দিদির ইস্যু' বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
কোনো কোনো মহলের জল্পনা, সামনে মমতার উপনির্বাচন তো; তাই তিনি ওটা নিয়েই ব্যস্ত। আবার কেউ বলছেন, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, তাই তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে তাঁর অসুবিধা হয়। মমতা নিজে নাকি বলেছেন, উত্তরবঙ্গের মানুষের ক্ষতি করে তিনি কিছু করবেন না। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, যেটা খসড়া চুক্তিতে ছিল, বাংলাদেশ ২৫ শতাংশ পাবে, সেটা পরে পাল্টে দিয়ে ৪৮ ও ৫২ শতাংশ করাতেই তিনি গররাজি। সে জন্যই তিনি চুক্তি স্বাক্ষরে উপস্থিত থাকতে মনমোহনের সফরসঙ্গী হননি। বস্তুত এমন অনেক প্রশ্নই ধোঁয়াটে রয়ে গেছে। এসব নিয়ে এখন আর কেউ মাথাও ঘামাবে না, কারণ মমতা বলে দিয়েছেন, আগে তিস্তায় পানি থাকতে হবে তো, তারপর ভাগাভাগি। তিস্তায় পানিই নেই। ব্যাপারটা এরপর ঝুলেই থাকছে।
সচেতন দেশবাসীর অবশ্য বক্তব্য, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হলেও মনমোহনের সফরের গুরুত্ব খাটো করে দেখার কিছু নেই। এ মুহূর্তে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রটোকল, স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, বাংলাদেশের ৪৬টি গার্মেন্ট পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা সংক্রান্ত যে চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা-ই দুই দেশের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী করে তুলেছে, তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেছে। এই ভিত্তি অটুট থাকলেই তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তিসহ দুই দেশের অমীমাংসিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান নিশ্চিত।
বস্তুত প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজেই যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক; সেখানে এ চুক্তি হওয়ার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করা যায় না। তা ছাড়া তিনি ইতিমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করাতে এবার আমলার বদলে রাজনৈতিক দূত পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেকোনো সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই স্থায়ী সমাধানের নিশ্চয়তা দেয়। তিস্তা ও ফেনী নদীর ব্যাপারে ভারত এখন সেই পথই নিচ্ছে।
তিস্তার ব্যাপারে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) নিয়মিত বৈঠক না হওয়াতেই এ-সংক্রান্ত চুক্তি এতকাল সম্পাদিত হতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহনের দুই দিনের সফর শেষে ঢাকায় যে ৬৫ দফা যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতেই তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে সৃষ্ট ঐকমত্যকে স্বাগত জানিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত সম্ভব এ দুটি চুক্তি সম্পাদনের কাজ শেষ করতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিস্তা ও ফেনী নদীর ব্যাপারে এই আনুষ্ঠানিক নির্দেশই এ-সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের সব অনিশ্চয়তা দূর করে দিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞমহল মনে করছে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন ও জাতিসংঘ কনভেনশন
এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী সংক্রান্ত আইন, জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী ভারতে পদ্মা, তিস্তা, ফেনীসহ যে নদনদীর উৎস রয়েছে, তাদের পানি বণ্টনের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অলঙ্ঘনীয় বিধানই। ইন্টারনেট সূত্র বলছে, বিশ্বে ভূপৃষ্ঠের ৪৫ শতাংশ ভূমি নিয়ে ২৬১টি আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকা রয়েছে (কুমেরু বাদে) এবং একাধিক দেশে তা বিভক্ত। তবে তাদের আন্তসীমান্ত 'সারফেস ওয়াটার' বা ভূপৃষ্ঠের পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক প্রতিবেশী দেশের পক্ষেও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য বন্দোবস্তের মাধ্যমে পানি ভাগাভাগি একটি দুরূহ ব্যাপার। ইউরোপের বহু দেশ দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী দানিয়ুব ও রাইনের পানি ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার সমস্যার এখনো সুরাহা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০৪-৩ ভোটে আন্তর্জাতিক নদীর পানি নৌযান চালনা ছাড়া (নন-নেভিগেশন্যাল ইউজেস) অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারসংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন গৃহীত হয়। সে কনভেনশন বা সনদ ও আন্তর্জাতিক নদী আইনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার এমনভাবে (সমতার ভিত্তিতে) করার কথা বলা হয়েছে, যাতে পরস্পরের ক্ষতি সাধিত না হয় (নো হার্ম রুল)। এই বিধিবিধান বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদনদীর পানি ন্যায়সংগতভাবে বণ্টনের রক্ষাকবচ হিসেবে রয়েছে। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনও সমতার ভিত্তিতে হবে বলেই বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন।
বস্তুত, দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর শান্তিপূর্ণ পানিবণ্টনের এক রকম বাধ্যবাধকতাই বিদ্যমান। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে যতই ত্রুটিপূর্ণ থাক, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চুক্তি হওয়ায়ই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই আবার তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে দুই দেশের উদ্যোগ গ্রহণ এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হতে পারে, কিন্তু দুই দেশের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধই পরিশেষে তা সম্ভব করে তুলবে। লক্ষণীয়, অন্য সরকারগুলোর আমলে এর অভাবেই কোনো পানিবণ্টন চুক্তি হতে পারেনি।
আজ যারা নেতিবাচক রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত হওয়াকে পুঁজি করে আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে, তারা বস্তুত দেউলিয়া ও বন্ধ্যা রাজনীতির, নিছক ক্ষমতান্ধ রাজনীতির ধারক-বাহক। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তারা কোনো প্রকৃত ও যুক্তিসংগত সমর্থন পেতে পারে না। তাদের নেতিবাচক রাজনীতি দেশ ও জাতির জন্য কোনো কল্যাণও বয়ে আনতে পারে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতিবাচক রাজনীতি ছেড়ে বিএনপির সংসদে ফিরে গিয়েই তাদের সব কথা বলা উচিত এবং সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিংকে স্বাগত জানানোর ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ধারা অনুসরণ করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। সেটাই হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের নিশ্চিত পথ।
১৩.৯.২০১১
এ দেশের রাজনীতিতে এখনো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা চলছে। গায়ের জোরেই মনমোহনের সফরকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা হচ্ছে। স্কেপগোট করা হচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। সব দোষ তাঁর। তাঁকে সরালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, আমরা ক্ষমতায় গেলে তিস্তার পানি চুক্তি করে ফেলব। এখন একটা 'যুদ্ধ' শুরু করতে হবে। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে যুদ্ধই। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সে রকম কথাই বলেছেন। হরতাল ছাড়া অন্য সব কর্মসূচি_বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ, রোড মার্চ, শোভাযাত্রা, লংমার্চ ইত্যাদি করবে বিএনপি। সেই সঙ্গে চেয়ারপারসন সারা দেশ সফর করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ_এসব দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে বিএনপি। গণমানুষের সমর্থন তারা কতটা পাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে কাগজে বেরিয়েছে, আওয়ামী লীগ নাকি সে আন্দোলনকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
আন্দোলন কতটা হবে, কেমন হবে, আদৌ হবে কি না_তা দেশবাসীরও জানা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সবাইকে কেমন একটা নির্লিপ্তই মনে হচ্ছে। তেমন একটা উৎসাহী মনে হচ্ছে না।
তবে এটা স্পষ্ট যে 'স্ট্রাইক দ্য আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট' নীতি অনুসরণ করে বিএনপি আন্দোলনে নামছে। সদ্য তিস্তা চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর দেশে সৃষ্ট একটা নেতিবাচক অবস্থা, একটা হতাশাজনক অবস্থাকেই বিএনপি ব্যাংক করতে চাইছে। আর সে জন্যই 'গিভ দ্য ডগ এ ব্যাড নেম বিফোর ইউ ওয়ান্ট টু স্ট্রাইক ইট' নীতিও অনুসরণ করে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে।
বলছে, দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে হবে। চিরকালই তারা দেশ বিক্রির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে থাকে। তার পরও ২০০৮ সালে গণমানুষের বিপুল ভোটেই জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
দিদির ইস্যু!
তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য দায়ী প্রকৃতপক্ষে কে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, না আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ও দূরদর্শিতার অভাব, দক্ষতার অভাব, দুই উপদেষ্টার ওপর নির্ভরতাই এ জন্য দায়ী কি না, নাকি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরই এটা কূটকৌশল মাত্র_এসব নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে দুই দেশেই। সাধারণের মধ্যে, আবার প্রচারমাধ্যমেও। শিগগিরই তিস্তা চুক্তি হবে_এমন আশাবাদ মহাজোট সরকারের দুই মন্ত্রী সৃষ্টি করলেও তার ওপরও মানুষ তেমন ভরসা রাখতে পারছে না। তিন মাসের মধ্যেই চুক্তি হবে_এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী এবং পানিসম্পদমন্ত্রী। ওদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীও গত ৭ সেপ্টেম্বরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত নৈশ ভোজেও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসার কারণেই এ অচলাবস্থা, তিনি কিন্তু মুখ খুলছেন না। তাঁর নীরবতার কারণ সম্পর্কেও নানা গুঞ্জন চলছে দুই দেশে। পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমও 'দিদির ইস্যু' বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
কোনো কোনো মহলের জল্পনা, সামনে মমতার উপনির্বাচন তো; তাই তিনি ওটা নিয়েই ব্যস্ত। আবার কেউ বলছেন, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, তাই তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে তাঁর অসুবিধা হয়। মমতা নিজে নাকি বলেছেন, উত্তরবঙ্গের মানুষের ক্ষতি করে তিনি কিছু করবেন না। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, যেটা খসড়া চুক্তিতে ছিল, বাংলাদেশ ২৫ শতাংশ পাবে, সেটা পরে পাল্টে দিয়ে ৪৮ ও ৫২ শতাংশ করাতেই তিনি গররাজি। সে জন্যই তিনি চুক্তি স্বাক্ষরে উপস্থিত থাকতে মনমোহনের সফরসঙ্গী হননি। বস্তুত এমন অনেক প্রশ্নই ধোঁয়াটে রয়ে গেছে। এসব নিয়ে এখন আর কেউ মাথাও ঘামাবে না, কারণ মমতা বলে দিয়েছেন, আগে তিস্তায় পানি থাকতে হবে তো, তারপর ভাগাভাগি। তিস্তায় পানিই নেই। ব্যাপারটা এরপর ঝুলেই থাকছে।
সচেতন দেশবাসীর অবশ্য বক্তব্য, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হলেও মনমোহনের সফরের গুরুত্ব খাটো করে দেখার কিছু নেই। এ মুহূর্তে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রটোকল, স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, বাংলাদেশের ৪৬টি গার্মেন্ট পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা সংক্রান্ত যে চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা-ই দুই দেশের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী করে তুলেছে, তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেছে। এই ভিত্তি অটুট থাকলেই তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তিসহ দুই দেশের অমীমাংসিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান নিশ্চিত।
বস্তুত প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজেই যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক; সেখানে এ চুক্তি হওয়ার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করা যায় না। তা ছাড়া তিনি ইতিমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করাতে এবার আমলার বদলে রাজনৈতিক দূত পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেকোনো সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই স্থায়ী সমাধানের নিশ্চয়তা দেয়। তিস্তা ও ফেনী নদীর ব্যাপারে ভারত এখন সেই পথই নিচ্ছে।
তিস্তার ব্যাপারে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) নিয়মিত বৈঠক না হওয়াতেই এ-সংক্রান্ত চুক্তি এতকাল সম্পাদিত হতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহনের দুই দিনের সফর শেষে ঢাকায় যে ৬৫ দফা যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতেই তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে সৃষ্ট ঐকমত্যকে স্বাগত জানিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত সম্ভব এ দুটি চুক্তি সম্পাদনের কাজ শেষ করতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিস্তা ও ফেনী নদীর ব্যাপারে এই আনুষ্ঠানিক নির্দেশই এ-সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের সব অনিশ্চয়তা দূর করে দিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞমহল মনে করছে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন ও জাতিসংঘ কনভেনশন
এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী সংক্রান্ত আইন, জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী ভারতে পদ্মা, তিস্তা, ফেনীসহ যে নদনদীর উৎস রয়েছে, তাদের পানি বণ্টনের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অলঙ্ঘনীয় বিধানই। ইন্টারনেট সূত্র বলছে, বিশ্বে ভূপৃষ্ঠের ৪৫ শতাংশ ভূমি নিয়ে ২৬১টি আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকা রয়েছে (কুমেরু বাদে) এবং একাধিক দেশে তা বিভক্ত। তবে তাদের আন্তসীমান্ত 'সারফেস ওয়াটার' বা ভূপৃষ্ঠের পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক প্রতিবেশী দেশের পক্ষেও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য বন্দোবস্তের মাধ্যমে পানি ভাগাভাগি একটি দুরূহ ব্যাপার। ইউরোপের বহু দেশ দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী দানিয়ুব ও রাইনের পানি ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার সমস্যার এখনো সুরাহা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০৪-৩ ভোটে আন্তর্জাতিক নদীর পানি নৌযান চালনা ছাড়া (নন-নেভিগেশন্যাল ইউজেস) অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারসংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন গৃহীত হয়। সে কনভেনশন বা সনদ ও আন্তর্জাতিক নদী আইনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার এমনভাবে (সমতার ভিত্তিতে) করার কথা বলা হয়েছে, যাতে পরস্পরের ক্ষতি সাধিত না হয় (নো হার্ম রুল)। এই বিধিবিধান বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদনদীর পানি ন্যায়সংগতভাবে বণ্টনের রক্ষাকবচ হিসেবে রয়েছে। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনও সমতার ভিত্তিতে হবে বলেই বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন।
বস্তুত, দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর শান্তিপূর্ণ পানিবণ্টনের এক রকম বাধ্যবাধকতাই বিদ্যমান। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে যতই ত্রুটিপূর্ণ থাক, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চুক্তি হওয়ায়ই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই আবার তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে দুই দেশের উদ্যোগ গ্রহণ এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হতে পারে, কিন্তু দুই দেশের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধই পরিশেষে তা সম্ভব করে তুলবে। লক্ষণীয়, অন্য সরকারগুলোর আমলে এর অভাবেই কোনো পানিবণ্টন চুক্তি হতে পারেনি।
আজ যারা নেতিবাচক রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত হওয়াকে পুঁজি করে আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে, তারা বস্তুত দেউলিয়া ও বন্ধ্যা রাজনীতির, নিছক ক্ষমতান্ধ রাজনীতির ধারক-বাহক। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তারা কোনো প্রকৃত ও যুক্তিসংগত সমর্থন পেতে পারে না। তাদের নেতিবাচক রাজনীতি দেশ ও জাতির জন্য কোনো কল্যাণও বয়ে আনতে পারে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতিবাচক রাজনীতি ছেড়ে বিএনপির সংসদে ফিরে গিয়েই তাদের সব কথা বলা উচিত এবং সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিংকে স্বাগত জানানোর ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ধারা অনুসরণ করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। সেটাই হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের নিশ্চিত পথ।
১৩.৯.২০১১
No comments