ফিরে দেখা ১৯৭১-যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের তলার দ্বন্দ্বটি by মোহীত উল আলম
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এবং হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ছিল বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠন করা হয়েছে এবং বিচারের প্রক্রিয়াও চলছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যা বিচারের বিরোধিতার সামিল।
বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কিছুদিন আগে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত জনৈক নেতা ’৭১ সালে কোথায় খুন করেছেন বা ধর্ষণ করেছেন—এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ লাগবে, অন্যথায় তাঁকে সাজা দেওয়া যাবে না। আইনের দৃষ্টিতে কথাটা সত্য এবং আশা করব, যুদ্ধাপরাধ বিচারের দায়িত্বে নিয়োজিত আদালত মহাসচিব সাহেবের আশা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণাদি জোগাড় করেছেন।
যাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার চাওয়া হচ্ছে—এটা গেল একটা কথা। কিন্তু এঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন কেন, সেটার একটা আলোচনা করতে আজকের এ লেখা। এঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন এ উদ্বেগ থেকে, পাকিস্তান ভেঙে গেলে বুঝি ধর্মও চলে যাবে। এ অবস্থান থেকে তাঁরা বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যুগপ ৎ ভীতি ও ঘৃণা ছড়ায়। কাজেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের অভিব্যক্তি ছিল দুটি ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। এক, তাঁরা পাকিস্তান আর ইসলাম ধর্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না; পাকিস্তান অক্ষুণ্ন থাকাকে তাঁরা ইসলাম অক্ষুণ্ন থাকা মনে করেছিলেন। দুই, তাঁরা বাংলাদেশ হওয়াকে একটি ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়া মনে করেছিলেন।
প্রথম কথাটি হলো, আমাদের প্রজন্মের ও বর্তমান প্রজন্মের অনেকের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়াটা একটি বিস্ময়কর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা মনে হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হোক, সেটি যেমন সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী চেয়েছিল, তেমনই তখনকার অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচেতনার অধিকারী বাঙালিও চেয়েছিল। এ দলে প্রগতিশীল সাহিত্যিক-কবিরাও ছিলেন। এ অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী অংশ পাকিস্তান চেয়েছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। কিন্তু এর বাইরেও যাঁরা চেয়েছিলেন পাকিস্তান হোক এবং তার অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানও জন্ম নিক; তারা একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিটি তুলেছিলেন। ফলে যখন পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো, এ দেশের এই সাম্প্রদায়িক অংশটির মাতৃভাষা বাংলা হলেও তাঁরা এ ভাষাটাকেই সুবিধা মনে না করে প্রতিবন্ধকতা মনে করেছিলেন। কারণ, তাঁরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলা ভাষার হরফ দেখতে আরবি আর উর্দুর চেয়ে বিশেষ রকমের ব্যতিক্রমী হওয়ায় তাঁরা বাংলা হরফের বদলে আরবি কিংবা রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা এ ধারণাও পোষণ করতেন যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেহেতু প্রাচীন বৈষ্ণব ও বৌদ্ধসমাজ থেকে ক্রম রূপান্তর পেয়েছে, সে জন্য এটা ইসলামিক সংস্কৃতির বিপরীতে ছিল। কিন্তু এখানে তাঁরা বিবেচনায় আনলেন না এ সত্য যে ইসলাম এ ভূখণ্ডে আসার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির বহু লেনদেন হয়েছে, বহু গ্রহণ-বর্জন হয়েছে, বহু সমন্বয় হয়েছে এবং রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্ম এখানে টিকে আছে প্রায় এক হাজার বা তার কাছাকাছি সময় ধরে।
