সময়ের প্রতিধ্বনি-নানা ষড়যন্ত্রে গোলমেলে রাজনীতি আইএসআই, র সক্রিয়! by মোস্তফা কামাল

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানকে মেলানো যাবে না। এখানকার মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতারোহণকে কোনোভাবেই মানুষ সমর্থন করে না। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও কোনো সরকার যদি অগণতান্ত্রিক আচরণ করে, তার বিপক্ষে দাঁড়ায় এ দেশের মানুষ। তার পরও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোথায় যেন মিল রয়েছে।


পাকিস্তানের প্রভাববলয় এখনো আমাদের রাজনীতিকে অস্থির করে তুলছে! পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই এখানে সক্রিয় রয়েছে। তাদের ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যানালিসিস ইউনিট বা 'র' অস্থির থাকে।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলে ভারত সরকার প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের মুম্বাইয়ে, দিলি্লতে লোকসভা ভবনের সামনে বোমা হামলাসহ সে দেশের অভ্যন্তরে বড় হামলাগুলোর পেছনে আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলে ভারত বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই অভিযোগের সত্যতাও খুঁজে পেয়েছে ভারত। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাটির হাত রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা বলতে চান, ঢাকায় সেনা সদরে অভ্যুত্থান চেষ্টার পাশাপাশি সীমান্ত অস্থির করার পেছনে আইএসআইয়ের সরাসরি ইন্ধন ও সম্পৃক্ততা রয়েছে।
আমরা যদি দেশের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট যে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা তৈরির পেছনে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত ছিল। তা না হলে শুধু সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী কর্নেল-মেজরের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষকে হত্যা করার সাহস হতো না। পেছন থেকে তাঁদের সাহস জুগিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা ক্ষমতালিপ্সু কিছু কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তারা তখন পাকিস্তানপন্থী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন এবং পাকিস্তান সরকার তথা আইএসআইয়ের সঙ্গে তাঁদের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পঁচাত্তর-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তাঁদের মুখোশ ঠিকই উন্মোচিত হয়েছে।
ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আটকে দিতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের কাছে ধরনা দিয়েছিল পাকিস্তান। সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়েছিল। ওই দেশগুলো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পাকিস্তান যখন বুঝতে পারল, তাদের পতন অনিবার্য, ঠিক তখনই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করল। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার চিন্তাও করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। কিন্তু তাতে পাকিস্তান বিপদে পড়বে ভেবে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। একাত্তরে আইএসআইয়ের গোয়েন্দা পলিসি ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতার গ্লানি তারা ভুলতে পারেনি। তারা তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যখন গড়ে তোলার কাজে বঙ্গবন্ধু সরকার ব্যস্ত ছিল, তখন আইএসআইয়ের মদদে একটি পক্ষ দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে লাগল। চুরি, ডাকাতি, খুন, লুণ্ঠন ইত্যাদি করে সরকারকে ব্যর্থ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল পাকিস্তানিদের দোসররা। তাতে তারা সফলও হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারকে হটিয়ে তারা নিজেদের পছন্দের সরকার গঠন করল এবং বাংলাদেশ চলে গেল পাকিস্তানের প্রভাববলয়ে। তারপর তারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটি শক্ত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিল। এতেও আইএসআই সফল হলো। আর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়ল।
দেশ বিভাজনের পরপরই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার করে। আইএসআইয়ের তৎপরতা মোকাবিলা করতেই ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় র। ১৯৭১ সাল ছিল র-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিন বছর বয়সী র সেই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়। কিন্তু তার পর থেকে আইএসআইয়ের তৎপরতার কাছে হেরে যায়। সম্ভবত একাত্তরের পরাজয়ের পর থেকেই আইএসআই নিজেদের নতুন করে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হয়।
