সংস্কার হয়নি হিন্দু বিবাহ আইন, ‘ইচ্ছা নেই, তবু বউ হয়ে থাকতে হচ্ছে’
কাজল ঘোষ: তৃণা দত্ত। অরূপ রায়। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক সরস্বতী পূজায় বন্ধুদের উপস্থিতিতে তৃণাকে সিঁদুর পরিয়ে স্ত্রী সম্বোধন করে অরূপ। রাঙা বউ বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু বছর পৃষ্ঠা ৮ কলাম ১
ঘুরতেই তৃণাকে অস্বীকার করে অরূপ। দু’জনের পরিবার বিষয়টি জানলেও আইনের কারণে কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। সিঁদুর পরা ছবি থাকলেও নিবন্ধন না হওয়ায় তৃণা আইনি সহায়তার জন্য বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিলেও কাজ হয়নি। শাস্তি হয়নি অরূপের।
ঘটনা-২: ভারতে পড়াশোনা করার সময় পরিচয় শুভাশিস আর অর্পিতার। পরিচয় থেকে প্রণয়। দু’জনেরই পরিবার বাংলাদেশে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে দু’জনই একে অন্যের কাছে ছুটে আসে সুদূর প্রবাসে। একসময় নিজেদের কাছে পেতে বিয়ে করে নিবন্ধন করেই। পড়াশোনা করে দেশে ফিরে দু’জনই তাদের ভুল বুঝতে পারে। ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। শুভাশিস-অর্পিতার সম্মতি থাকলেও বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ আইন না থাকায় কেউই কাউকে ছাড়তে পারছে না। বছরের পর বছর পৃথক থাকলেও তারা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় নিয়েই আছে। যৌথভাবে বিচ্ছেদ চাইলেও আইন না থাকায় তারা আটকে গেছে।
ঘটনা-৩: পারমিতার সঙ্গে বিবেকের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। বিবেক পেশায় চিকিৎসক। তাদের একটি ছেলে আছে দুই বছরের। সহকর্মী দিলারার সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করে বাসা ছাড়ে বিবেক। পারমিতার সামনে অন্ধকার। একটি সন্তান- অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে। আইনের দরবারে ধরনা দিয়েও কোন সুরাহা পায়নি সে। বিয়ে যেন একটি ছেলেখেলা বিবেকের কাছে। পারমিতার কাছে আজন্ম গ্লানির।
উল্লিখিত তিনটি ঘটনারই চরিত্র কাল্পনিক। বছরে এমন অন্তত এক থেকে দেড় শ’ দম্পতি আইনি সহায়তা চাইতে আসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। হিন্দু বিবাহের কোন আইন নেই। ইচ্ছা নেই, তবু বউ থেকে যাচ্ছে। এমন উদাহরণ অসংখ্য- যোগ করেন নীনা গোস্বামী। আইন সালিশ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক এই মানবাধিকার কর্মী কাজ করছেন প্রস্তাবিত খসড়া হিন্দু বিবাহ আইন নিয়ে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু বিবাহ আইনের খসড়া প্রস্তুত। নিবন্ধন, বহুবিবাহ আর বিবাহ বিচ্ছেদ। বর্তমানে কোন আইন না থাকায় হাজারো মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ১৯৪৬ সালের একটি ভরণপোষণ আইন আছে। তাতে দেখা গেছে, পৃথক থাকলেও স্বামী আজীবন ভরণপোষণ দিতে হবে স্ত্রীকে। স্ত্রীর মর্যাদা না চাইলেও তা বলবৎ থাকছে। এতদিন পর কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেকদিন থেকেই চেষ্টা চলছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণী চাইছে হিন্দু বিবাহ আইনটি যেন বাধ্যতামূলক না হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে পড়াশোনা বা চাকরি করতে গেলে বিবাহের নিবন্ধন সনদ দেখাতে হয়। তারা নিজেদের স্বার্থেই এটি চাইছেন। একটি সর্বজনীন বিবাহ আইন আমাদের এখনও হয়নি। প্রস্তাবিত আইনে পৌরাণিক বা প্রচলিত নিয়ম-কানুন মেনে বিয়ের যে রীতি তা বাদ দেয়া হয়নি। নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে সামাজিক আচার যা আছে তা-ই থাকবে। ১৯৪৭ সালের পর হিন্দু বিবাহ আইনের আর সংস্কার হয়নি। একেবারেই প্রাচীন আইন অনুযায়ী এগুলো হচ্ছে। এ জন্য কোর্টে যাওয়া। আইনের আওতায় আসার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা কোন সুবিধা পাচ্ছেন না। প্রস্তাবিত আইন ১৯৫৫ সালের ভারতের বিবাহ আইনকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। এতে কোন আচার-অনুষ্ঠানকেই বাদ দেয়া হয়নি। পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের বিধান রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, হিন্দু বিবাহের নিয়ম-কানুন এবং ডিভোর্সের বিষয়গুলো খসড়ায় তুলে ধরা হয়েছে। কখন সিঁদুর পরিয়ে, কখনও মন্দিরে বিয়ে হচ্ছে। কোন ডকুমেন্ট থাকছে না। এতে বনিবনা না হলে ডিভোর্স একটা উপায়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন না থাকায় সে ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।
খসড়া আইন প্রণয়নে সমন্বয়ক ছিলেন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর অর্পিতা দাস। তিনি জানান, আশির দশকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একটি কমিটি কিছু কাজ করলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রিপ ট্রাস্ট, বাঁচতে শেখা, নারীপক্ষসহ ৫০ সংগঠন নিয়ে গঠিত নাগরিক উদ্যোগ গত তিন বছর ধরে তিন হাজার ভুক্তভোগী নারীর জীবনকাহিনী নিয়ে প্রতিবেদন রচনা এবং ২০০ হিন্দু আইনজীবী ও স্থানীয় পর্যায়ের চার হাজার নারী-পুরুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে তৈরি করে খসড়া হিন্দু বিবাহ আইন। খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য ১২ই জানুয়ারি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে জমা দিয়েছে নাগরিক উদ্যোগ।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী খসড়া আইন প্রসঙ্গে বলেন, বিবাহ নিবন্ধন নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। এছাড়াও নিবন্ধন আইনের ৭৬ এর-এ (বি) ধারায় এক শ’ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে মুসলিমরা হেবা বা দান করতে পারে। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। সবাই যেন সমান সুযোগ পাই এমন দাবি আমরা করে আসছি অনেকদিন থেকেই। হিন্দু বিবাহ আইন করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় দিক থেকে নানা বাধা আছে। আদিকাল থেকে একেক অঞ্চলে একেক রকম রীতি চলে আসছে এবং একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ভিত্তিগুলো খুব মজবুত। একে একটি আইনি কাঠামোতে আনার পরিস্থিতি এখনও বাংলাদেশে নেই।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, খসড়াটি তিনি হাতে পেয়েছেন। প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে কিছু কিছু ভিন্নমতও রয়েছে। হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৩১শে জানুয়ারি একটি বৈঠক আছে। বিবাহ নিবন্ধন আইনের উদ্যোগ নেয়া হবে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মতো কিছুই করবে না সরকার- যোগ করেন আইনমন্ত্রী।
খসড়া হিন্দু বিবাহ আইনের
যা আছে-
৫০ সংগঠন নিয়ে গঠিত নাগরিক উদ্যোগের প্রস্তাবিত হিন্দু বিবাহ আইনের খসড়ায় হিন্দু বিবাহের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিবাহের সময় বর ও কনে মানসিকভাবে আইনসঙ্গত সম্মতি প্রদানে সক্ষম হইবেন এবং তাহাদের পূর্ণ সম্মতি থাকিতে হইবে; বিবাহে কনের বয়স অন্যূন ১৮ বছর ও বরের বয়স অন্যূন ২১ বছর হইতে হইবে। কনে ও বর ‘সপিণ্ড আত্মীয় বা নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়’ হইতে পারিবে না; বিবাহটি অবশ্যই এই আইন অনুসারে নিবন্ধন করিতে হইবে। বিবাহে ধর্মীয় প্রথা, নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন করা যাইবে।
বিবাহ নিবন্ধন অংশে বলা হয়েছে, সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলায় একজন হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ প্রদান করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষ অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং বর পক্ষের দুইজন সাক্ষী ও কনে পক্ষের দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এবং বর ও কনের সাক্ষ্য গ্রহণপূর্বক বিবাহ নিবন্ধন করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষের অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত ফরমে বিবাহের সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন।
বিবাহ সম্পন্ন হইবার দিন হইতে ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই বিবাহ নিবন্ধন করিতে হইবে। কোন অনিবার্য কারণে নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন না করিতে পারিলে ৩০০ টাকা বিলম্ব ফি সহ পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন করা যাইবে। বিবাহ নিবন্ধনের দায়িত্ব উভয় পক্ষের। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন পক্ষ বিবাহ নিবন্ধন করিতে অনীহা প্রকাশ করিলে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন অথবা তজ্জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ৩ মাসের কারাদণ্ড অথবা ২০০০ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। বর পক্ষ ও কনে পক্ষ কোনরূপ ধর্মীয় নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন ব্যতীত সরাসরি বিবাহ রেজিস্ট্রারের অফিসে বিবাহ নিবন্ধন করিতে পারিবেন; হিন্দু বিবাহ আইন-২০১১ পাস হইবার পূর্বে সম্পাদিত সকল বিবাহও পক্ষদ্বয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই আইন পাস হইবার পর যে কোন সময় নিবন্ধন করা যাইবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে বলা হয়েছে, স্বামী অথবা স্ত্রী একজন অন্যজনের উপর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন করলে; যে কোন একজন যদি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে; কোন একজন যদি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন এবং চিকিৎসা করানোর পরও যদি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে; কোন একজন যদি সংক্রামক কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া থাকেন যা চিকিৎসা দ্বারা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ অথবা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নাই বলিয়া চিকিৎসক সনদ প্রদান করেন; স্বামী স্ত্রীকে যদি একাধিক্রমে দুই বছর ধরে ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন; অত্র আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথকভাবে সমস্যাকালে স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন; অত্র আইনের ১১ ধারার প্রযোজ্য বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত স্বামী যদি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া থাকেন; স্বামী অথবা স্ত্রী যদি দুই বছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকেন; স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোন একজন কোন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে সাত বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হইলে; স্বামী অথবা স্ত্রী যদি একজন অন্যজনকে অপরাধমূলক কাজ করিতে বাধ্য করিয়া থাকেন; স্বামী বিবাহের সময় পুরুষত্বহীন থাকিলে এবং তাহা আবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বহাল থাকিলে আদালতে আবেদন করলে উভয়পক্ষের মতামতের ওপর ভিত্তি করিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করিবেন। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে, স্ত্রী গর্ভবতী থাকিলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হইবে না।
বহু বিবাহের ক্ষেত্রে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, একজন হিন্দু নারী ও একজন হিন্দু পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি কোন হিন্দু পুরুষ এক বা একাধিকবার অন্য কোন নারীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করিয়া থাকেন তাহা হইলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন অথবা অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন। এবং দণ্ডিত হইবার পর দণ্ডিত পুরুষের স্ত্রীর বিবাহে কোন বাধা থাকিবে না।
ঘুরতেই তৃণাকে অস্বীকার করে অরূপ। দু’জনের পরিবার বিষয়টি জানলেও আইনের কারণে কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। সিঁদুর পরা ছবি থাকলেও নিবন্ধন না হওয়ায় তৃণা আইনি সহায়তার জন্য বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিলেও কাজ হয়নি। শাস্তি হয়নি অরূপের।
ঘটনা-২: ভারতে পড়াশোনা করার সময় পরিচয় শুভাশিস আর অর্পিতার। পরিচয় থেকে প্রণয়। দু’জনেরই পরিবার বাংলাদেশে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে দু’জনই একে অন্যের কাছে ছুটে আসে সুদূর প্রবাসে। একসময় নিজেদের কাছে পেতে বিয়ে করে নিবন্ধন করেই। পড়াশোনা করে দেশে ফিরে দু’জনই তাদের ভুল বুঝতে পারে। ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। শুভাশিস-অর্পিতার সম্মতি থাকলেও বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ আইন না থাকায় কেউই কাউকে ছাড়তে পারছে না। বছরের পর বছর পৃথক থাকলেও তারা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় নিয়েই আছে। যৌথভাবে বিচ্ছেদ চাইলেও আইন না থাকায় তারা আটকে গেছে।
ঘটনা-৩: পারমিতার সঙ্গে বিবেকের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। বিবেক পেশায় চিকিৎসক। তাদের একটি ছেলে আছে দুই বছরের। সহকর্মী দিলারার সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করে বাসা ছাড়ে বিবেক। পারমিতার সামনে অন্ধকার। একটি সন্তান- অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে। আইনের দরবারে ধরনা দিয়েও কোন সুরাহা পায়নি সে। বিয়ে যেন একটি ছেলেখেলা বিবেকের কাছে। পারমিতার কাছে আজন্ম গ্লানির।
উল্লিখিত তিনটি ঘটনারই চরিত্র কাল্পনিক। বছরে এমন অন্তত এক থেকে দেড় শ’ দম্পতি আইনি সহায়তা চাইতে আসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। হিন্দু বিবাহের কোন আইন নেই। ইচ্ছা নেই, তবু বউ থেকে যাচ্ছে। এমন উদাহরণ অসংখ্য- যোগ করেন নীনা গোস্বামী। আইন সালিশ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক এই মানবাধিকার কর্মী কাজ করছেন প্রস্তাবিত খসড়া হিন্দু বিবাহ আইন নিয়ে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু বিবাহ আইনের খসড়া প্রস্তুত। নিবন্ধন, বহুবিবাহ আর বিবাহ বিচ্ছেদ। বর্তমানে কোন আইন না থাকায় হাজারো মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ১৯৪৬ সালের একটি ভরণপোষণ আইন আছে। তাতে দেখা গেছে, পৃথক থাকলেও স্বামী আজীবন ভরণপোষণ দিতে হবে স্ত্রীকে। স্ত্রীর মর্যাদা না চাইলেও তা বলবৎ থাকছে। এতদিন পর কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেকদিন থেকেই চেষ্টা চলছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণী চাইছে হিন্দু বিবাহ আইনটি যেন বাধ্যতামূলক না হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে পড়াশোনা বা চাকরি করতে গেলে বিবাহের নিবন্ধন সনদ দেখাতে হয়। তারা নিজেদের স্বার্থেই এটি চাইছেন। একটি সর্বজনীন বিবাহ আইন আমাদের এখনও হয়নি। প্রস্তাবিত আইনে পৌরাণিক বা প্রচলিত নিয়ম-কানুন মেনে বিয়ের যে রীতি তা বাদ দেয়া হয়নি। নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে সামাজিক আচার যা আছে তা-ই থাকবে। ১৯৪৭ সালের পর হিন্দু বিবাহ আইনের আর সংস্কার হয়নি। একেবারেই প্রাচীন আইন অনুযায়ী এগুলো হচ্ছে। এ জন্য কোর্টে যাওয়া। আইনের আওতায় আসার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা কোন সুবিধা পাচ্ছেন না। প্রস্তাবিত আইন ১৯৫৫ সালের ভারতের বিবাহ আইনকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। এতে কোন আচার-অনুষ্ঠানকেই বাদ দেয়া হয়নি। পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের বিধান রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, হিন্দু বিবাহের নিয়ম-কানুন এবং ডিভোর্সের বিষয়গুলো খসড়ায় তুলে ধরা হয়েছে। কখন সিঁদুর পরিয়ে, কখনও মন্দিরে বিয়ে হচ্ছে। কোন ডকুমেন্ট থাকছে না। এতে বনিবনা না হলে ডিভোর্স একটা উপায়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন না থাকায় সে ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।
খসড়া আইন প্রণয়নে সমন্বয়ক ছিলেন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর অর্পিতা দাস। তিনি জানান, আশির দশকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একটি কমিটি কিছু কাজ করলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রিপ ট্রাস্ট, বাঁচতে শেখা, নারীপক্ষসহ ৫০ সংগঠন নিয়ে গঠিত নাগরিক উদ্যোগ গত তিন বছর ধরে তিন হাজার ভুক্তভোগী নারীর জীবনকাহিনী নিয়ে প্রতিবেদন রচনা এবং ২০০ হিন্দু আইনজীবী ও স্থানীয় পর্যায়ের চার হাজার নারী-পুরুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে তৈরি করে খসড়া হিন্দু বিবাহ আইন। খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য ১২ই জানুয়ারি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে জমা দিয়েছে নাগরিক উদ্যোগ।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী খসড়া আইন প্রসঙ্গে বলেন, বিবাহ নিবন্ধন নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। এছাড়াও নিবন্ধন আইনের ৭৬ এর-এ (বি) ধারায় এক শ’ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে মুসলিমরা হেবা বা দান করতে পারে। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। সবাই যেন সমান সুযোগ পাই এমন দাবি আমরা করে আসছি অনেকদিন থেকেই। হিন্দু বিবাহ আইন করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় দিক থেকে নানা বাধা আছে। আদিকাল থেকে একেক অঞ্চলে একেক রকম রীতি চলে আসছে এবং একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ভিত্তিগুলো খুব মজবুত। একে একটি আইনি কাঠামোতে আনার পরিস্থিতি এখনও বাংলাদেশে নেই।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, খসড়াটি তিনি হাতে পেয়েছেন। প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে কিছু কিছু ভিন্নমতও রয়েছে। হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৩১শে জানুয়ারি একটি বৈঠক আছে। বিবাহ নিবন্ধন আইনের উদ্যোগ নেয়া হবে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মতো কিছুই করবে না সরকার- যোগ করেন আইনমন্ত্রী।
খসড়া হিন্দু বিবাহ আইনের
যা আছে-
৫০ সংগঠন নিয়ে গঠিত নাগরিক উদ্যোগের প্রস্তাবিত হিন্দু বিবাহ আইনের খসড়ায় হিন্দু বিবাহের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিবাহের সময় বর ও কনে মানসিকভাবে আইনসঙ্গত সম্মতি প্রদানে সক্ষম হইবেন এবং তাহাদের পূর্ণ সম্মতি থাকিতে হইবে; বিবাহে কনের বয়স অন্যূন ১৮ বছর ও বরের বয়স অন্যূন ২১ বছর হইতে হইবে। কনে ও বর ‘সপিণ্ড আত্মীয় বা নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়’ হইতে পারিবে না; বিবাহটি অবশ্যই এই আইন অনুসারে নিবন্ধন করিতে হইবে। বিবাহে ধর্মীয় প্রথা, নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন করা যাইবে।
বিবাহ নিবন্ধন অংশে বলা হয়েছে, সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলায় একজন হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ প্রদান করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষ অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং বর পক্ষের দুইজন সাক্ষী ও কনে পক্ষের দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এবং বর ও কনের সাক্ষ্য গ্রহণপূর্বক বিবাহ নিবন্ধন করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষের অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত ফরমে বিবাহের সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন।
বিবাহ সম্পন্ন হইবার দিন হইতে ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই বিবাহ নিবন্ধন করিতে হইবে। কোন অনিবার্য কারণে নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন না করিতে পারিলে ৩০০ টাকা বিলম্ব ফি সহ পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন করা যাইবে। বিবাহ নিবন্ধনের দায়িত্ব উভয় পক্ষের। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন পক্ষ বিবাহ নিবন্ধন করিতে অনীহা প্রকাশ করিলে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন অথবা তজ্জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ৩ মাসের কারাদণ্ড অথবা ২০০০ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। বর পক্ষ ও কনে পক্ষ কোনরূপ ধর্মীয় নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন ব্যতীত সরাসরি বিবাহ রেজিস্ট্রারের অফিসে বিবাহ নিবন্ধন করিতে পারিবেন; হিন্দু বিবাহ আইন-২০১১ পাস হইবার পূর্বে সম্পাদিত সকল বিবাহও পক্ষদ্বয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই আইন পাস হইবার পর যে কোন সময় নিবন্ধন করা যাইবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে বলা হয়েছে, স্বামী অথবা স্ত্রী একজন অন্যজনের উপর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন করলে; যে কোন একজন যদি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে; কোন একজন যদি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন এবং চিকিৎসা করানোর পরও যদি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে; কোন একজন যদি সংক্রামক কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া থাকেন যা চিকিৎসা দ্বারা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ অথবা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নাই বলিয়া চিকিৎসক সনদ প্রদান করেন; স্বামী স্ত্রীকে যদি একাধিক্রমে দুই বছর ধরে ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন; অত্র আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথকভাবে সমস্যাকালে স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন; অত্র আইনের ১১ ধারার প্রযোজ্য বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত স্বামী যদি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া থাকেন; স্বামী অথবা স্ত্রী যদি দুই বছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকেন; স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোন একজন কোন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে সাত বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হইলে; স্বামী অথবা স্ত্রী যদি একজন অন্যজনকে অপরাধমূলক কাজ করিতে বাধ্য করিয়া থাকেন; স্বামী বিবাহের সময় পুরুষত্বহীন থাকিলে এবং তাহা আবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বহাল থাকিলে আদালতে আবেদন করলে উভয়পক্ষের মতামতের ওপর ভিত্তি করিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করিবেন। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে, স্ত্রী গর্ভবতী থাকিলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হইবে না।
বহু বিবাহের ক্ষেত্রে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, একজন হিন্দু নারী ও একজন হিন্দু পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি কোন হিন্দু পুরুষ এক বা একাধিকবার অন্য কোন নারীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করিয়া থাকেন তাহা হইলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন অথবা অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন। এবং দণ্ডিত হইবার পর দণ্ডিত পুরুষের স্ত্রীর বিবাহে কোন বাধা থাকিবে না।
No comments