আধুনিক নৃতত্ত্ববিদেরা, যেমন—রোনাল্ডো রিসাল্টো মনে করেন, সব সংস্কৃতিরই একটি প্রবণতা হচ্ছে সংকরায়িত হওয়া। সে হিসেবে উপমহাদেশের প্রধান ধর্মগুলো যে সংকরায়ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না, তা নয়। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্মকে ধারণ করার দর্শনের মধ্যে একটি বিভ্রম হয়েছিল। রাষ্ট্র কখনো ধর্মের পরিচায়ক হতে পারে না। ধর্ম সব সময় রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃত। সে জন্য একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বহু ধর্মের লোকের বাস করা সম্ভব। কিন্তু তাঁরা চিন্তার দীনতার কারণে এটি মনে করতেন, একটি পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নটা পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেওয়া এবং টিকে থাকার মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
ইতিহাসে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আশ্চর্য সমীকরণ পাওয়া যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ৯ জানুয়ারি ১৯৬১ সালে এক ভাষণে ম্যাসাচুসেটস বে কলোনির প্রতিষ্ঠাতা ধর্মযাজক জন উইনথ্রপের একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। জন উইনথ্রপ যখন ১৬৩০ সালে আরাবেল্লা জাহাজে চেপে আমেরিকায় গমনের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, তখন তিনি তাঁর সতীর্থদের লক্ষ্য করে জাহাজে উঠেই একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেছিলেন, সাগর পাড়ি দিয়ে তাঁদের নতুন মহাদেশে যাওয়ার একটিই উদ্দেশ্য, আর সেটি হলো, বাইবেলে প্রভু যিশুর প্রদত্ত ‘সারমন অন দ্য মাউন্ট’ ভাষণ অনুযায়ী নতুন মহাদেশকে একটি নতুন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেটি হবে প্রভু যিশু-নির্দিষ্ট পর্বতের ওপরে দৃশ্যমান শহরের (অ্যাজ অ্যা সিটি আপন অ্যা হিল) মতো ঐশ্বরিক প্রভায় নন্দিত। ঠিক কেনেডিও বললেন, ‘আমরা সব সময় বিবেচনায় রাখব, আমেরিকাকে হতে হবে পর্বতশিখরে অবস্থিত একটি শহরের মতো দৃশ্যমান একটি দেশ; বিশ্বের চোখ থাকবে আমাদের দিকে।’ অর্থা ৎ , উইনথ্রপের ধর্মীয় প্রণোদনাকে কেনেডি প্রায় ৪০০ বছর পর রাজনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহার করলেন। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের এটি একমাত্র উদাহরণ নয়।
সে যাই হোক, উইনথ্রপের নেতৃত্বে পিউরিটান ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থী খ্রিষ্টানেরা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস বে’কে ঘিরে বাইবেলে বর্ণিত ‘অ্যাজ অ্যা সিটি আপন অ্যা হিল’ ধারণা অনুযায়ী তাঁদের স্বপ্নের সভ্যতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। বোস্টন হয়ে উঠল তাঁদের রাজধানী। প্রতি রোববার চার্চের ধর্মীয় সমাবেশে ঈশ্বরের গুণকীর্তন করে যখন পিউরিটান ধর্মযাজকেরা হিতোপদেশ দিতে লাগলেন, তখন একটি চার্চের সমাবেশে একজন লোক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ফাদার, আমরা এখানে শুধু গডকে প্রার্থনা করার জন্য আসিনি, আমরা এখানে কড মাছ ধরতেও এসেছি।’
তাঁর কথা থেকে আমেরিকার সভ্যতার মূল সংঘাতটি বোঝা যায়। এটাকে ইংরেজিতে বলে কড-গড প্যারাডক্স, যা বাংলায় ব্যাখ্যা করলে এ রকম দাঁড়াবে—আমেরিকার স্বপ্নতুল্য রাজ্যটি একদিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাইবেলের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি ঐশ্বরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকে, আবার এর সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে যেটি উন্নতি লাভ করল, সেটি হলো বৈষয়িকতা। কড মাছ ধরা হলো এ বৈষয়িকতার একটি প্রতীকী উল্লেখ। ব্যাপারটা হলো, আমেরিকার নতুন মহাদেশটি ধর্মীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি বিরাট সুযোগ তৈরি করলেও এর