পার্বত্য চুক্তি-আশা-নিরাশার ১৪ বছর by ইলিরা দেওয়ান
ডিসেম্বর মাস হলো আবেগ ও বিজয়ের মাস। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একাত্তর সালের এ মাসে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে বিজয়ের মাসে বহু প্রতীক্ষিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদনের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে আরেকটি আবেগ যুক্ত হয়েছিল। আবেগমিশ্রিত এ চুক্তিটি দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনে এক বুক আশা জাগিয়ে খাগড়াছড়ির স্টেডিয়াম থেকে পাহাড় ও সমতলে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। আজ চুক্তির ১৪ বছর পর পাহাড়ে কতটুকু শান্তি ফিরেছে একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক।
চুক্তি বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দেওয়া যাক।
চুক্তির ‘ক’ খণ্ডের ২ ধারায় সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলি, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা হবে বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের সময়ে জারিকৃত ‘অপারেশন দাবানল’ চুক্তি-পরবর্তী সময়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া এ খণ্ডের ৩ নং ধারা অনুযায়ী চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠিত হলেও আজ অবধি এ কমিটির সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যালয়, জনবল এবং ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
চুক্তির ‘খ’ খণ্ড অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন পাস হলেও জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা প্রণীত না হওয়ায় মেয়াদ উত্তীর্ণ পরিষদগুলো মনোনীত ক্ষমতাসীন দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে জেলা পরিষদগুলো সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ খণ্ডের ৪(৫) ধারায় বলা আছে, সার্কেল চিফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করা হবে। কিন্তু ২০০০ সালের ২১ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রশাসনিক আদেশে বলা হয়েছে, সার্কেল চিফের পাশাপাশি পার্বত্য জেলার ডিসিরাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদ দিতে পারবেন, যা চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। গত বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সার্কুলারে বলা হয়, সার্কেল চিফ নয়, ডিসি কর্তৃক প্রদত্ত স্থায়ী সনদই প্রযোজ্য হবে! এ ছাড়া ২৪ ও ৩৩ (ক)(খ) ধারায় পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর ওপর জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এবং ২৬ ও ৩৪ (ক) ধারায় ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’র বিষয়টি ন্যস্ত করার কথা উল্লেখ থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বরং ১৯০০ সালের আইনকে জেলা প্রশাসকেরা যথাযথভাবে অনুসরণ করে নামজারি, ইজারাসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। যদিও ১৯০০ সালের অন্য আইনগুলো মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ করা যায়।
চুক্তির ‘গ’ খণ্ড অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণীত হলেও এ পরিষদের কার্যবিধিমালা আজ অবধি প্রণীত হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য জেলার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।
চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডে ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী পুনর্বাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও শরণার্থীদের অধিকাংশ পরিবার এখনো নিজেদের বাস্তুভিটা, বাগানবাগিচা ও ফসলি জমি ফেরত পায়নি। চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু আইনটি প্রণয়নের সময় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা করা হয়নি। এ আইনে ২২টি বিরোধাত্মক ধারা রয়েছে, যেগুলো চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমিসংক্রান্ত হলেও ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের একতরফা কিছু পদক্ষেপের ফলে এ কমিশনের ভূমিকা কার্যত স্তিমিত হয়ে আছে।
চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১৭ ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়া হলেও জনসংহতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৭৪টির মতো অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও সরকারের হিসাব অনুযায়ী, চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মোট ২০০টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয় (সূত্র: আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার কর্তৃক উপস্থাপিত রিপোর্ট, ২০১১ )।
চুক্তি-উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ডজনের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার ঘটনার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, যে শান্তির লক্ষ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছিল, সে লক্ষ্য গত ১৪ বছরেও অর্জিত হয়নি। বাঘাইহাটের লাদুমনি, লক্ষ্মীবিজয়, বুদ্ধপুদি চাকমা কিংবা রামগড়ের আইয়ুব আলীর সন্তানেরা কি কখনো ভেবেছিল চুক্তি-উত্তর শান্তির পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর গুলি ও সাম্প্রদায়িক হামলায় তাদের বাবা-মা প্রাণ হারিয়ে সারা জীবনের জন্য তারা পিতৃ-মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে! যে প্রজন্ম পার্বত্য চুক্তির সুবাতাসে শ্বাস নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, তারা আজ কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই বাবা-মাকে হারিয়ে জীবনের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। রুমার আদিবাসীরা কি কখনো ভেবেছিল চুক্তি-উত্তর শান্তির (!) পাহাড়ে নিজ বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য পাহাড় ডিঙিয়ে লংমার্চ করতে হবে! বাঘাইহাট থেকে রুমা, লক্ষ্মীছড়ি থেকে থানচির সীমান্তবর্তী গ্রাম বড় মদকের কারবারিদের কেন বারবার নিপীড়নের শিকার হতে হবে? চুক্তির ১৪ বছর পরও কেন পাহাড়ের অধিবাসীরা অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকবে? যে দল আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক বলে দাবি করেছিল, তারাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের পরিচয়সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
নব্বই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে বহির্বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করার জন্য সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নে তাদের আন্তরিক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ত ৎ কালীন সময়ের প্রকৃত চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কার্যক্রমটি চুক্তির পর পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামে পার্বত্য চুক্তির ওপর একটি পর্যালোচনা উত্থাপিত হওয়ার পর আবারও নব্বই দশকের সেই কার্যক্রম ফিরে এসেছে। এ ছাড়া দুর্গম পাহাড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ‘শিক্ষাতরী’ বাস সার্ভিস চালুসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
সবশেষে বলতে চাই, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত শান্তির মডেলটি জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেখানে মানুষের ভোটের অধিকারসহ প্রত্যেক গোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ সুগম করার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া যে দেশ থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বাধিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল হয়, সে দেশের কোনো অঞ্চলে গণতন্ত্র ও শান্তি বিপন্ন থাকুক; সেটি কারোরই কাম্য নয়। তাই বিগত ১৪ বছরে অপ্রাপ্তির বেদনায় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যে দীর্ঘশ্বাস পুঞ্জীভূত হয়েছে তা অচিরেই দূর করা প্রয়োজন। এ জন্য চাই পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নসহ বেসামরিক প্রশাসনকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
চুক্তির ‘ক’ খণ্ডের ২ ধারায় সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলি, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা হবে বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের সময়ে জারিকৃত ‘অপারেশন দাবানল’ চুক্তি-পরবর্তী সময়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া এ খণ্ডের ৩ নং ধারা অনুযায়ী চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠিত হলেও আজ অবধি এ কমিটির সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যালয়, জনবল এবং ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
চুক্তির ‘খ’ খণ্ড অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন পাস হলেও জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা প্রণীত না হওয়ায় মেয়াদ উত্তীর্ণ পরিষদগুলো মনোনীত ক্ষমতাসীন দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে জেলা পরিষদগুলো সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ খণ্ডের ৪(৫) ধারায় বলা আছে, সার্কেল চিফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করা হবে। কিন্তু ২০০০ সালের ২১ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রশাসনিক আদেশে বলা হয়েছে, সার্কেল চিফের পাশাপাশি পার্বত্য জেলার ডিসিরাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদ দিতে পারবেন, যা চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। গত বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সার্কুলারে বলা হয়, সার্কেল চিফ নয়, ডিসি কর্তৃক প্রদত্ত স্থায়ী সনদই প্রযোজ্য হবে! এ ছাড়া ২৪ ও ৩৩ (ক)(খ) ধারায় পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর ওপর জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এবং ২৬ ও ৩৪ (ক) ধারায় ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’র বিষয়টি ন্যস্ত করার কথা উল্লেখ থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বরং ১৯০০ সালের আইনকে জেলা প্রশাসকেরা যথাযথভাবে অনুসরণ করে নামজারি, ইজারাসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। যদিও ১৯০০ সালের অন্য আইনগুলো মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ করা যায়।
চুক্তির ‘গ’ খণ্ড অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণীত হলেও এ পরিষদের কার্যবিধিমালা আজ অবধি প্রণীত হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য জেলার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।
চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডে ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী পুনর্বাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও শরণার্থীদের অধিকাংশ পরিবার এখনো নিজেদের বাস্তুভিটা, বাগানবাগিচা ও ফসলি জমি ফেরত পায়নি। চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু আইনটি প্রণয়নের সময় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা করা হয়নি। এ আইনে ২২টি বিরোধাত্মক ধারা রয়েছে, যেগুলো চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমিসংক্রান্ত হলেও ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের একতরফা কিছু পদক্ষেপের ফলে এ কমিশনের ভূমিকা কার্যত স্তিমিত হয়ে আছে।
চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১৭ ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়া হলেও জনসংহতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৭৪টির মতো অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও সরকারের হিসাব অনুযায়ী, চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মোট ২০০টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয় (সূত্র: আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার কর্তৃক উপস্থাপিত রিপোর্ট, ২০১১ )।
চুক্তি-উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ডজনের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার ঘটনার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, যে শান্তির লক্ষ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছিল, সে লক্ষ্য গত ১৪ বছরেও অর্জিত হয়নি। বাঘাইহাটের লাদুমনি, লক্ষ্মীবিজয়, বুদ্ধপুদি চাকমা কিংবা রামগড়ের আইয়ুব আলীর সন্তানেরা কি কখনো ভেবেছিল চুক্তি-উত্তর শান্তির পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর গুলি ও সাম্প্রদায়িক হামলায় তাদের বাবা-মা প্রাণ হারিয়ে সারা জীবনের জন্য তারা পিতৃ-মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে! যে প্রজন্ম পার্বত্য চুক্তির সুবাতাসে শ্বাস নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, তারা আজ কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই বাবা-মাকে হারিয়ে জীবনের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। রুমার আদিবাসীরা কি কখনো ভেবেছিল চুক্তি-উত্তর শান্তির (!) পাহাড়ে নিজ বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য পাহাড় ডিঙিয়ে লংমার্চ করতে হবে! বাঘাইহাট থেকে রুমা, লক্ষ্মীছড়ি থেকে থানচির সীমান্তবর্তী গ্রাম বড় মদকের কারবারিদের কেন বারবার নিপীড়নের শিকার হতে হবে? চুক্তির ১৪ বছর পরও কেন পাহাড়ের অধিবাসীরা অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকবে? যে দল আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক বলে দাবি করেছিল, তারাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের পরিচয়সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
নব্বই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে বহির্বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করার জন্য সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নে তাদের আন্তরিক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ত ৎ কালীন সময়ের প্রকৃত চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কার্যক্রমটি চুক্তির পর পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামে পার্বত্য চুক্তির ওপর একটি পর্যালোচনা উত্থাপিত হওয়ার পর আবারও নব্বই দশকের সেই কার্যক্রম ফিরে এসেছে। এ ছাড়া দুর্গম পাহাড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ‘শিক্ষাতরী’ বাস সার্ভিস চালুসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
সবশেষে বলতে চাই, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত শান্তির মডেলটি জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেখানে মানুষের ভোটের অধিকারসহ প্রত্যেক গোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ সুগম করার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া যে দেশ থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বাধিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল হয়, সে দেশের কোনো অঞ্চলে গণতন্ত্র ও শান্তি বিপন্ন থাকুক; সেটি কারোরই কাম্য নয়। তাই বিগত ১৪ বছরে অপ্রাপ্তির বেদনায় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যে দীর্ঘশ্বাস পুঞ্জীভূত হয়েছে তা অচিরেই দূর করা প্রয়োজন। এ জন্য চাই পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নসহ বেসামরিক প্রশাসনকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
No comments