সাদাকালো-হঠাৎ মমতা : হতাশ বাংলাদেশ by আহমদ রফিক
সেপ্টেম্বর ৬, ২০১১। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর শুরু। দিন কয়েক থেকেই সরকারি-বেসরকারি মহলে কর্মব্যস্ততা। টিভি চ্যানেলের চেয়েও দৈনিক পত্রিকাগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে।
অনেকের ধারণা, এবার ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক বিশেষ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সে সম্ভাবনার মুখে আমাদের সরকারই নয়, নয়াদিলি্লও কিছুটা আলো ফেলেছে। শিবশঙ্কর মেননের আসা-যাওয়ার তৎপরতায় তেমন আভাস ফুটে ছিল।
তবে ঢাকায় সাজ সাজ রবের পাশাপাশি কী পেতে পারি, কতটা পেতে পারি এবং তা কতটা দেওয়ার বিনিময়ে এসব নিয়ে টিভি চ্যানেল, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, দৈনিকের পাতা খুবই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান 'এফবিসিসিআই' তো সংবাদ সম্মেলনে এমন বক্তব্যও রাখে যে ভারতকে ট্রানজিট দিলে স্বাগত জানাবে তারা। তবে সেই সঙ্গে তারা অবশ্য '৪৮০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের আহ্বান'ও জানায়। তবে প্রধান দৈনিকগুলোর লেখা ছিল যুক্তিনির্ভর, বাস্তবধর্মী। দুই প্রধানমন্ত্রীর হাসি হাসি মুখের ছবি ছেপেও কাগজগুলো ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। মানুষের অতি আকাঙ্ক্ষায় বাতাস দেয়নি।
তবু প্রত্যাশার ভারটা ছিল রীতিমতো বেশি। হয়তো এ কারণে যে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসা মানুষটি মনমোহন সিং। আর তেমন প্রত্যাশার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও। যেমন বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে একান্ত আলাপে বেশ কিছু ইতিবাচক মন্তব্যের পর মনমোহন সিং বলেন : 'দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য আমাদের অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে_এটা বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমাদের দায়।' সুপ্রতিবেশী বা বড় প্রতিবেশী হিসেবে দায়টা মেনে নিয়েই বলতে পেরেছেন যে 'ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'
এসব কারণেই ঢাকায় অনেক আশার প্রদীপ জ্বলেছে সরকারি, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী মহলে। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে কলকাতায় গেছে তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত রুপালি ইলিশের সর্বোচ্চ পরিমাণ চালান। এসব খবর তো বাত্ কি বাত্। বড় কথা হলো, বাংলাদেশের প্রত্যাশা যুক্তিসংগত দাবি পূরণে ভারতীয় পদক্ষেপ যেমন চুয়াত্তরের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, যা এই দীর্ঘ সময়েও লক্ষ্যে পেঁৗছায়নি। সে জন্য কি দরকার হবে আরেকবার ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্ব? সেটা সম্ভব নয় বলে ঢাকার ব্যবসায়ী মহল বা সাধারণ মানুষ থেকে দুই প্রান্তের ছিটমহলবাসী ও পানির অভাবক্লিষ্ট মানুষের প্রত্যাশা ছিল মনমোহন সিংয়ের সোনার কলম থেকে নেমে আসুক কিছু মানবিক প্রয়াসের প্রতিফলন। যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। ভারতের যুক্তিবাদী মানুষ বা প্রতিষ্ঠান কিন্তু বাংলাদেশের যুক্তিসংগত দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেনি।
যেমন বেশ কিছু দিন থেকেই বাংলাদেশ ভারতের বাজারে তার ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে আসছে। বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ প্রশ্ন নদীর পানি। গঙ্গাচুক্তিতে যা হোক একটা কিছু সমাধান হয়েছে। এবার গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা নদীর পানির ৫০ ভাগ দাবি করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির সম্ভাব্য সময়কাল ১৫ বছরের, যেখানে গঙ্গাচুক্তির মেয়াদকাল ৩০ বছর। অন্তর্বর্তীকালীন এ চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা বিষয়ে ও প্রান্ত থেকে সবুজ সংকেত না হলেও আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। তা ছাড়া জরুরি পর্যায়ে আলোচ্য বিষয় ছিল ফেনী নদীর পানি নিয়েও অনুরূপ ভাগবাটোয়ারা।
এর পরই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিটমহল বিনিময় ও দখলীকৃত জমি হস্তান্তর এবং অচিহ্নিত সীমানা নির্ধারণ। এ বিষয়টি মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নের কিছু পর থেকেই। পরে অনেক বৈঠক হয়েছে; কিন্তু সুরাহা হয়নি। তেমনি নতুন সীমান্ত সমস্যা, বিএসএফের মর্জি-মাফিক সীমান্ত হত্যার মতো অমানবিক সমস্যারও সমাধান ইদানীংকার ঘটনায় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা ছাড়া বাণিজ্য-বৈষম্য কমিয়ে আনাও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তত্ত্বগত ভারত প্রায়ই এর যৌক্তিকতা স্বীকার করে থাকে।
এ ছাড়া রয়েছে অনেক অনেক বিষয়_যেমন বিদ্যুৎ আমদানি, ঢাকায় ভারতীয় ভিসা পেতে সমস্যা কমানোর মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়াদি যেখানে ভারতীয় পক্ষ যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী (অন্তত তাদের বক্তব্যে তেমনটাই পরিস্ফুট) সে ক্ষেত্রে ভিসা নিয়ে সমস্যা (অনেকের মতে হয়রানি) বলাবাহুল্য অনভিপ্রেত এবং ওই সদিচ্ছার সমান্তরাল নয়। এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, টিভিতে অনেক আলোচনা হয়েছে; কিন্তু কোনো সুফল মেলেনি।
যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, যেখানে বাংলাদেশে এতগুলো ভারতীয় টিভি চ্যানেল সক্রিয় সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশি চ্যানেল ওপারে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যেতে আপত্তি কেন? আমরা যত দূর জানি ওপারের অনেকেই বাংলাদেশি টিভির অনুষ্ঠানাদি দেখতে আগ্রহী, খবর তো বটেই। এ প্রসঙ্গে একটি অপ্রিয় কথা বলি, ভারতীয় টিভি বা পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের খবর সামান্যই থাকে, অথচ ওখানকার মানুষ বিশেষত বাঙালিরা তা জানতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে বাধাটা কি ভিন্নভাষী বলয়ের? নাকি অন্য কোথাও।
মনে আছে, কয়েক দশক আগে বই এপার-ওপার নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা হয়েছিল। কলকাতার বেশ কিছুসংখ্যক নামি লেখক-শিল্পীর দাবিও ছিল যাতে ঢাকা থেকে বই যাওয়ার একটা ভালো ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তা হয়নি। আর গত দু-এক দশকের অভিজ্ঞতা বলে কলকাতায়ও পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোথাও বাংলাদেশি বইয়ের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু একধরনের সদিচ্ছার অভাবে তা যথাযথ মাত্রায় পূরণ হচ্ছে না। কিন্তু এদিক থেকে ইলিশের চাহিদা ঠিকই পূরণ হচ্ছে।
অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে বড় চাওয়া ছিল প্রধানত দুটো বিষয় নিয়ে। এক. ট্রানজিট, দুই. জঙ্গি দমন, যাতে বাংলাদেশের মাটি ও আশ্রয় ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী ব্যবহার করতে না পারে, যাতে তারা এখানে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা না পায়। দ্বিতীয় বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার সঠিকভাবে মোকাবিলা করেছে এবং তা ভারতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ভারতীয় সরকার তা স্বীকারও করে থাকে। তবে পানি নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে টানাপড়েনটা আজকের নয়, সেই ফারাক্কা বাঁধের আমল থেকে। স্মৃতিধর মানুষ মনে করতে পারবেন ভাসানীর ফারাক্কা মার্চের কথা।
স্বভাবতই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সদিচ্ছার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, দায় মেটানোর সদিচ্ছায় তাদের পক্ষে দেওয়ার দিকটাই বেশি। বেশি বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে। এক দেশ উপনিবেশবাদী মর্জিতে উদ্ভটভাবে বিভাজিত হওয়ার কারণে। পরিবারে হাঁড়ি ভাগ হলেও বোধ হয় বিরূপতার কিছু উপকরণ থেকেই যায়। একমাত্র সদিচ্ছাই পারে তা দূর করতে। প্রচলিত প্রবাদ বলে, এমন ক্ষেত্রে বড় তরফের দায়ই বেশি। বড় তরফ তা না মানলেই যত সমস্যা।
চলতি কথা_পানিই জীবন। এটা যেমন সত্য, ব্যক্তিজীবনে তেমনি সত্য জাতির জীবনে। চাষাবাদ থেকে বহু খাতে পানি অপরিহার্য উপকরণ। জলযোগ থেকে জল যোগাযোগ, শরীরী সরসতা থেকে মাটির আর্দ্রতা সর্বক্ষেত্রে জল বা পানি যে নামেই ডাকুন তার উপস্থিতি জীবনদায়ী। শেষ পর্যন্ত সেই পানির সমস্যাটাই অধরা রয়ে গেল। শোনা যাচ্ছিল বাংলাদেশের দাবির বিপরীতে ভারত তিস্তার পানির ৪৮ ভাগ বাংলাদেশকে দিতে রাজি ছিল। সেই সঙ্গে সদর্থক আলোচনা ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুঁয়েমিতে পানি চুক্তির ধারেকাছেও যাওয়া গেল না। অসহায় সজ্জন মনমোহন সিং ভারতের মতো শক্তিমান আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর জেদের কাছে তাঁর হার আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। মনে হয় মমতা মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য এর কারণও আছে, কারণটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘস্থায়ী বাম দুর্গ হটানোর যুদ্ধে বিজয়িনীকে কি চটানো যায়? বিশেষ করে বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর স্বার্থে? যদিও তিনি বিভাজিত কংগ্রেস হয়েও বিজেপির মসনদ আলোকিত করে আবার সময় বুঝে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস পারে তরী ভিড়িয়েছেন। বামপন্থার বোকামির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সহায় হয়েছিলেন। তাই তাঁর আচরণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী হলেও কি তাঁকে পাশ কাটানো যায়?
