সময়ের কথা-ঈদে ঘরে ফেরা ও হজযাত্রী পরিবহনের অভিজ্ঞতা by অজয় দাশগুপ্ত
ঈদে নাড়ির টানে গ্রামে যেতে চায় লাখ লাখ মানুষ। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তাদের বিড়ম্বনার কথা সংবাদপত্রের পাতায় ফুটে উঠেছে। এখন আমরা টেলিভিশনের চিত্রে তা দেখছি। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। অনেক মানুষের গালমন্দ সহ্য করে। এ সুযোগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে।
ফেরিঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। রেলের একটি টিকিট পেতে সারা রাত অনেকে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করে এবং তা না পেয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কালোবাজারিদের হাতে সব টিকিট আগেই তুলে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করে। এ অবস্থায় সরকার কেন ভিন্নভাবে চিন্তা করবে না? বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো কেন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে না? তবে এ জন্য ভ্রমণকারীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকতে হবে\
প্রতি বছর হজের সময় সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য এক বা একাধিক দেশ থেকে বিমান ভাড়া করার রেওয়াজ আছে। অল্প কয়েক দিনের জন্য বিমান ভাড়া নেওয়া হয়ে থাকে। এর কারণ, হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি গমন করেন এবং তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে দেশে নিয়ে আসার কাজ বাংলাদেশ বিমানের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত যেসব বিমান সৌদি আরব যাতায়াত করে সেগুলো হজের সময়ের বাড়তি চাপ বহন করতে পারে না। এর পরও দেখা যায়, হাজার হাজার হজযাত্রী হজের কয়েক দিন, এমনকি তিন-চার সপ্তাহ আগেই সৌদি আরব চলে যান। ফেরার সময় দেখা যায়, যারা আগে যান তাদের আগে এবং যারা পরে যান তাদের পরে ফিরিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান বহরে বিমানের সংখ্যা খুব কম। হজের সময় ভিড় হয়_ এ যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাড়তি কয়েকটি বিমান সংগ্রহ করে বছরের বাকি সময় বসিয়ে রাখতে পারে না। এত অর্থ আমাদের নেই এবং থাকলেও এভাবে তা ব্যয় করা চলে না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় হিজবুল বাহার নামে একটি জাহাজ কেনা হয়েছিল হজযাত্রীদের আনা-নেওয়ার দায়িত্ব পালনের জন্য। দেখা গেল, এ জাহাজটিকেও সারা বছর বসিয়ে রাখতে হয় এবং তাতে লোকসানের বোঝা কেবল বাড়ে। অলস বসে থাকা এ জাহাজটিকে এ সেনাশাসক অবশ্য একবার রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেধাবী শিক্ষার্থীকে নিয়ে ওই জাহাজে চেপে সমুদ্র ভ্রমণে যান এবং তাদের তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শরিক হওয়ার অনুরোধ জানান। এতে ফায়দাও মেলে।
পরে একাধিকবার এ জাহাজটিতে কিছু লোককে পাঠানো হয় সমুদ্র যাত্রায়। এতে ভ্রমণ পিপাসা যেমন মেটে, দেশে ফেরার সময় অনেক বিদেশি পণ্যও নিয়ে আসা সম্ভব হয়। বলা প্রয়োজন যে, সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে বিদেশি পণ্য আমদানি করা সহজ ছিল না। আমদানি শুল্ক হার খুব বেশি থাকার কারণে এ দেশে বিদেশি পণ্যের দাম অনেক বেশি পড়ত। কিন্তু হিজবুল বাহারের যাত্রীদের জন্য প্রথমে শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই নানা ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য_ যেমন টু-ইন-ওয়ান, টেলিভিশন এবং পোশাক ইত্যাদি আনার সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও কোরবানির ঈদে ঢাকা থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু হাজার হাজার গ্রামে ছুটে যায়। এ সময় বাস-লঞ্চ ও ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় হয়। ট্রেনের একটি টিকিটের জন্য ২০-২৫ জন ভিড় করে। বাসের জন্য ভিড় হয় আরও বেশি। লঞ্চগুলোতেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা হয়। হজে যারা যেতে চান তাদের অনেকে ১৫-২০ দিন, এমনকি এক মাস আগেও সৌদি আরব চলে যান। আবার অনেকে হজ শেষ হওয়ার অনেক পরে দেশে আসেন। ঈদে যারা ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহর থেকে গ্রামে যান তাদের যদি বলা হয় যে ভিড় এড়াতে ১০-১৫ দিন আগেই বাস বা ট্রেন কিংবা লঞ্চে উঠে পড়তে হবে_ তাহলে ক'জন রাজি হবেন? প্রকৃতপক্ষে এটা বাস্তবসম্মত নয়। ছুটি মেলে ২-৪ দিন। ঈদে দারুণ ভিড় হয়, এ কারণে কি বাস কোম্পানিগুলো প্রচুর বাড়তি বাস কিনে সারা বছর বসিয়ে রাখবে? কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্বাভাবিক সময়ের ১০-১২ গুণ লোক যায়। তাদের জন্য বাড়তি বাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব? বাংলাদেশ রেলওয়ে কি ভিড় বিবেচনায় রেখে বাড়তি ইঞ্জিন ও বগি কিনে বছরের বাকি সময় শেডে ফেলে রাখবে? কয়েকটি কোম্পানি কি এ জন্য বাড়তি লঞ্চ সারা বছর ডকইয়ার্ডে বা জেটিতে ফেলে রাখবে? আমাদের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ যে কারণে এটা করে না, সড়ক-রেল-নৌপথেও একই কারণে এটা করা সম্ভব হয় না। তবে বিশেষ করে সড়ক ও রেলপথের ব্যবস্থাপনায় যারা যুক্ত তারা বিমানের কাছ থেকে এ বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারেন। পদ্ধতিটা হবে_ বিমানের মতোই অল্প কয়েক দিনের জন্য রেলগাড়ির বগি ও ইঞ্জিন এবং সড়ক পথের জন্য বাস ভাড়া করা। বাস ভাড়ার কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলে মনে হয়। এখন মূলত অভিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কের পথে একমাত্র বড় প্রাকৃতিক বাধা হচ্ছে পদ্মা নদী_ আরিচা ও মাওয়ায় এ জন্য রয়েছে ফেরি সার্ভিস। তবে পদ্মায় সেতু নির্মিত হলে এ বাধা থাকবে না। সরকার ও পরিবহন মালিকরা মিলে কয়েকটি কোম্পানিকে এ উদ্দেশ্যে বাস ভাড়ায় আমদানি করার দায়িত্ব দিতে পারে। বাংলাদেশের সড়ক পথে নানা দেশের তৈরি বাস ও প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করে। ঈদের সময়ের জন্য আমদানি করা বাস চালাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
রেলের ক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা হবে। রেলগাড়ি চলাচলের জন্য লাইন সীমিত। ডাবল লাইন রয়েছে অল্প পথে। তবে কথায় বলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। রেল কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিন ও বগি স্বল্পতার কারণে ঈদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে পারে না। ঈদের মৌসুমের জন্য তারা ভাড়া-পদ্ধতি গ্রহণ করতেই পারে। ভারত ও পাকিস্তানের সড়ক ও রেল ব্যবস্থা বাংলাদেশেরই অনুরূপ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ তিনটি দেশ অভিন্ন ছিল এবং তারাই সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করে। তাই পথের ধরন একই রয়ে গেছে।
নৌপথে লঞ্চ পাওয়া অবশ্য সহজ হবে না। আমাদের নদীপথে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন খরচ সড়ক ও রেলপথের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বছরের পর বছর নদীপথে ড্রেজিং কাজ দারুণ অবহেলা করায় অনেক নদীতে এমনকি ছোট লঞ্চও চলতে পারে না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টিমার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাল আমলে নদী পথের ড্রেজিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে বরিশাল বিভাগের যাত্রীদের জন্য ঈদের চাপ সামলাতে স্টিমার ভাড়ায় আমদানি করা যেতেই পারে।
বিমান ও হেলিকপ্টার সার্ভিসের কথাও এ সময় ভাবা যেতে পারে। সারা দিন ট্রেন বা বাসের ধকল না সহ্য করে এক বা দুই ঘণ্টায় ২৫-৩০ হাজার টাকায় কয়েকশ' কিলোমিটার যেতে চাইবে, এমন লোক বাংলাদেশে যথেষ্টই মিলবে। ইতিমধ্যেই হেলিকপ্টার সার্ভিস জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। তাদের কাছে টাইম ইজ মানি।
