চলতি পথে-আলো ঝলমল সকালে...
আলো ঝলমল প্রাণোচ্ছল সকাল। কিন্তু সেই উচ্ছলতার কোনো ছোঁয়াই নেই ময়মনসিংহ শহরের সুপরিচিত বিপিন পার্কে। ময়মনসিংহ পৌরসভার একসময়ের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ডা. বিপিন বিহারী সেনের স্মৃতিবহনকারী এ পার্কটি এখন ময়লা-আবর্জনার বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল।
অথচ এই বিপিন পার্ক ময়মনসিংহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলনসহ অগণন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিভারে পূর্ণ! দেশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ময়মনসিংহের রাজনীতি-সচেতন জনতা বারবার জড়ো হয়েছেন বিপিন পার্কে। ব্রহ্মপুত্র নদ সাক্ষী রেখে শপথ নিয়েছেন তাঁরা, অবতীর্ণ হয়েছেন ন্যায়যুদ্ধে। ফলে সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে সংগ্রামী মানুষের হাতের মুঠোয়। কিন্তু আজ, বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার এই বিপিন পার্কের দৈন্যদশা হতাশ করে আমাদের। অনাকাঙ্ক্ষিত এই হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় পার্ক এলাকা অতিক্রম করি আমরা। নতমুখী চেতনাকে সমুন্নত করার চেষ্টায় হাঁটতে থাকি সামনে। খানিকটা পথ এগোতে না এগোতেই ময়মনসিংহ শহরের একটি জনহিতকর প্রাচীন প্রকল্প। প্রকল্পটি সাধারণ্যে ‘রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস’ নামে পরিচিত। সহধর্মিণী রাজরাজেশ্বরী দেবীর নামে শতাব্দীপ্রাচীন এই যান্ত্রিক প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠা করেন ময়মনসিংহের খ্যাতিমান জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি সকরুণ ইতিহাস। জানা যায়, বিয়ের পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর সহধর্মিণী রাজরাজেশ্বরী দেবী কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি হলো তাঁর। ময়মনসিংহ ও কলকাতার বিজ্ঞ চিকি ৎ সকেরা রাজরাজেশ্বরী দেবীর আরোগ্য লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই কৃতকার্য হলেন না তাঁরা। রাজরাজেশ্বরী দেবীর রোগযন্ত্রণা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে লাগল। দীর্ঘ রোগভোগের শেষ পর্যায়ে রাজরাজেশ্বরী দেবীর বায়ু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন অনন্যোপায় চিকি ৎ সকেরা। পরম করুণাময়ের কৃপা লাভের জন্য তীর্থ পর্যটনের উপদেশও দিলেন কেউ কেউ। সে অনুযায়ী মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী গ্রহণ করলেন ব্যবস্থা। কিন্তু বিধি বাম! ১৮৮৮ সালে নৌকাযোগে তীর্থ পর্যটনে যাওয়ার সময় গঙ্গাবক্ষে হঠা ৎ কলেরায় আক্রান্ত হলেন রাজরাজেশ্বরী দেবী।
কলেরা মূলত জলবাহিত রোগ। দূষিত জল এ রোগটির অন্যতম বাহক। নৌকায় অবস্থানকালে নদীর দূষিত জল গ্রহণের ফলেই রোগাক্রান্ত হন রাজরাজেশ্বরী দেবী। সে সময় সুপেয় জলের ভীষণ অভাব ছিল সর্বত্র। তাই রোগমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাজরাজেশ্বরী দেবীকে নদীর দূষিত জল গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য হন চিকি ৎ সকেরা। সুপেয় জলের জন্য নৌকা তীরে ভিড়ানোর চেষ্টা করা হয় দ্রুত। কিন্তু নৌকা তীরে ভিড়ানোর আগেই ‘জল জল’ বলে চি ৎ কার করতে করতে অথই গঙ্গাবক্ষে প্রাণত্যাগ করেন প্রবল পিপাসার্ত রাজরাজেশ্বরী দেবী। দুঃখজনক এই ঘটনায় শোকাহত হন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। সুপেয় জলের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তিনি অনুভব করেন মর্মে মর্মে। সেই অনুভব থেকেই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার নাসিরাবাদ পৌরসভায় একটি যান্ত্রিক জল পরিশোধনাগার নির্মাণে এগিয়ে এলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।
নাসিরাবাদ তখন নামমাত্রই পৌরসভা। পানীয় জলের জন্য পৌর এলাকার বাসিন্দাদের নির্ভরতা তখনো ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর। নদের জল অপরিশুদ্ধ হওয়ার কারণে কলেরা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই তখন বাড়ছিল শহরে। ঠিক সে সময়ই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষে অনেকগুলো পাকা পুকুর নির্মাণ করলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। মোটর পাম্পের সাহায্যে নদ থেকে জল টেনে এনে পাকা পুকুরে সংরক্ষণ করে গ্রহণ করলেন পরিশোধনের ব্যবস্থা। কয়েক পর্যায়ে পরিশোধনের পর ওই জল তিনি উত্তোলনের ব্যবস্থা করলেন সুউচ্চ ট্যাংকে। তারপর নলের সাহায্যে ট্যাংকে সুরক্ষিত জল পৌর এলাকার অধিবাসীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। মহারাজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নামানুসারে জনহিতকর এই প্রকল্পটির নাম রাখা হলো ‘রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস’।
প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার পরপরই এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভার কাছে ন্যস্ত করেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯৭১ সালে শহরে জল সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগ। গভীর নলকূপ থেকে পাম্পের সাহায্যে জল তুলে শহরে সরবরাহের ব্যবস্থা করার ফলে কার্যকারিতা হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস।
রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস নামের প্রাচীন জল সরবরাহ প্রকল্পটির কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হলাম আমরা। সংরক্ষণ প্রক্রিয়া তো দূরের কথা, শতাব্দীপ্রাচীন এই কীর্তিটি সমূলে ধ্বংশের মহাযজ্ঞই সম্পন্ন প্রায়। নদ থেকে প্রকল্পের জল টেনে আনার স্থানটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে বর্তমানে সেখানে নির্মিত হয়েছে মার্কেট। মার্কেটের পেছনে ‘গুহ অ্যান্ড সন্স’ নির্মিত সুউচ্চ ট্যাংকটি কোনোক্রমে অস্তিত্ব বজায় রাখলেও জল পরিশোধনের পাকা পুকুরগুলোর অবস্থা শোচনীয় ভীষণ। অনন্য এ প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় ফাঁকা স্থানগুলোও ফাঁকা নেই আর। সর্বত্রই নীতিবিবর্জিত দখলদারির চিহ্ন, চারপাশে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা বিনষ্টের বর্বর ছাপ। অবনত চেতনাকে সমুন্নত করার চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয় আমাদের, ব্যর্থ হয় হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস।
দীপংকর চন্দ
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি সকরুণ ইতিহাস। জানা যায়, বিয়ের পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর সহধর্মিণী রাজরাজেশ্বরী দেবী কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি হলো তাঁর। ময়মনসিংহ ও কলকাতার বিজ্ঞ চিকি ৎ সকেরা রাজরাজেশ্বরী দেবীর আরোগ্য লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই কৃতকার্য হলেন না তাঁরা। রাজরাজেশ্বরী দেবীর রোগযন্ত্রণা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে লাগল। দীর্ঘ রোগভোগের শেষ পর্যায়ে রাজরাজেশ্বরী দেবীর বায়ু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন অনন্যোপায় চিকি ৎ সকেরা। পরম করুণাময়ের কৃপা লাভের জন্য তীর্থ পর্যটনের উপদেশও দিলেন কেউ কেউ। সে অনুযায়ী মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী গ্রহণ করলেন ব্যবস্থা। কিন্তু বিধি বাম! ১৮৮৮ সালে নৌকাযোগে তীর্থ পর্যটনে যাওয়ার সময় গঙ্গাবক্ষে হঠা ৎ কলেরায় আক্রান্ত হলেন রাজরাজেশ্বরী দেবী।