স্বয়ম্ভর প্রকৃতি, এর বিস্তৃত ভূমিখণ্ড, বিশাল অরণ্য, অনাবিল মাঠ ও শষ্যক্ষেত্র, বিশাল পক্ষী, পশু, ম ৎ স্য রাজ্য ও সম্পদ স্বাভাবিকভাবে মানুষকে বৈষয়িক জীবন প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে। ইউরোপে যে বৈষয়িক জগতের লালসায় পড়ে মানুষ ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পাপী জীবন যাপন করছিল এবং যে জীবন থেকে মুক্তি পেতে উইনথ্রপেরা আমেরিকায় স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্নটাই পুনরায় আমেরিকায় এসেও ভেঙে পড়ল। অর্থা ৎ নতুন বোতলে পুরোনো মদের ব্যাপারটি রয়েই গেল। ইউরোপের মতো সে একই বৈষয়িক জীবনের প্রতি আকর্ষণ, সে একই পাপমুখী জীবনাচরণ এখানকার অধিবাসীদেরও আক্রান্ত করতে লাগল। আমেরিকার সভ্যতার প্রেক্ষাপটটি তাই সংজ্ঞায়িত করছে একদিকে উইনথ্রপ কর্তৃক আমেরিকান ড্রিম বা আমেরিকার স্বপ্ন রচনা করার প্রয়াস এবং অন্যদিকে বিষয়গত অপ্রতিরোধ্য মানবিক চেতনার উদগ্র আঘাতের জন্য সে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনা। দোটানার এ সংঘাতমূলক প্রাবল্যই হচ্ছে আমেরিকা রাষ্ট্রটির মূল পরিচায়ক।
ঠিক পাকিস্তানের ব্যাপারেও কোনো একভাবে এ রকম একটি স্বপ্ন রচনা এবং ভাঙার দোলাচল লক্ষ করা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় এ দেশের বঙ্গীয় মুসলমানেরা একটি বিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু এ স্বপ্নে কড মাছের প্রবেশ হতে দেরি হয়নি। এ ধর্মীয় স্বপ্নের আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণের একটি রাস্তা খুঁজে পেল। ফলে যা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভক্তি দেখাতে শুরু করল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা ওই স্বপ্নের সুবিধা নিয়ে অব্যাহত শোষণপ্রক্রিয়া শুরু করল। ফলে পরিস্থিতি দাঁড়াল এমন যে পূর্ব পাকিস্তান যখন দেখছে ধর্ম ও আত্মাশুদ্ধির আয়োজন, তখন পশ্চিম পাকিস্তান দেখছে কড মাছ বা অর্থনৈতিক শোষণ। এ প্রবঞ্চনা সম্পর্কে বাঙালির নিশ্চিত হতে সময় লাগেনি এবং সে জন্যই পাকিস্তানের ২৪ বছরের মাথায় রাষ্ট্রটি ভেঙে গেল এবং ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’—এরূপ প্রতিবাদের ভিত্তিতে অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনাধারী লোকজন, যাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী ত ৎ পরতায় জড়িয়ে পড়েন, তাঁরা তখনো মনে করছিলেন, পাকিস্তান মানেই ইসলাম; তাই তাঁরা শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অস্বীকার করলেন তা নয়, তাঁরা পাকিস্তান রক্ষার্থে বাঙালি নিধনের মতো নিষ্ঠুর কর্মসূচি হাতে নিলেন, এর অনেকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ইত্যাদি হত্যাকারী দল গঠন। ৭ নভেম্বর ১৯৭১ সালে আলবদর দিবস পালন করা হয় এবং ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত একজন নেতার বক্তব্য নিম্নোক্তরূপে ছাপা হয়েছিল, ‘পাক সেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে...পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবার বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে।’ (সূত্র: ‘ঢাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের ত ৎ পরতা,’ মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ১৯৭১।)
যুদ্ধাপরাধীদের চিন্তায় যে বিষয়টা স্থান পায়নি, সেটা হলো, পাকিস্তানের নামে যে ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে সেখানে কড মাছ ঢুকে গেছে এবং পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান যে অর্থে পাকিস্তানকে দেখছিল, সে অর্থে বাঙালি যুদ্ধাপরাধীরা যে দেখছিল না, সেটি তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। অর্থা ৎ , স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীর ভূমিকাকে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দেখছিল তাদের শোষণের হাতিয়ার স্বরূপ আর যুদ্ধাপরাধীরা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে ত ৎ পর ছিল তাদের ভূমিকাকে ধর্মের রক্ষক হিসেবে দেখতে। এ ভ্রান্তি থেকেই তাদের মধ্যে আলবদরের মতো ঘাতক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন পড়ে, যা ধর্মের নামে ধর্মের বিকৃত ব্যবহার করে মানুষ মারার সংগঠনে পরিণত হয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় সভাপতি, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
যাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার চাওয়া হচ্ছে—এটা গেল একটা কথা। কিন্তু এঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন কেন, সেটার একটা আলোচনা করতে আজকের এ লেখা। এঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন এ উদ্বেগ থেকে, পাকিস্তান ভেঙে গেলে বুঝি ধর্মও চলে যাবে। এ অবস্থান থেকে তাঁরা বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যুগপ ৎ ভীতি ও ঘৃণা ছড়ায়। কাজেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের অভিব্যক্তি ছিল দুটি ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। এক, তাঁরা পাকিস্তান আর ইসলাম ধর্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না; পাকিস্তান অক্ষুণ্ন থাকাকে তাঁরা ইসলাম অক্ষুণ্ন থাকা মনে করেছিলেন। দুই, তাঁরা বাংলাদেশ হওয়াকে একটি ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়া মনে করেছিলেন।
প্রথম কথাটি হলো, আমাদের প্রজন্মের ও বর্তমান প্রজন্মের অনেকের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়াটা একটি বিস্ময়কর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা মনে হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হোক, সেটি যেমন সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী চেয়েছিল, তেমনই তখনকার অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচেতনার অধিকারী বাঙালিও চেয়েছিল। এ দলে প্রগতিশীল সাহিত্যিক-কবিরাও ছিলেন। এ অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী অংশ পাকিস্তান চেয়েছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। কিন্তু এর বাইরেও যাঁরা চেয়েছিলেন পাকিস্তান হোক এবং তার অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানও জন্ম নিক; তারা একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিটি তুলেছিলেন। ফলে যখন পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো, এ দেশের এই সাম্প্রদায়িক অংশটির মাতৃভাষা বাংলা হলেও তাঁরা এ ভাষাটাকেই সুবিধা মনে না করে প্রতিবন্ধকতা মনে করেছিলেন। কারণ, তাঁরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলা ভাষার হরফ দেখতে আরবি আর উর্দুর চেয়ে বিশেষ রকমের ব্যতিক্রমী হওয়ায় তাঁরা বাংলা হরফের বদলে আরবি কিংবা রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা এ ধারণাও পোষণ করতেন যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেহেতু প্রাচীন বৈষ্ণব ও বৌদ্ধসমাজ থেকে ক্রম রূপান্তর পেয়েছে, সে জন্য এটা ইসলামিক সংস্কৃতির বিপরীতে ছিল। কিন্তু এখানে তাঁরা বিবেচনায় আনলেন না এ সত্য যে ইসলাম এ ভূখণ্ডে আসার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির বহু লেনদেন হয়েছে, বহু গ্রহণ-বর্জন হয়েছে, বহু সমন্বয় হয়েছে এবং রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্ম এখানে টিকে আছে প্রায় এক হাজার বা তার কাছাকাছি সময় ধরে।