১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিপক্ষে এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পক্ষে অবস্থান নেয় আইএসআই। তখন আফগানিস্তান থেকে রাশিয়াকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানে ভারত ও ইরান সমর্থিত নর্দান অ্যালায়েন্সের বিপক্ষে এবং তালেবানের পক্ষে অবস্থান নেয় আইএসআই। সংস্থাটি আফগানিস্তানে তালেবান গ্রুপের প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করে। আইএসআইয়ের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তায় আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধারা ক্ষমতা দখল করে। ফলে তালেবান শাসকদের পুরো পাঁচ বছরই আফগানিস্তান ছিল পাকিস্তানের প্রভাববলয়ে।
আশির দশকে বাংলাদেশে র আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাববলয় তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশ কিছু মিডিয়া হাউসও র-এর কব্জায় চলে যায়। সংগত কারণেই আইএসআই কিছুটা চাপের মুখে পড়ে। তবে ভারত সব সময়ই অভিযোগ করে আসছে যে আইএসআই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘি্নত করার কাজে নিয়োজিত। তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় মদদ জোগাচ্ছে; যদিও ভারতের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। পেশাগত কারণে আমি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই একাধিকবার সফরে গিয়ে মাসের পর মাস থেকে রিপোর্টিংয়ের কাজ করেছি। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান তো বটেই, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও আইএসআই ও র-এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লড়াই দেখেছি। কে কাকে হেনস্তা করতে পারে, সেটা নিয়েই অনেকটা সময় তারা ব্যয় করে। অনেক ক্ষেত্রে দুই গোয়েন্দা সংস্থার 'স্নায়ুযুদ্ধ'র বার্তা জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য সোভিয়েত-মার্কিন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় সিআইএ, র ও আইএসআই একসঙ্গে কাজ করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির লড়াইও সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ শোনা যেত। রাশিয়ার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে কেজিবি নামটি বিলুপ্তপ্রায়! এ ক্ষেত্রে র ও আইএসআই অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। উভয় সংস্থার কর্মকাণ্ড এখন বিশ্বব্যাপী। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় দুটি গোয়েন্দা সংস্থাই বিশেষভাবে আলোচিত। উভয় সংস্থাই গোয়েন্দাকাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। এক হিসাবে জানা যায়, র প্রতিবছর ২৫ কোটি রুপির বেশি খরচ করছে। এই খরচের পরিমাণ দিন দিনই বাড়ছে। আইএসআইয়ের বাজেট র-এর চেয়ে অনেক বেশি। প্রতি অর্থবছরে আইএসআইয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় সাড়ে পাঁচ শ কোটি (৫.৫৫ বিলিয়ন) রুপি।
সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টার সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরের সম্পৃক্ততার খবর প্রকাশিত হয়েছে। সংগঠনটির সঙ্গে মধ্য পর্যায়ের কিছু ধর্মান্ধ সেনা কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে সংগঠিত করার চেষ্টা চলেছে। এখনো এ প্রক্রিয়া থেমে নেই। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আইএসআই এবং কয়েকটি ইসলামী দেশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে মহাজোট সরকারের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে চিড় ধরাতে আন্তর্জাতিক ওই মহলটি সক্রিয় রয়েছে। তারা পরিকল্পনা করে সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত। বিষয়টি খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে সরকারকে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি না করে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা হয়তো ছোট আকারে কিংবা নিম্ন পর্যায়ে ঘটনা ঘটিয়ে পরিস্থিতি দেখতে চেয়েছে। আরো বড় অঘটন ঘটানোর পরিকল্পনা তাদের থাকতে পারে। সে জন্য রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে আসল সত্য খুঁজে বের করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাজনীতি করতে গিয়ে ছোট ছিদ্রগুলো সুড়ঙ্গে রূপ নিলে এ দেশের গণতন্ত্রের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাতে গণতন্ত্র বিপদাপন্ন হতে পারে।
আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি, দোষারোপের কারণে আমরা কখনোই কোনো সমস্যার মূলে যেতে পারি না। কোনো ঘটনা ঘটলেই দেখা যায়, তাতে রাজনৈতিক রং লাগানো হয়। আর এর সুযোগ নেয় ষড়যন্ত্রকারীররা। 'ব্লেম গেম' আর দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করে দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসতে হবে।
সামরিক ও গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, আমাদের দেশে সরকার ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই র ও আইএসআইয়ের 'টুলস' হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অস্থিরতা, সংকট কোনোকালেই কাটবে না। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজনীতিকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শৈথিল্যের কারণে কোনো অশুভ শক্তি যাতে সুযোগ নিতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে আর কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.