চরাচর-বেহাল ইদ্রাকপুর কেল্লা by আলম শাইন
ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুরের অবস্থান। কাগজে-কলমে জেলাটির নাম মুন্সীগঞ্জ হলেও সর্বসাধারণের কাছে এটি এখনো বিক্রমপুর নামেই পরিচিত। এ নামে পরিচয় দিতে স্থানীয় লোকজন স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি বেশ গর্বও বোধ করেন। আসলে বিক্রমপুর হলো গোটা পরগনার নাম, যেটা এখন আর বলা হয় না।
এখানে যেমন জন্মেছেন বহু জ্ঞানী-গুণী, মুনি-ঋষি; তেমনি রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনও। সংস্কারের অভাবে এইপুরাকীর্তিগুলো আজ বেহাল। তার একটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইদ্রাকপুর কেল্লা বা দুর্গ। এটি বর্তমান মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। পুরনো জেলখানার পাশের একটা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। দুর্গটি নির্মাণ করেছেন ষষ্ঠ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের বাংলার শাসক ও সেনাপতি মীর জুমলা। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে দুর্গটি নির্মাণ করেন তিনি। ঢাকার নৌ-প্রবেশপথের মুখে ইছামতী ও মেঘনা নদীর সংগমস্থলে দুর্গটি নির্মাণ করেন। বিশেষ কারণেই তিনি ইদ্রাকপুরে দুর্গটি নির্মাণ করেন। কারণটি হচ্ছে, সেকালে সব মোগল অভিযাত্রী রাজমহল থেকে পাবনার শাহজাদপুর হয়ে ইছামতী ও মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। ঠিক একই পথ দিয়ে তখন মগ, পর্তুগিজ জলদস্যুরাও যাতায়াত করত। বিষয়টি মাথায় এনে এবং সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নিরাপত্তার খাতিরে সেনাপতি মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছেন। বেশ চিত্তাকর্ষক নকশায় তৈরি এটি। দুর্গের ওপর (দ্বিতীয় তলা) প্রাচীরের গায়ে অসংখ্য ছোট খোপ রয়েছে। মূলত খোপগুলো ব্যবহৃত হতো বন্দুকের নল ঘোরানোর জন্য। মীর জুমলার সেনারা যাতে যুদ্ধের সময় দিক পরিবর্তন করতে বা শত্রুদের উদ্দেশে গুলি ছুড়তে সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য এ সুব্যবস্থা করেন। দুর্গের সিংহদ্বার দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই পড়ে একটি মস্ত সুড়ঙ্গপথ। কথিত আছে, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ দিয়ে এ সুড়ঙ্গপথটি মিলিত হয়েছে লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গপথের সঙ্গে, যাতে সেনারা দুর্যোগ-মুহূর্তে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে। অর্থাৎ দুই কেল্লার নিরাপদ সংযোগ সড়ক এটি। বর্তমানে সুড়ঙ্গটির মুখ বন্ধ রয়েছে। ইট, বালু, সুরকি, সিমেন্ট দিয়ে আস্তর করা হয়েছে। এতে সামান্যতম সৌন্দর্যহানি ঘটলেও উৎসুক জনতা এখন আর বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে না। এর আগে দর্শনার্থীরা সুড়ঙ্গের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার দুর্গটির সংস্কার করতে গিয়ে মূল কাঠামোটির সামান্য হেরফের করেছে। অবশ্য তাতে সৌন্দর্যহানি ঘটেনি তেমন একটা। সে কারণে সৌন্দর্যহানি না ঘটলেও অন্য কারণে মলিন হয়ে গেছে দুর্গের চেহারা। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে শীত মৌসুমে শিম ও লাউগাছের উপদ্রব। এ ছাড়া বর্তমানে এর বেহাল দেখে কেন জানি একটা অশনিসংকেত মেলে এর স্থায়িত্ব নিয়েও। অবস্থা এতই নাজুক যে এটি আর কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন স্থানীয় পুরাকীর্তি প্রেমিকরাও! তাই দ্রুত সংস্কারের দাবি তুলছেন তাঁরা।
আলম শাইন
No comments