কলেরা মূলত জলবাহিত রোগ। দূষিত জল এ রোগটির অন্যতম বাহক। নৌকায় অবস্থানকালে নদীর দূষিত জল গ্রহণের ফলেই রোগাক্রান্ত হন রাজরাজেশ্বরী দেবী। সে সময় সুপেয় জলের ভীষণ অভাব ছিল সর্বত্র। তাই রোগমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাজরাজেশ্বরী দেবীকে নদীর দূষিত জল গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য হন চিকি ৎ সকেরা। সুপেয় জলের জন্য নৌকা তীরে ভিড়ানোর চেষ্টা করা হয় দ্রুত। কিন্তু নৌকা তীরে ভিড়ানোর আগেই ‘জল জল’ বলে চি ৎ কার করতে করতে অথই গঙ্গাবক্ষে প্রাণত্যাগ করেন প্রবল পিপাসার্ত রাজরাজেশ্বরী দেবী। দুঃখজনক এই ঘটনায় শোকাহত হন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। সুপেয় জলের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তিনি অনুভব করেন মর্মে মর্মে। সেই অনুভব থেকেই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার নাসিরাবাদ পৌরসভায় একটি যান্ত্রিক জল পরিশোধনাগার নির্মাণে এগিয়ে এলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।
নাসিরাবাদ তখন নামমাত্রই পৌরসভা। পানীয় জলের জন্য পৌর এলাকার বাসিন্দাদের নির্ভরতা তখনো ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর। নদের জল অপরিশুদ্ধ হওয়ার কারণে কলেরা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই তখন বাড়ছিল শহরে। ঠিক সে সময়ই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষে অনেকগুলো পাকা পুকুর নির্মাণ করলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। মোটর পাম্পের সাহায্যে নদ থেকে জল টেনে এনে পাকা পুকুরে সংরক্ষণ করে গ্রহণ করলেন পরিশোধনের ব্যবস্থা। কয়েক পর্যায়ে পরিশোধনের পর ওই জল তিনি উত্তোলনের ব্যবস্থা করলেন সুউচ্চ ট্যাংকে। তারপর নলের সাহায্যে ট্যাংকে সুরক্ষিত জল পৌর এলাকার অধিবাসীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। মহারাজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নামানুসারে জনহিতকর এই প্রকল্পটির নাম রাখা হলো ‘রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস’।
প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার পরপরই এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভার কাছে ন্যস্ত করেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯৭১ সালে শহরে জল সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগ। গভীর নলকূপ থেকে পাম্পের সাহায্যে জল তুলে শহরে সরবরাহের ব্যবস্থা করার ফলে কার্যকারিতা হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস।
রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস নামের প্রাচীন জল সরবরাহ প্রকল্পটির কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হলাম আমরা। সংরক্ষণ প্রক্রিয়া তো দূরের কথা, শতাব্দীপ্রাচীন এই কীর্তিটি সমূলে ধ্বংশের মহাযজ্ঞই সম্পন্ন প্রায়। নদ থেকে প্রকল্পের জল টেনে আনার স্থানটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে বর্তমানে সেখানে নির্মিত হয়েছে মার্কেট। মার্কেটের পেছনে ‘গুহ অ্যান্ড সন্স’ নির্মিত সুউচ্চ ট্যাংকটি কোনোক্রমে অস্তিত্ব বজায় রাখলেও জল পরিশোধনের পাকা পুকুরগুলোর অবস্থা শোচনীয় ভীষণ। অনন্য এ প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় ফাঁকা স্থানগুলোও ফাঁকা নেই আর। সর্বত্রই নীতিবিবর্জিত দখলদারির চিহ্ন, চারপাশে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা বিনষ্টের বর্বর ছাপ। অবনত চেতনাকে সমুন্নত করার চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয় আমাদের, ব্যর্থ হয় হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস।
দীপংকর চন্দ
No comments