আধুনিক নৃতত্ত্ববিদেরা, যেমন—রোনাল্ডো রিসাল্টো মনে করেন, সব সংস্কৃতিরই একটি প্রবণতা হচ্ছে সংকরায়িত হওয়া। সে হিসেবে উপমহাদেশের প্রধান ধর্মগুলো যে সংকরায়ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না, তা নয়। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্মকে ধারণ করার দর্শনের মধ্যে একটি বিভ্রম হয়েছিল। রাষ্ট্র কখনো ধর্মের পরিচায়ক হতে পারে না। ধর্ম সব সময় রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃত। সে জন্য একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বহু ধর্মের লোকের বাস করা সম্ভব। কিন্তু তাঁরা চিন্তার দীনতার কারণে এটি মনে করতেন, একটি পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নটা পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেওয়া এবং টিকে থাকার মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
ইতিহাসে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আশ্চর্য সমীকরণ পাওয়া যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ৯ জানুয়ারি ১৯৬১ সালে এক ভাষণে ম্যাসাচুসেটস বে কলোনির প্রতিষ্ঠাতা ধর্মযাজক জন উইনথ্রপের একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। জন উইনথ্রপ যখন ১৬৩০ সালে আরাবেল্লা জাহাজে চেপে আমেরিকায় গমনের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, তখন তিনি তাঁর সতীর্থদের লক্ষ্য করে জাহাজে উঠেই একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেছিলেন, সাগর পাড়ি দিয়ে তাঁদের নতুন মহাদেশে যাওয়ার একটিই উদ্দেশ্য, আর সেটি হলো, বাইবেলে প্রভু যিশুর প্রদত্ত ‘সারমন অন দ্য মাউন্ট’ ভাষণ অনুযায়ী নতুন মহাদেশকে একটি নতুন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেটি হবে প্রভু যিশু-নির্দিষ্ট পর্বতের ওপরে দৃশ্যমান শহরের (অ্যাজ অ্যা সিটি আপন অ্যা হিল) মতো ঐশ্বরিক প্রভায় নন্দিত। ঠিক কেনেডিও বললেন, ‘আমরা সব সময় বিবেচনায় রাখব, আমেরিকাকে হতে হবে পর্বতশিখরে অবস্থিত একটি শহরের মতো দৃশ্যমান একটি দেশ; বিশ্বের চোখ থাকবে আমাদের দিকে।’ অর্থা ৎ , উইনথ্রপের ধর্মীয় প্রণোদনাকে কেনেডি প্রায় ৪০০ বছর পর রাজনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহার করলেন। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের এটি একমাত্র উদাহরণ নয়।
সে যাই হোক, উইনথ্রপের নেতৃত্বে পিউরিটান ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থী খ্রিষ্টানেরা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস বে’কে ঘিরে বাইবেলে বর্ণিত ‘অ্যাজ অ্যা সিটি আপন অ্যা হিল’ ধারণা অনুযায়ী তাঁদের স্বপ্নের সভ্যতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। বোস্টন হয়ে উঠল তাঁদের রাজধানী। প্রতি রোববার চার্চের ধর্মীয় সমাবেশে ঈশ্বরের গুণকীর্তন করে যখন পিউরিটান ধর্মযাজকেরা হিতোপদেশ দিতে লাগলেন, তখন একটি চার্চের সমাবেশে একজন লোক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ফাদার, আমরা এখানে শুধু গডকে প্রার্থনা করার জন্য আসিনি, আমরা এখানে কড মাছ ধরতেও এসেছি।’
তাঁর কথা থেকে আমেরিকার সভ্যতার মূল সংঘাতটি বোঝা যায়। এটাকে ইংরেজিতে বলে কড-গড প্যারাডক্স, যা বাংলায় ব্যাখ্যা করলে এ রকম দাঁড়াবে—আমেরিকার স্বপ্নতুল্য রাজ্যটি একদিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাইবেলের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি ঐশ্বরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকে, আবার এর সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে যেটি উন্নতি লাভ করল, সেটি হলো বৈষয়িকতা। কড মাছ ধরা হলো এ বৈষয়িকতার একটি প্রতীকী উল্লেখ। ব্যাপারটা হলো, আমেরিকার নতুন মহাদেশটি ধর্মীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি বিরাট সুযোগ তৈরি করলেও এর স্বয়ম্ভর প্রকৃতি, এর বিস্তৃত ভূমিখণ্ড, বিশাল অরণ্য, অনাবিল মাঠ ও শষ্যক্ষেত্র, বিশাল পক্ষী, পশু, ম ৎ স্য রাজ্য ও সম্পদ স্বাভাবিকভাবে মানুষকে বৈষয়িক জীবন প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে। ইউরোপে যে বৈষয়িক জগতের লালসায় পড়ে মানুষ ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পাপী জীবন যাপন করছিল এবং যে জীবন থেকে মুক্তি পেতে উইনথ্রপেরা আমেরিকায় স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্নটাই পুনরায় আমেরিকায় এসেও ভেঙে পড়ল। অর্থা ৎ নতুন বোতলে পুরোনো মদের ব্যাপারটি রয়েই গেল। ইউরোপের মতো সে একই বৈষয়িক জীবনের প্রতি আকর্ষণ, সে একই পাপমুখী জীবনাচরণ এখানকার অধিবাসীদেরও আক্রান্ত করতে লাগল। আমেরিকার সভ্যতার প্রেক্ষাপটটি তাই সংজ্ঞায়িত করছে একদিকে উইনথ্রপ কর্তৃক আমেরিকান ড্রিম বা আমেরিকার স্বপ্ন রচনা করার প্রয়াস এবং অন্যদিকে বিষয়গত অপ্রতিরোধ্য মানবিক চেতনার উদগ্র আঘাতের জন্য সে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনা। দোটানার এ সংঘাতমূলক প্রাবল্যই হচ্ছে আমেরিকা রাষ্ট্রটির মূল পরিচায়ক।
ঠিক পাকিস্তানের ব্যাপারেও কোনো একভাবে এ রকম একটি স্বপ্ন রচনা এবং ভাঙার দোলাচল লক্ষ করা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় এ দেশের বঙ্গীয় মুসলমানেরা একটি বিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু এ স্বপ্নে কড মাছের প্রবেশ হতে দেরি হয়নি। এ ধর্মীয় স্বপ্নের আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণের একটি রাস্তা খুঁজে পেল। ফলে যা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভক্তি দেখাতে শুরু করল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা ওই স্বপ্নের সুবিধা নিয়ে অব্যাহত শোষণপ্রক্রিয়া শুরু করল। ফলে পরিস্থিতি দাঁড়াল এমন যে পূর্ব পাকিস্তান যখন দেখছে ধর্ম ও আত্মাশুদ্ধির আয়োজন, তখন পশ্চিম পাকিস্তান দেখছে কড মাছ বা অর্থনৈতিক শোষণ। এ প্রবঞ্চনা সম্পর্কে বাঙালির নিশ্চিত হতে সময় লাগেনি এবং সে জন্যই পাকিস্তানের ২৪ বছরের মাথায় রাষ্ট্রটি ভেঙে গেল এবং ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’—এরূপ প্রতিবাদের ভিত্তিতে অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনাধারী লোকজন, যাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী ত ৎ পরতায় জড়িয়ে পড়েন, তাঁরা তখনো মনে করছিলেন, পাকিস্তান মানেই ইসলাম; তাই তাঁরা শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অস্বীকার করলেন তা নয়, তাঁরা পাকিস্তান রক্ষার্থে বাঙালি নিধনের মতো নিষ্ঠুর কর্মসূচি হাতে নিলেন, এর অনেকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ইত্যাদি হত্যাকারী দল গঠন। ৭ নভেম্বর ১৯৭১ সালে আলবদর দিবস পালন করা হয় এবং ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত একজন নেতার বক্তব্য নিম্নোক্তরূপে ছাপা হয়েছিল, ‘পাক সেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে...পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবার বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে।’ (সূত্র: ‘ঢাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের ত ৎ পরতা,’ মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ১৯৭১।)
যুদ্ধাপরাধীদের চিন্তায় যে বিষয়টা স্থান পায়নি, সেটা হলো, পাকিস্তানের নামে যে ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে সেখানে কড মাছ ঢুকে গেছে এবং পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান যে অর্থে পাকিস্তানকে দেখছিল, সে অর্থে বাঙালি যুদ্ধাপরাধীরা যে দেখছিল না, সেটি তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। অর্থা ৎ , স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীর ভূমিকাকে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দেখছিল তাদের শোষণের হাতিয়ার স্বরূপ আর যুদ্ধাপরাধীরা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে ত ৎ পর ছিল তাদের ভূমিকাকে ধর্মের রক্ষক হিসেবে দেখতে। এ ভ্রান্তি থেকেই তাদের মধ্যে আলবদরের মতো ঘাতক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন পড়ে, যা ধর্মের নামে ধর্মের বিকৃত ব্যবহার করে মানুষ মারার সংগঠনে পরিণত হয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় সভাপতি, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments