জলবায়ু সম্মেলন-খাদ্যের নিশ্চয়তা দেবে পরিবেশসম্মত কৃষি by ফরিদা আখতার
জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ-১৭ ডারবানে শুরু হয়েছে ২৮ নভেম্বর, শেষ হবে ডিসেম্বর ৯ তারিখে। বাংলাদেশে এই উপলক্ষে আর কিছু না হোক পরিবেশমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি ঘটেছে। আগে তিনি গেছেন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে, এবার যাচ্ছেন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। যদিও এর ফলে ডারবানে বাংলাদেশের কদর কতখানি বাড়বে বা হিসাবনিকাশে কী বদল ঘটবে তা বলা মুশকিল।
আমাদের চিন্তা এই মুহূর্তে সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে রয়েছে এমন দেশগুলোর ভবিষ্য ৎ কী হবে? ধনী দেশগুলো আসলেই তাদের দায়িত্ব পালন করবে কি?
কিয়োটো প্রটোকল ১৯৯৭ সালে শুরু হয়েছে, মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১২ সালে। এই চুক্তির প্রধান দিক ছিল জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে হলে কার্বন নির্গমনের হার কমাতে হবে; বিশেষ করে ধনী দেশগুলো, যারা কার্বন নির্গমনের জন্য প্রধানত দায়ী, তাঁরা শতকরা ৪০ ভাগ কমাবে। এটাই ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি। কিন্তু ধনী দেশ তাদের দিক থেকে সাড়া দিতে চাইছে না। এর আগে কানকুন এবং কোপেনহেগেন সম্মেলন ভেস্তে গেছে, তাদের কিছুই এসে যায় না। ডারবানে এসেও কোনো আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না, উল্টো কানাডা বলে দিয়েছে তারা এসব বাধ্যবাধকতায় থাকতে চায় না। রাশিয়া ও জাপান আগেই এই কাজ করে ফেলেছে, আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শর্ত দিয়েছে যে যদি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত কার্বন নির্গমন না কমায় তাহলে তারাও করবে না। এ যেন ছোট বাচ্চাদের খেলা। যেখানে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, সেখানে তারা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করছে না। তাই ডারবানের সম্মেলনের শুরুতেই হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে। ভেস্তে যাওয়ার সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কিয়োটো প্রটোকলের অঙ্গীকারের প্রথম দফার মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হলে দ্বিতীয় পর্বে অঙ্গীকার করার যে প্রস্তাব অ্যাডহক ওয়ার্কিং গ্রুপ করেছে তাতে ডারবান সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট সব পার্টি একমত হবে কি না তা এখন বড় অক্ষরের ‘যদি’ হয়ে আছে। উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কালে ধনী দেশগুলো যেন ১৯৯০ সালের তুলনায় কার্বন নিঃসরণ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনে তার দাবি করে আসছে। একদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি হচ্ছে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় দফা অঙ্গীকারে যাওয়া, অন্যদিকে ধনী দেশগুলো চাইছে কিয়োটো চুক্তি বাদ দিয়ে নতুন চুক্তি করা, যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এবং চারটি উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশ ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা (যাদের ব্যাসিক দেশ বলা হয়) অন্তর্ভুক্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র তার মনমতো না হলে কোনো চুক্তি এত দিন মানেনি, এখনো মানবে না সাফ বলে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা মনে করছেন, এই নতুন চুক্তির কথা বলে ধনী দেশগুলো তাদের দায়িত্ব এড়াতে চাইছে এবং কিয়োটো চুক্তির মতো শক্ত আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে দুর্বল চুক্তি করতে বলছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বা জি-৭৭ এবং চীনের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে যে ডারবান যেন কিয়োটো প্রটোকলের কবরস্থান না হয়ে দ্বিতীয় অঙ্গীকারের জন্মস্থান হতে পারে। অর্থা ৎ প্রশ্ন উঠেছে, ডারবানের যে ফলাফল হতে যাচ্ছে তা কি পৃথিবীর ১ শতাংশ মানুষের বিলাসের জন্য, নাকি ৯৯ শতাংশ মানুষকে রক্ষার জন্য হবে?
জলবায়ু সম্মেলনে কী পেয়েছি আর কী না পেলামের হিসাবনিকাশ সম্মেলন শেষ হলে অনেক হবে, আমি সেসব নিয়ে এই অল্প পরিসরে লিখতে পারছি না। কিন্তু যা নিয়ে আমি শঙ্কিত তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাদ্যসংকটের যে আশঙ্কা রয়েছে তার সমাধান নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু হচ্ছে এবং তার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। আমাদের জন্য কৃষি সংখ্যাগরিষ্ঠ কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার মাধ্যম। উন্নয়নশীল দেশের কৃষিতে যুক্ত রয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। সারা বিশ্বে এদের সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি পরিবার এবং প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) মানুষ মাত্র দুই হেক্টর জমির ওপর নির্ভর করে চলছে। ক্ষুদ্র কৃষকেরা বিশ্বের মোট কৃষি খামারের ৮৫ শতাংশ। এই তথ্য দিয়েছে ২০০৮ সালে অলিভার দি সুটার। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থের কথা না ভেবে কোনো পদক্ষেপ নিলে তা আত্মঘাতী হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে, খাদ্যসংকটের সমাধান হিসেবে রাসায়নিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেলের কৃষি উ ৎ পাদনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা নিজেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বহু তথ্য ইতিমধ্যে সংগৃহীত হয়েছে যেমন আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠান দ্য নিউ ওয়াল্ড এগ্রিকালচার ও এন্ড ইকোলজি গ্রুপের গবেষক ভেন্ডারমিয়ার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর কৃষি উপকরণ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং তথাকথিত ‘নতুন’ উদ্ভাবিত ফসল দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই তো হয়ইনি, বরং পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তনই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি ঠেকাতে পারবে।
বাংলাদেশে বছরে বছরে বন্যা, খরা, শীতের কুয়াশা ইত্যাদি অবস্থার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে। এর সঙ্গে কৃষি ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি আমরা লক্ষ করেছি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টি হিসাবনিকাশের মধ্যে থাকছে না। কী হবে কিছুই ঠিক নেই। আমাদের দেশের কৃষকেরা এই জ্ঞান রাখেন যে আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কী ফসল বুনতে হয়। আমাদের সরকার বিদেশি অর্থে পরিচালিত কর্মসূচির ওপর নির্ভরশীল। তাই তাঁরা বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান আমাদের দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত যেসব গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে এগ্রিকালচারাল সেক্টর প্রোগ্রাম সাপোর্টের (এএসপিএস-২) প্রতিবেদন দেখাচ্ছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের মধ্যে আউশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে। কিন্তু এর কারণ শুধুই জলবায়ু পরিবর্তন নয়, আউশ ধান আবাদ কমে যাওয়ার পেছনে তামাক চাষ, ফুল চাষ, বোরো ধানের বেশি আবাদ ইত্যাদিও জড়িত; সে কথাগুলো উচ্চারিত হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে ডারবানে সোচ্চার হয়ে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিলেও ভাগে খুব বেশি জুটবে না। অথচ আমাদের হাতে যে সমাধান আছে তার দিকেই মনোযোগ দিতে পারি অনায়াসে। আমি সেই বিষয়েই কিছু কথা বলতে চাই। জীবন-জীবিকার দিক থেকে সমাধানের পথ খোঁজাই বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য সবচেয়ে সমীচীন পদক্ষেপ হবে। তা হতে হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী ও পরিবেশসম্মত কৃষির প্রচলন। এই প্রস্তাব ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল নলেজ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর ডেভেলপমেন্ট (আইএএএসটিডি, ২০০৯) উত্থাপন করেছে। তারা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং কৃষকের জ্ঞাননির্ভর কৃষিব্যবস্থা প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার ওপর ফসলের উ ৎ পাদনশীলতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, তাই উ ৎ পাদনশীলতাও কমতে শুরু করেছে। পরিবেশসম্মত কৃষি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার মাধ্যমে উ ৎ পাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ বছর ধরে প্রচলিত কৃষি এবং অর্গানিক কৃষির তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, ভুট্টার ফলন অর্গানিক পদ্ধতিতে ৩১ গুণ বেশি হয়েছে, ইথিওপিয়াতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করে কম্পোস্ট ব্যবহার করা জমিতে সমান কিংবা দিগুণ ফসল হয়েছে। বাংলাদেশেও নয়া কৃষি আন্দোলনের কৃষকেরা বিভিন্ন জেলায় কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভালো ফল পাচ্ছেন এবং ফসলের উ ৎ পাদনও বৃদ্ধি করছেন।
এককাট্টা ফসল না করে ফসল, গাছপালা ইত্যাদির বৈচিত্র্য বাড়িয়ে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ক্ষতি অনেক লাঘব করা সম্ভব। গাছপালার সঙ্গে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের কাজ করে এই বৈচিত্র্য আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়। সত্যি কথা বলতে কি, এসব কাজে গ্রামের সাধারণ নারী যে ভূমিকা পালন করতে পারেন, তা বড় বড় প্যান্ট-শার্ট পরা বিজ্ঞানীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। নারী এখানে অনেক বড় বিজ্ঞানীর কাজ করছেন এবং আরও করতে পারেন, যদি তাঁকে সেই সহায়তা দেওয়া হয়। প্রাণবৈচিত্র্য সনদের (সিবিডি ২০০৯) গবেষণায় দেখা গেছে, রুয়ান্ডায় নারীরা ৬০০ জাতের সিম উ ৎ পাদন করেন এবং পেরুতে নারীরা ৬০ জাতের মানিওক বা কাসাবা উ ৎ পাদন করেন। এই বৈচিত্র্য খাদ্যঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের কৃষক নারীরা হাজার হাজার জাতের ধানের পাশাপাশি প্রায় ২৩ জাতের বেগুন, ১৬ জাতের মরিচ, ৪ জাতের লাউসহ আরও নানা ধরনের খাদ্য ফসল ঘরের আনাচে-কানাচে উ ৎ পাদন করে পরিবারে খাদ্য জোগান দিচ্ছেন। তার খবর সরকারি পরিসংখ্যানে না থাকলেও পাঠক গ্রামেগঞ্জে ঘুরে দেখলেই টের পাবেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যসংকটের সৃষ্টি হলেও তার সমাধানে কৃষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আমরা অনেক লাভবান হতে পারতাম। অথচ এখন খাদ্য উ ৎ পাদনের ওপর দখল নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি। তারা ফসলের বৈচিত্র্য চায় না, তারা মাত্র দু-একটি ফসল উ ৎ পাদন করে বাজার দখলে রাখতে চায়। এরা রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং কোম্পানি উ ৎ পাদিত বীজের বাজার বিশেষ করে হাইব্রিড ও জিএমও বীজের বাজার সৃষ্টি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে দিতে চায়। কোটি কোটি কৃষক পরিবার চেয়ে থাকবে মাত্র চারটি বহুজাতিক কোম্পানির ওপর! এটা কোনোমতেই কাম্য নয়।
কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খায় এমন কৃষি আমাদের চর্চায় আনতে হবে, কৃষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের সম্পদ। আমাদের মাটি নষ্ট হলেও এখনো ঠিক করার সময় আছে। আমাদের ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষার সুযোগও এখনো অনেক রয়েছে। কোম্পানিনির্ভর নয়, কৃষকনির্ভর পরিবেশসম্মত কৃষিব্যবস্থাকে সহায়তা দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার উপায় সৃষ্টি করা হবে। সেদিকেই সরকার মনোযোগ দেবে আশা করি।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments