সময়ের প্রতিধ্বনি-রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের by মোস্তফা কামাল

০০৭-২০০৮ সালে কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ১২টি উপজেলায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় নাম লেখায়। এ নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় বিষয়টি নজরে আসে নির্বাচন কমিশনের। ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখে এবং অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর ৪৮ হাজার ৬৭৩ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়। এরপর ধারণা করা হয়েছিল, রোহিঙ্গারা হয়তো এ প্রক্রিয়ায় ভোটার হওয়ার চেষ্টা করবে না।


কিন্তু চলতি বছর যখন নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিল, তখনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। শুরুতেই দেখা গেল, নতুন ভোটার আবেদনকারীদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এই তথ্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
আরো উদ্বেগের বিষয়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতার ঘটনাটি। অনেক আগে থেকেই গণমাধ্যমে রিপোর্ট বের হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অথবা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে প্রতিনিয়তই রোহিঙ্গারা এ দেশে আসছে। তারা কঙ্বাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবান এলাকায় বনভূমি উজাড় করে বসতি গাড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। তারা ওই অঞ্চলের সামাজিক সমস্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের অশুভ তৎপরতায় স্থানীয়রাও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তাদের ভিড়ে কঙ্বাজারের হাসপাতালগুলোতে স্থানীয়দের চিকিৎসাসেবা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রাঙামাটিতে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাদের আসা কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
সম্প্রতি উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা পাকিস্তান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। সেসব দেশে তারা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো সাহায্য সংস্থার নামে ছদ্মবেশে টেকনাফে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আল হারমাইন সমন্বিত মানবিক উদ্যোগ নামে পরিচালিত হচ্ছে। রোহিঙ্গারা মানবপাচারের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গাদের অসামাজিক কর্মকাণ্ড, জঙ্গি তৎপরতা এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং ভোটার তালিকায় নাম লেখানো প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রতিনিয়তই রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে গেছে। তারা ওমরা হজ পালনের নামে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তারা জড়িত।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কঙ্বাজারের নয়াপাড়া ও কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুটি শিবিরে ২৫ হাজার তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ ন্যুব্জ। তার ওপর রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপ সহ্য করা এই দেশটির পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ বছরের পর বছর জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের বোঝা। এখন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করছে।
এখান থেকে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যও পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড ও কানাডায় পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখনো ইউএনএইচসিআরের এই চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। তা না করে তারা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও জাতিসংঘ) আলোচনা খুবই জরুরি। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ উদ্যোগ নিতে পারে। জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করবে। অথচ জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা খুবই রহস্যজনক। এই প্রতিষ্ঠানটি কার পক্ষে কাজ করছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এ অঞ্চল থেকে তারা সময় সময় আরাকানে গিয়ে বসতি গেড়েছে। তারা আসলে মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তাই ১৯৯১ সালে আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালায় জান্তা সরকার। সরকারের নিপীড়নমূলক নীতির কারণে ১৯৯১-১৯৯২ সালে আরাকান ছাড়তে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
জাতিসংঘের সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও ২০ থেকে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। দুটি শরণার্থী শিবিরে তাদের রাখা হয়েছে। ইউএনএইচসিআর তাদের খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তাদের বড় স্বার্থ। আর শরণার্থী শিবিরকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করছে কিছু জঙ্গি সংগঠন।
দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী মাঠে নেমেছে। তারা দেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলোকে এ কাজে ব্যবহার করছে। এদের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছে রোহিঙ্গারা।
গত (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১) কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থী মিলে ১০ হাজার ভয়ংকর অপরাধী। তাদের হাতে রয়েছে রকেট লঞ্চার, এম-১৬ রাইফেলসহ নানা ধরনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম। মানবপাচার, জঙ্গি তৎপরতা, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে তারা জড়িত। পার্বত্য অঞ্চলের গহিন অরণ্যে তাদের অস্ত্রের কারখানাও রয়েছে।
আরেকটি পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, রোহিঙ্গারা অস্ত্র কেনার জন্য ২০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা এ তহবিল সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। মাদকপাচারের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বিজিবির হাতে। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে টেকনাফ পৌরসভার বাসস্ট্যান্ডে বিজিবি জওয়ানরা অভিযান চালিয়ে এক হাজার ১০টি ইয়াবাসহ সেতারা বেগম ও তার স্বামী মো. খানকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা উভয়ই রোহিঙ্গা। এর আগে ১৫ আগস্ট টেকনাফ সদরের জওয়ানরা ট্রানজিট নিয়ে আসা মিয়ানমারের মংডু শহরের মোহাম্মদ শহীদকে ৯৮৯টি ইয়াবাসহ আটক করেছে।
এ ধরনের হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে। রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েরা বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায়ও তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করতেই হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ সামনে আরো ভয়ংকর সংকটে পড়বে।
এ সমস্যার সমাধান শুধু কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে সম্ভব হবে না। ওইসব নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা বৈঠক অনেক হয়েছে। এখন প্রতিরোধ করার সময়। রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধ করা ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুটি আর মানবিক ইস্যু নেই। রোহিঙ্গা আমাদের জন্য জাতীয় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা জানি, ভারতের পর মিয়ানমার আমাদের নিকট-প্রতিবেশী দেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তবে সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই দেশের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। সমুদ্রসীমার ব্যাপারে উভয় পক্ষের দাবি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা চলছে। এ সমস্যাটির সমাধান নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু এর চেয়েও বড় মনে হয় রোহিঙ্গা সমস্যা। সরকারের আর অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনে সরকার ভারতের মতো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারে। প্রতিবেশীদের সম্মানের বিষয়টি বিবেচনা না করে ভারত যদি তার সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের অসুবিধা কোথায়? ভারতও তো বলছে, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তারা কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের চার হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সামর্থ্য হয়তো নেই। কিন্তু ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়া বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয়ই কঠিন ব্যাপার নয়।
আবার অন্য পন্থাও অবলম্বন করা যেতে পারে। মিয়ানমারকে বোঝাতে সরকার চীন এবং ভারতকে ব্যবহার করতে পারে। এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে চীন এবং ভারত মিয়ানমারকে অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই রাখবে। অতীতে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সমুদ্রে গ্যাস আহরণ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ দেখা দিয়েছিল। মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিল। প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশও। সেই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ চীনের সহযোগিতা চেয়েছিল। চীনের অনুরোধে তখন মিয়ানমার তাদের যুদ্ধজাহাজ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং দুদেশের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখনো চীন এবং ভারতকে কাজে লাগানো যেতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.