না, যায় না। তাই তিস্তাচুক্তি অমীমাংসিত রেখে ফেনী নদীর পানিবণ্টনের বিষয় আলোচনায় না এনে বহু প্রত্যাশার সফরটিকে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক দিক থেকে প্রায় অর্থহীন করে দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার দায় পূরণ করে দলবলসহ বিদায় নিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। অনেক অর্থের অপচয়, বিনিময়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সম্ভাবনার অপমৃত্যু। ব্যর্থতা দুই পক্ষেরই। কারণ তিস্তা, ফেনীর জলপ্রবাহ ঘিরে পানিচুক্তি যেমন বাংলাদেশের জন্য অতীব জরুরি, ততটা না হলেও ভারতের জন্য ট্রানজিটও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ প্রস্তাব ভারতের পক্ষ থেকে আজকের নয়। পানির বিনিময়ে ওই চুক্তি নিয়ে আলোচনার সম্মতিপত্র বিনিময় ভারতের জন্য ছিল বন্ধ দুয়ার খুলে যাওয়া নতুন সম্ভাবনার সূচনা। মমতাকে খুশি রাখতে গিয়ে ভারত সেটা হারাল। রাজনীতির ইঙ্গিতার্থে বলতে হয়, সুযোগ সব সময় আসে না। তবু চেষ্টা চলবে, তাই তিস্তাও বাদ পড়বে না এমন ধারণা দুই পক্ষেরই।
মানতে হয় যে এ সফরকে ঘিরে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল বলে বাংলাদেশের পক্ষে হতাশা, হাহাকার বেশি, তবে তা সরকার পক্ষে নয়। মূলত তা এ দেশের সংশ্লিষ্ট জনশ্রেণীর পক্ষে। দুই প্রধানমন্ত্রীই জানিয়েছেন 'বৈঠক ফলপ্রসূ'। কিভাবে ফলপ্রসূ? আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।' অন্যদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য একটু পরোক্ষ। তাঁর মতে, 'ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিকে তাঁরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ বিষয়ে ভারতেও জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে।'
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে 'জাতীয় ঐকমত্য' নিছক নান্দনিক, যা সুচয়িত শব্দেই প্রকাশ পায়, বাস্তবের ধূলি মাটিতে তার প্রকাশ ঘটে না। অবশ্য তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে 'দুই দেশের ছিটমহল ও দখলি জমিবিষয়ক সমস্যার সমাধান করা হবে।' তবে তাঁর পানিবিষয়ক আশ্বাসটি অস্পষ্ট। তিনি বলেছেন, 'তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন যাতে দুই দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়, সে বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।' হ্যাঁ আলোচনা।
ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, 'আলোচনা অব্যাহত রাখার তাৎপর্য! দীর্ঘস্থায়ী সে আলোচনায় কখনো মতৈক্যে পেঁৗছানো যায় না। আর এ ক্ষেত্রে তা আরো কঠিন বিশেষ করে বহু আলোচিত একগুঁয়ে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য। তাঁর মতে, বাংলাদেশ ২৫ শতাংশের বেশি পানি পেতে পারে না। কিন্তু কোন যুক্তিতে? তা তিনি স্পষ্ট করেননি। বাংলাদেশ আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বড়, জনসংখ্যাও বেশি। ব্যক্তি বা ভূখণ্ড দুদিক থেকেই বাংলাদেশ বেশি পানি পাওয়ার যুক্তিসংগত যোগ্যতা রাখে। সে ক্ষেত্রে ৪৮ শতাংশে রাজি হওয়া বাংলাদেশের জন্য উদার সদিচ্ছার পরিচায়ক। ভাগবাটোয়ারা এমন একটা বিষয়, সেখানে কোনো পক্ষেই সংকীর্ণ মানসিকতা প্রকাশের সুযোগ থাকে না। এক পক্ষকে যদি কিছু ছাড় দিতেই হয়, তাহলে রীতিনীতিমাফিক বড় তরফের পক্ষেই তা প্রযোজ্য। কিন্তু কে মানে রীতিনীতির কথা। তবে আমাদের বিশ্বাস, শুধু মমতা নন, কেন্দ্রীয় আমলা মহলের একাংশেও শর্ষের ভূত রয়ে গেছে, যাঁরা চান না সমতাভিত্তিক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তৈরি হোক। হলে তাতে ভারতেরও লাভ।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্যের কোঠায় নয়, এই যা রক্ষা। এ যাত্রায় একটি চুক্তি, একটি প্রটোকল ও আটটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নবিষয়ক সহযোগিতা চুক্তি, স্থল সীমান্তবিষয়ক প্রটোকল, ভারত ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল যাওয়ার রেলরুট ইত্যাদি। তা ছাড়া ৪৬টি বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা। এখানে একটি বিষয়ই উদ্বেগের, আর তা হলো স্বীকৃত বিষয়ের দ্রুত বাস্তবায়ন।
সার্ক গঠিত হয়েছিল অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। বৈঠকও কম হয়নি। কিন্তু ছোট দেশগুলো কোনো সুবিধাই পায়নি। এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিসা রহিত দূরে থাক, ভিসাব্যবস্থা সহজই হয়ে ওঠেনি। দিনকে দিন তা এ দেশের জন্য জটিল হয়েছে। আর সার্ক! সেটা তো এখন একটি অর্থহীন, নির্জীব সংস্থা, মৃত বললেও ভুল হয় না।
এ সফরে যাঁরা 'বাংলাদেশের ব্যর্থতা' দেখছেন, তাঁরা অন্ধ বিরোধীদলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন_এ কথাই বলতে হয়। অবাক হই যখন একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ এ বিষয়ে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মননশীলতা অন্ধ দলীয় আনুগত্যে জমা রাখেন। তাঁদের উদ্দেশে বলি, যতটাই হোক না পাওয়ার দায় ভারতের। ট্রানজিট বিষয় আলোচনা টেবিলে না এনে বাংলাদেশ সরকার সঠিক কাজ করেছে। এটাই এখন বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক 'বিজয়কার্ড'। কারণ ট্রানজিট ভারতের জন্য খুবই জরুরি, যেমন নিরাপত্তায়, তেমনি যোগাযোগে, পণ্যপরিবহনে। এ কার্ড দক্ষতার সঙ্গে খেলতে হবে।
সে জন্য দরকার বিচক্ষণ কূটনীতির, যেখানে বাংলাদেশ পক্ষে কিছুটা ঘাটতি আছে। সেটা যেভাবে হোক পূরণ করতে হবে। এ বিষয়ে এ দেশের পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে অনেক প্রত্যাশা মানুষের। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মেয়াদকালেই শুধু তিস্তা-ফেনীই নয়, অভিন্ন সব নদীর ন্যায্য পানি ও বঙ্গোপসাগরের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিছানো হোক না কূটনৈতিক পদক্ষেপের দাবা-পাশার ছক। আমরা দেখতে চাই আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী-ঘোড়া-গজের সুদক্ষ চাল, যাতে সমস্যার রাজা সহজেই মাত হয়।
সে ক্ষেত্রে হঠাৎ মমতার আবির্ভাবে হতাশ বাংলাদেশের জন্য ন্যায্য প্রাপ্তির সম্ভাবনার আলো জ্বলে উঠতেও পারে, যদিও তা অনেকটা নির্ভর করে বৃহৎ প্রতিবেশীর সদিচ্ছার ওপর। রাজনীতিতে 'সদিচ্ছা' শব্দটার অনেক গুরুত্ব। এর মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ চালের মতো খুঁটি বা কার্ড আমাদের হাতে আছে, দরকার এর সুদক্ষ ব্যবহার, যার নাম রাজনৈতিক কূটনীতি। সবশেষে একটা কথা : ড. মনমোহন সিং কিন্তু ফেরার পথেই জানিয়ে দিয়েছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খসড়া চুক্তির সব কিছুই বরাবর অবহিত করা হয়েছিল, তখন তাঁর দিক থেকে কোনো আপত্তি ওঠেনি। তাহলে হঠাৎ আপত্তির রহস্যটা কী? আমরা জানতে আগ্রহী।
লেখক: ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক
No comments