কল্পকথার গল্প-'শুমার করিয়া দেখে' টোটাল ফাঁকি by আলী হাবিব

ণ্ডিত শুভঙ্করের নাম নিশ্চয় শুনেছেন? গণিত শাস্ত্রের খুব বিখ্যাত মানুষ তিনি। কেমন করে বিখ্যাত হলেন? কি এক ফাঁক নাকি ফাঁকি বের করে। আজকাল অবশ্য বিখ্যাত হওয়ার নানা উপায় আছে। বাজারে বইও বেরিয়েছে, বিখ্যাত হওয়ার এক হাজার উপায়। এই বই বের হওয়ার অনেক আগেই পণ্ডিত শুভঙ্কর বিখ্যাত। প্রকাণ্ড একটা শূন্য তাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে।


বইপত্রে তাঁর পরিচয় পাওয়া যায় একেবারেই সংক্ষিপ্ত আকারে। নিতান্তই কয়েকটি শব্দে। তিনি গণিত শাস্ত্রের কী একটা নিয়ম যেন বের করেছিলেন। সেই নিয়মটা জানা থাকলে কারো ঘরে শূন্য পড়বে না। এর বাইরে যদিও এই শুভঙ্কর সাহেবকে নিয়ে তেমন কোনো তথ্য আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না; কিন্তু তিনি বিখ্যাত। কথায় কথায় আমরা তাঁকে স্মরণ করি। তিনি আমাদের কোন বস্তুটি হরণ করেছেন, তা না জেনেই আমরা তাঁর নাম ধরে উদাহরণ দিই। আমাদের মুখের কথায় উঠে আসে গণিত শাস্ত্রের পণ্ডিত শুভঙ্করের নাম। কে তিনি? আমরা জানি না। না জানলেও কথায় কথায়, যথায়-তথায় তাঁকে স্মরণ করতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এমনকি আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গন, সেখানেও তাঁর সরব উপস্থিতি। সরব তো বটেই, উপস্থিতি সুরে ও ছন্দে। তাঁকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে, 'জানতাম যদি শুভঙ্করের ফাঁকি/আমার ঘরে পড়ত না ভাই শূন্য।' সুতরাং ধরেই নেওয়া যেতে পারে, আমাদের কল্পগল্পের এই শুভঙ্কর সাহেব কিংবা শুভঙ্কর মহাশয়, যিনি গণিত শাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি হিসাবটা খুব ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই না অমন একটি মোক্ষম সূত্র তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। আর সে কারণেই তো আজও তাঁকে কথায় কথায় স্মরণ করা হয়। তো, এই শুভঙ্কর সাহেবের সূত্র জানা কেন দরকার?
শুভঙ্করের হিসাব বা শুভঙ্করের সূত্র জানা না থাকলে সমূহ বিপদ। ওই যে, ঘরে শূন্য পড়ে যায়। অর্থাৎ কি না ফাঁকে কিংবা ফাঁকিতে পড়ে যেতে হয়। আবার ফাঁকে পড়া মানেই তো ফাঁকিতে পড়া। এই ফাঁক আর ফাঁকির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই শুভঙ্করের সূত্র জানা থাকাটা একান্ত প্রয়োজন। এটাই ব্রহ্মাস্ত্র। শুভঙ্করের ফাঁকি জানা না থাকলে ফাঁকটা বুঝে ওঠা যাবে না। ফাঁকটা বুঝে ওঠা না গেলে জীবনটা টোটাল ব্যর্থ হয়ে যাবে।
ফাঁক আর ফাঁকির মধ্যে খুব কাছাকাছি সম্পর্ক। ফাঁক থাকলে ফাঁকি দেওয়া যায়। আবার ফাঁকি দিলে ফাঁক থেকে যায়। ফাঁকি দেওয়ার অনেক কায়দা আছে। কায়দা জানলে ফায়দা লোটা যায়। না জানলে চিত্তির! কায়দা জানাটাই হচ্ছে আসল ব্যাপার। না জানলে কী হবে? একটা গল্প বলা যাক। স্বর্গ-নরকের গল্প। এখানেও গল্পের নায়ক এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের রোজ মর্নিং ওয়াক করার অভ্যাস। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো এক সকালে তিনি হাঁটতে বেরিয়েছেন। কিন্তু সেদিন বিধি বাম! রাস্তা দিয়ে চলা একটি গাড়ি উঠে গেল তাঁর গায়ের ওপর। ফল হচ্ছে পরপারে গমন। ভদ্রলোক ছিলেন এক বড় কম্পানির প্রধান নির্বাহী। অফিসে সব সময় নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। ওপারে যাওয়ার পর স্বর্গের দ্বাররক্ষক সেইন্ট পিটারের মুখোমুখি তিনি। সেইন্ট পিটার তাঁকে বললেন, 'আপনি মর্ত্যে একজন প্রধান নির্বাহী ছিলেন। আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে আপনার অফিসে। আমাদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আপনি স্বর্গে যাবেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ হচ্ছে, আপনাকে এক দিন স্বর্গে ও এক দিন নরকে কাটাতে হবে। যেহেতু আপনি আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাই এখানেও তেমন সুযোগ পাচ্ছেন। এখানেও স্বর্গ ও নরকে এক দিন থাকার পর আপনি বেছে নিতে পারবেন আপনার অনন্তকালের বাসস্থানের ঠিকানা। ভদ্রলোক বললেন, 'মর্ত্যে থাকতে স্বর্গের যে গল্প শুনেছি, তাতে আমি স্বর্গেই থাকতে চাই। নরক বড় ভয়ংকর জায়গা। নরকের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।' কিন্তু সেইন্ট পিটার মাথা নাড়লেন। তিনি বললেন, 'আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথার বাইরে যেতে পারি না। আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমি সেভাবেই কাজ করব। আপনাকে এক দিন স্বর্গে ও এক দিন নরকে থাকতে হবে।' ভদ্রলোক সেইন্ট পিটারের কথায় রাজি হলেন। রাজি না হয়েও তো উপায় নেই। তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো নরকে। ভদ্রলোক নরকে পা রাখতেই ছুটে এলেন তাঁর অনেক পুরনো সহকর্মী ও বন্ধু। তাঁরা এসে তাঁকে নিয়ে গেলেন নরকের ক্লাবে। তাস খেলতে খেলতে পুরনো দিনের গল্প করলেন তাঁরা। বেশ জম্পেশ খাওয়াদাওয়া হলো। নাচ-গানের আসর বসল। নরকের ২৪ ঘণ্টা বেশ আরামেই কাটল তাঁর। চমৎকার। এবার যেতে হবে স্বর্গে। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আবার উঠলেন চলন্ত সিঁড়িতে। সিঁড়ি এবার গেল স্বর্গে। সেইন্ট পিটার তাঁকে স্বর্গে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। স্বর্গে এসে ভদ্রলোক দেখলেন এখানকার আবহওয়াও বেশ চমৎকার। স্বর্গের অধিবাসীরা বেশ আছেন। নিজেদের মতো ঘুরছেন-ফিরছেন। এখানেও ক্লাব আছে। পান-ভোজন হলো। এখানকার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারও সেই পিটারের আগমন। তিনি ভদ্রলোককে নিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'এবার বলুন আপনি, আপনার শেষ ঠিকানা কোথায় হবে?' ভদ্রলোক বললেন, 'স্বর্গ ও নরকের কোনো ফারাক তো আমি দেখি না। আমি নরকেই থাকতে চাই। কারণ ওখানে আমার পরিচিত অনেকেই আছেন। ওখানেই আমার সময়টা ভালো কাটবে বলে মনে করি আমি।' ভদ্রলোককে নরকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তিনি এবার নরকে গিয়ে দেখেন, আগের সেই চেহারা নেই। নরক ফিরে গেছে সেই নরকের চেহারায়। তিনি এর কারণ জানতে চাইলেন। নরকের বাসিন্দারা জানালেন, 'গতকাল ছিল নরকের রিক্রুট করার দিন।' এই ভদ্রলোকও শুভঙ্করের ফাঁকিটা বুঝতেই পারেননি। সরল বিশ্বাসে নরকের নকল চেহারা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
স্বর্গ-নরকের আরেকটি গল্প। এক ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া হলো স্বর্গের সামনে। তিনি বাইরে থেকে স্বর্গ দেখলেন। এবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো নরকের সামনে। তিনি সামনে থেকে নরক দেখলেন। নরক দেখে তার খুব ভালো লেগে গেল। তিনি নরকে থাকতে চাইলেন। নরকে আবাসন স্থায়ী করা হলো তাঁর। তিনি নরকে গেলেন। এবার নরকে ঢুকতেই নরকের আসল চেহারা দেখতে পেলেন। আগের দিনের চেহারার সঙ্গে আজকের চেহারার কোনো মিল নেই কেন, জানতে চাইলেন তিনি। ভদ্রলোককে জানানো হলো, গতকাল নরকের সামনে স্ক্রিন সেভার দেওয়া ছিল।
এই স্ক্রিন সেভারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দৃশ্যের তুলনা করা চলে। ঈদের আগে দেশের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। রাস্তামন্ত্রীর অবস্থাও ছিল বেগতিক। তিনি রাস্তাঘাট মেরামত করলেন। ঈদের সময় সড়কপথে মানুষের যাতায়াত কমে গেল। চাপ পড়ল ট্রেনের ওপর। রাস্তামন্ত্রী বলে দিলেন, তিনি টোটাল রাস্তা ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু ঈদের পরই দেখা গেল তাপ্পি মারা সব রাস্তা টোটাল আগের চেহারায় ফিরে গেছে। তাহলে গ্রান্ড টোটাল কী দাঁড়াল? শুভঙ্করের ফাঁকির মতোই শূন্য! ফাঁক বুঝে কিছু লোকের পকেটের ফাঁক হয়তো পূরণ হয়ে গেছে। ফিরে এসেছে আগের সেই চেহারা। একেবারে টোটাল! পুঁথিতে অনেকেই পড়েছেন, 'লাখে লাখে মরে সৈন্য কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখে বিয়ালি্লশ হাজার'। আমাদের সব রাস্তাঘাট ঠিক হয়ে যাওয়ার পর এখন শুমার করে দেখা যাচ্ছে টোটাল...!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.