সহজ-সরল-সবাই ভাবতে শিখি আমিও মূল্যবান by কনকচাঁপা

ড়ক দুর্ঘটনার নির্মমতায় আমরা আমাদের জীবনের দিশা হারাতে বসেছি। অচেনা মানুষ, চেনা গুণীজন, প্রতিটা দিন, প্রতিনিয়তই হারাচ্ছি। এর যেন কোনো বিরাম নেই। আজ ১০০ জন তো কাল ৩০০ জন। আর কত প্রাণ বিসর্জন দিলে আমরা মুক্তি পাব! রূপকথার একটা গল্পে আছে, পুকুর কাটলে তাতে পানি না উঠলে দেও-দৈত্য পুকুরের মালিককে তার 'প্রিয়জন'কে পুকুরের মধ্যখানে ছেড়ে দিতে বলে। সেই প্রিয়জনকে ছেড়ে দিলে পুকুর পানিতে ভরে যায়।

এখানে কিন্তু একটা নীতিমালা ঠিক করে দেওয়া আছে_পুকুরের মালিকের একমাত্র সন্তানকে বলি দিতে হবে। এ রূপকথার মতো অনেক প্রাণ হয়তো আমাদের অজগররূপী রাস্তাকে উপঢৌকন দিতে হবে এ সড়কগুলো নিরাপদ করতে। কিন্তু আমরা যারা প্রাণ দিচ্ছি, তারা কি যোগাযোগমন্ত্রীর স্বজন, না কিছু হই। ওই রূপকথার করুণ গাঁথায় কিছু সকরুণ সততা আছে_আমাদের জীবনে কিন্তু তাও নেই। আমাদের দুর্ঘটনাগুলো কী শুধুই চালকদের দোষেই হয়? আপাত দৃষ্টিতে তাই হয়; তবে তার পেছনে বিশাল অরাজকতার গল্প আছে। ভুল লাইসেন্স, বিপদসংকুল পথ, ভয়ানক পথের বাঁক, হাস্যকর মাপের ডিভাইডার, অপ্রতুল পথনির্দেশিকা, এ ছাড়াও আছে পথচারীদের জ্ঞানহীনতা, গাড়ির মালিকদের অতিরিক্ত শোষণ, প্রশাসনের (রাস্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) দুর্নীতিপরায়ণতা ও চালকদের দায়বদ্ধহীনতা। আরো অনেক ফাঁকফোকর আছে, কত বলব! তবে যেটা বলতে চাই, সেটা হলো আমাদের চালকভাইদের আত্মমর্যাদাহীনতা। তাঁদের এই পেশায় নিয়োগ দেওয়ার সময় মালিক সম্প্রদায় এমনই বুঝিয়ে থাকে_'আমার গাড়ি বেশি মূল্যবান তোর চেয়ে তো বটেই, এমনকি যাত্রী, পথচারী ও রাস্তার অন্য সব গাড়ির চেয়েও।' তাঁদের নেই কোনো পোশাকনীতি। পাশের গাড়ি থেকে আগে যেতে হবে। রিকশা-ভ্যান এগুলো তো পথের পোকা, প্রাইভেট কার 'প্লাস্টিক'। তাঁরা জানেন মানুষ মারলে 'মালিক' ছাড়িয়ে নেবেনই। পথে পথে দাঁড়ানো বিশেষ পোশাকের অতিরিক্ত পকেটের মালিককে টোকেন ধরিয়ে দিলেই সব পার। গাড়িতে যারা বসে আছে, তারা খুব হলে এক খাঁচি মুরগা। জাতিগতভাবেই তারা মাদক, নয়তো পান-জর্দায় আসক্ত। গাড়ি তো চালান না, তাঁরা যেন ষাঁড়ের লড়াইয়ে নামেন। হয় জীবন, নয় মরণ! তাঁদের এই মনোভাব বড়ই ভয়ংকর। আমার কথা হলো তাঁরা জানেনই না, তাঁরা কত মূল্যবান দায়িত্ব পালন করছেন এবং কত সম্মানের অধিকারী তাঁরা। তাঁরা গাড়ি চালাচ্ছেন বলেই দেশটা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি গ্রে হাউন্ড নামের পরিবহন এবং এগুলোর এক একজন চালক। কী তাঁদের ব্যক্তিত্ব, কী দায়িত্ববোধ! গাড়িতে বসেই তাঁরা মাইক্রোফোনে গন্তব্য, বিরতি, সব কিছু সুন্দরভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের দেশের নামকরা কিছু পরিবহন আছে, তাতে টাই-শার্ট পরা কিছু সুপারভাইজার আছেন, তাঁরা মাউথপিসে এ দায়িত্ব পালন করেন। অথচ চালক আসেন মুখভর্তি পান নিয়ে লুঙ্গি পরে! অর্থাৎ যে ধরনের গাড়িই তাঁরা চালান না কেন, নিজেদের তাঁরা মোটেই সম্মান করেন না, করার শিক্ষাও তাঁরা কোথাও পাননি। আমার মতে, তাঁদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা, উপষঙ্গাদির সঙ্গে তাঁদের আত্মমর্যাদা লাভ করা ও উপযুক্ত আচার-ব্যবহার শিক্ষার একটা স্কুল খুলতে হবে। সেখানে তাঁদের জানতে দিতে হবে তাঁরা অনেক মূল্যবান মানুষ, অনেক দামি পেশায় তাঁরা নিয়োজিত। একজন চালককে একদিন অনুরোধ করেছিলাম ভাই, একটু সাবধানে যাবেন_'তিনি উত্তর দিলেন, শোনেন, আপনের বলতে হবে না_এত মূল্যবান গাড়ি, এই গাড়িরে বাঁচাইতেই আমি সাবধানে চালাব। আপনাকে ভাবতে হবে না।' সে আমার কথায় যে উত্তর দিল তাতে আমাকে মূল্যহীন তো বললই নিজের জীবনও মূল্যহীন, তাও জানিয়ে দিল। এ মানসিকতা থেকে পরিত্রাণ আমাদের পেতেই হবে। যোগাযোগমন্ত্রীর মতো এক সপ্তাহে (!) রাস্তা ঠিক করা যাবে না, ধীরে ধীরে সঠিক পদ্ধতিতে রাস্তা, আইন, অধিকার, সব কিছু ঠিক করতে হবে। সবার আগে জাগিয়ে তুলতে হবে গাড়ির চালকদের আত্মমর্যাদাবোধ। তাঁরা আমাদের চালিকাশক্তি, জাতীয় সম্পদ। তাঁরা ও আমরা সবাই ভাবতে শিখি আমিও মূল্যবান।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.