ঈদে নাড়ির টানে গ্রামে যেতে চায় লাখ লাখ মানুষ। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তাদের বিড়ম্বনার কথা সংবাদপত্রের পাতায় ফুটে উঠেছে। এখন আমরা টেলিভিশনের চিত্রে তা দেখছি। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। অনেক মানুষের গালমন্দ সহ্য করে। এ সুযোগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। ফেরিঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। রেলের একটি টিকিট পেতে সারা রাত অনেকে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করে এবং তা না পেয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কালোবাজারিদের হাতে সব টিকিট আগেই তুলে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করে। এ অবস্থায় সরকার কেন ভিন্নভাবে চিন্তা করবে না? বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো কেন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে না? তবে এ জন্য ভ্রমণকারীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এখনও তারা কিন্তু এটা করছে। তাদের পকেট কাটছে লঞ্চ ও বাসের মালিক-শ্রমিকরা।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের বেসরকারি পরিবহন খাতের অনেকেই মানুষের দুর্ভোগ থেকে ফায়দা নিতে আগ্রহী। ঈদের সময় পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা (একটি অংশ বিদেশ থেকে ভাড়ায় আনা) তাদের মধ্যে তেমন উৎসাহ সৃষ্টি করার কথা নয়। রেলের কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ বলবেন যে এটা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। আমার এ প্রস্তাব নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি প্রথমেই বললেন, এ পথেই রয়েছে সমাধান। আমাদের ঈদের উৎসবের সময় ভারতে সাধারণত বড় উৎসব থাকে না। এ কারণে বাস ও ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি ভাড়া পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা যে কানেকটিভিটির কথা বলছি, তার সুফল এভাবে আসতে পারে। অন্যান্য দেশ থেকেও এ ধরনের যানবাহন স্বল্প সময়ের মধ্যে আনা সম্ভব।
ঈদের আগে দেখা যায়, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস-লঞ্চে ছোটখাটো মেরামত করে রঙ লাগানো হয়। এতে ঝুঁকি আছে, কিন্তু বিকল্প কী আছে? উৎসবের সময় অনেক লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে এবং তাদের সামাল দিতে এতদিন এভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে। এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাবার এবং এ ক্ষেত্রে হজের সময়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে উৎসবে বিপুলসংখ্যক লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় এবং তাদের সবার জন্য নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোনো দেশ এটা পারে না। টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে। সময়সূচি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফেরিতে বিলম্ব ঘটবে। শীতের সময় হলে কুয়াশা বাগড়া দেবে। বর্ষা মৌসুম হলে ডুবোচরে লঞ্চ-স্টিমার আটকা পড়বে। তার পরও নারী-পুরুষ-শিশুরা ফিরে যেতে চাইবে শিকড়ে। এতেই যে আনন্দ!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
প্রতি বছর হজের সময় সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য এক বা একাধিক দেশ থেকে বিমান ভাড়া করার রেওয়াজ আছে। অল্প কয়েক দিনের জন্য বিমান ভাড়া নেওয়া হয়ে থাকে। এর কারণ, হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি গমন করেন এবং তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে দেশে নিয়ে আসার কাজ বাংলাদেশ বিমানের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত যেসব বিমান সৌদি আরব যাতায়াত করে সেগুলো হজের সময়ের বাড়তি চাপ বহন করতে পারে না। এর পরও দেখা যায়, হাজার হাজার হজযাত্রী হজের কয়েক দিন, এমনকি তিন-চার সপ্তাহ আগেই সৌদি আরব চলে যান। ফেরার সময় দেখা যায়, যারা আগে যান তাদের আগে এবং যারা পরে যান তাদের পরে ফিরিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান বহরে বিমানের সংখ্যা খুব কম। হজের সময় ভিড় হয়_ এ যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাড়তি কয়েকটি বিমান সংগ্রহ করে বছরের বাকি সময় বসিয়ে রাখতে পারে না। এত অর্থ আমাদের নেই এবং থাকলেও এভাবে তা ব্যয় করা চলে না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় হিজবুল বাহার নামে একটি জাহাজ কেনা হয়েছিল হজযাত্রীদের আনা-নেওয়ার দায়িত্ব পালনের জন্য। দেখা গেল, এ জাহাজটিকেও সারা বছর বসিয়ে রাখতে হয় এবং তাতে লোকসানের বোঝা কেবল বাড়ে। অলস বসে থাকা এ জাহাজটিকে এ সেনাশাসক অবশ্য একবার রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেধাবী শিক্ষার্থীকে নিয়ে ওই জাহাজে চেপে সমুদ্র ভ্রমণে যান এবং তাদের তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শরিক হওয়ার অনুরোধ জানান। এতে ফায়দাও মেলে।
পরে একাধিকবার এ জাহাজটিতে কিছু লোককে পাঠানো হয় সমুদ্র যাত্রায়। এতে ভ্রমণ পিপাসা যেমন মেটে, দেশে ফেরার সময় অনেক বিদেশি পণ্যও নিয়ে আসা সম্ভব হয়। বলা প্রয়োজন যে, সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে বিদেশি পণ্য আমদানি করা সহজ ছিল না। আমদানি শুল্ক হার খুব বেশি থাকার কারণে এ দেশে বিদেশি পণ্যের দাম অনেক বেশি পড়ত। কিন্তু হিজবুল বাহারের যাত্রীদের জন্য প্রথমে শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই নানা ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য_ যেমন টু-ইন-ওয়ান, টেলিভিশন এবং পোশাক ইত্যাদি আনার সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও কোরবানির ঈদে ঢাকা থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু হাজার হাজার গ্রামে ছুটে যায়। এ সময় বাস-লঞ্চ ও ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় হয়। ট্রেনের একটি টিকিটের জন্য ২০-২৫ জন ভিড় করে। বাসের জন্য ভিড় হয় আরও বেশি। লঞ্চগুলোতেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা হয়। হজে যারা যেতে চান তাদের অনেকে ১৫-২০ দিন, এমনকি এক মাস আগেও সৌদি আরব চলে যান। আবার অনেকে হজ শেষ হওয়ার অনেক পরে দেশে আসেন। ঈদে যারা ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহর থেকে গ্রামে যান তাদের যদি বলা হয় যে ভিড় এড়াতে ১০-১৫ দিন আগেই বাস বা ট্রেন কিংবা লঞ্চে উঠে পড়তে হবে_ তাহলে ক'জন রাজি হবেন? প্রকৃতপক্ষে এটা বাস্তবসম্মত নয়। ছুটি মেলে ২-৪ দিন। ঈদে দারুণ ভিড় হয়, এ কারণে কি বাস কোম্পানিগুলো প্রচুর বাড়তি বাস কিনে সারা বছর বসিয়ে রাখবে? কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্বাভাবিক সময়ের ১০-১২ গুণ লোক যায়। তাদের জন্য বাড়তি বাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব? বাংলাদেশ রেলওয়ে কি ভিড় বিবেচনায় রেখে বাড়তি ইঞ্জিন ও বগি কিনে বছরের বাকি সময় শেডে ফেলে রাখবে? কয়েকটি কোম্পানি কি এ জন্য বাড়তি লঞ্চ সারা বছর ডকইয়ার্ডে বা জেটিতে ফেলে রাখবে? আমাদের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ যে কারণে এটা করে না, সড়ক-রেল-নৌপথেও একই কারণে এটা করা সম্ভব হয় না। তবে বিশেষ করে সড়ক ও রেলপথের ব্যবস্থাপনায় যারা যুক্ত তারা বিমানের কাছ থেকে এ বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারেন। পদ্ধতিটা হবে_ বিমানের মতোই অল্প কয়েক দিনের জন্য রেলগাড়ির বগি ও ইঞ্জিন এবং সড়ক পথের জন্য বাস ভাড়া করা। বাস ভাড়ার কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলে মনে হয়। এখন মূলত অভিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কের পথে একমাত্র বড় প্রাকৃতিক বাধা হচ্ছে পদ্মা নদী_ আরিচা ও মাওয়ায় এ জন্য রয়েছে ফেরি সার্ভিস। তবে পদ্মায় সেতু নির্মিত হলে এ বাধা থাকবে না। সরকার ও পরিবহন মালিকরা মিলে কয়েকটি কোম্পানিকে এ উদ্দেশ্যে বাস ভাড়ায় আমদানি করার দায়িত্ব দিতে পারে। বাংলাদেশের সড়ক পথে নানা দেশের তৈরি বাস ও প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করে। ঈদের সময়ের জন্য আমদানি করা বাস চালাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
রেলের ক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা হবে। রেলগাড়ি চলাচলের জন্য লাইন সীমিত। ডাবল লাইন রয়েছে অল্প পথে। তবে কথায় বলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। রেল কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিন ও বগি স্বল্পতার কারণে ঈদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে পারে না। ঈদের মৌসুমের জন্য তারা ভাড়া-পদ্ধতি গ্রহণ করতেই পারে। ভারত ও পাকিস্তানের সড়ক ও রেল ব্যবস্থা বাংলাদেশেরই অনুরূপ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ তিনটি দেশ অভিন্ন ছিল এবং তারাই সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করে। তাই পথের ধরন একই রয়ে গেছে।
নৌপথে লঞ্চ পাওয়া অবশ্য সহজ হবে না। আমাদের নদীপথে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন খরচ সড়ক ও রেলপথের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বছরের পর বছর নদীপথে ড্রেজিং কাজ দারুণ অবহেলা করায় অনেক নদীতে এমনকি ছোট লঞ্চও চলতে পারে না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টিমার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাল আমলে নদী পথের ড্রেজিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে বরিশাল বিভাগের যাত্রীদের জন্য ঈদের চাপ সামলাতে স্টিমার ভাড়ায় আমদানি করা যেতেই পারে।
বিমান ও হেলিকপ্টার সার্ভিসের কথাও এ সময় ভাবা যেতে পারে। সারা দিন ট্রেন বা বাসের ধকল না সহ্য করে এক বা দুই ঘণ্টায় ২৫-৩০ হাজার টাকায় কয়েকশ' কিলোমিটার যেতে চাইবে, এমন লোক বাংলাদেশে যথেষ্টই মিলবে। ইতিমধ্যেই হেলিকপ্টার সার্ভিস জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। তাদের কাছে টাইম ইজ মানি।
ঈদে নাড়ির টানে গ্রামে যেতে চায় লাখ লাখ মানুষ। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তাদের বিড়ম্বনার কথা সংবাদপত্রের পাতায় ফুটে উঠেছে। এখন আমরা টেলিভিশনের চিত্রে তা দেখছি। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। অনেক মানুষের গালমন্দ সহ্য করে। এ সুযোগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। ফেরিঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। রেলের একটি টিকিট পেতে সারা রাত অনেকে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করে এবং তা না পেয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কালোবাজারিদের হাতে সব টিকিট আগেই তুলে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করে। এ অবস্থায় সরকার কেন ভিন্নভাবে চিন্তা করবে না? বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো কেন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে না? তবে এ জন্য ভ্রমণকারীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এখনও তারা কিন্তু এটা করছে। তাদের পকেট কাটছে লঞ্চ ও বাসের মালিক-শ্রমিকরা।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের বেসরকারি পরিবহন খাতের অনেকেই মানুষের দুর্ভোগ থেকে ফায়দা নিতে আগ্রহী। ঈদের সময় পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা (একটি অংশ বিদেশ থেকে ভাড়ায় আনা) তাদের মধ্যে তেমন উৎসাহ সৃষ্টি করার কথা নয়। রেলের কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ বলবেন যে এটা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। আমার এ প্রস্তাব নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি প্রথমেই বললেন, এ পথেই রয়েছে সমাধান। আমাদের ঈদের উৎসবের সময় ভারতে সাধারণত বড় উৎসব থাকে না। এ কারণে বাস ও ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি ভাড়া পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা যে কানেকটিভিটির কথা বলছি, তার সুফল এভাবে আসতে পারে। অন্যান্য দেশ থেকেও এ ধরনের যানবাহন স্বল্প সময়ের মধ্যে আনা সম্ভব।
ঈদের আগে দেখা যায়, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস-লঞ্চে ছোটখাটো মেরামত করে রঙ লাগানো হয়। এতে ঝুঁকি আছে, কিন্তু বিকল্প কী আছে? উৎসবের সময় অনেক লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে এবং তাদের সামাল দিতে এতদিন এভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে। এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাবার এবং এ ক্ষেত্রে হজের সময়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে উৎসবে বিপুলসংখ্যক লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় এবং তাদের সবার জন্য নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোনো দেশ এটা পারে না। টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে। সময়সূচি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফেরিতে বিলম্ব ঘটবে। শীতের সময় হলে কুয়াশা বাগড়া দেবে। বর্ষা মৌসুম হলে ডুবোচরে লঞ্চ-স্টিমার আটকা পড়বে। তার পরও নারী-পুরুষ-শিশুরা ফিরে যেতে চাইবে শিকড়ে। এতেই যে আনন্দ!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments