উপজেলার উপকথা by আবু এন এম ওয়াহিদ

কটি বিশেষ সময়ে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কোনো সরকারকেই নিরঙ্কুশভাবে ভালো কিংবা খারাপ_কোনোটাই বলা যায় না। সব সরকারই জনগণের জন্য কিছু না কিছু ভালো কাজ করে থাকে। আবার উল্টাপাল্টাও কম করে না। আশির দশকের জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারও কোনো অংশে এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রথমদিকে এরশাদের সরকার একটি বেআইনি জবরদস্তিমূলক সামরিক সরকার ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পরবর্তী সময়ে এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। নির্বাচন করেছেন। সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল নিয়ে দেশ শাসন করেছেন এবং আরো অনেক কিছু করেছেন। উর্দি ছেড়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরেছেন। গণতান্ত্রিক পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেছেন। বর্তমান সরকারের সক্রিয় অংশীদার হয়েছেন। তবু স্বৈরাচারী খেতাব ঘোচাতে পারেননি।
তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধীরা সুযোগ পেলেই তাঁকে কথায় কথায় এখনো স্বৈরাচারী বলে গালি দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, একসময় হয়তো এরশাদ নির্যাতনকারী ও স্বৈরাচারী ছিলেন, তবে এখন আর নন। তাঁর আমলে যেমন বেশুমার আকাম-কুকাম এবং দুর্নীতি হয়েছে, তেমনি অনেক ভালো কাজও হয়েছে। যেমন_সারা দেশের গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্টের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে বড় বড় শহরের রেল যোগাযোগে বৈপ্লবিক উন্নতি দেখা গেছে। রাজধানীতে তৈরি হয়েছে নর্থ সাউথ রোড, পান্থপথ, সেনাকুঞ্জ ও ওসমানী মিলনায়তনসহ আরো অনেক সুন্দর সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান, ঢাকার পাশে হয়েছে ডিএনডি বেড়িবাঁধ ইত্যাদি। এত কিছুর পরও আমার মতে এরশাদ আমলের সবচেয়ে বড়, যুগান্তকারী ও ইতিবাচক কাজ ছিল তাঁর বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়াস। যেমন_উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসন ও উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উপজেলাব্যবস্থাকে জোরদার করে গড়ে তোলার চেষ্টা। আইন-আদালত বিষয়ে আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ কম, তাই এ ব্যাপারে আমার পক্ষে বিশেষ কিছু বলা বা লেখা সমীচীন মনে করি না। আশা করি, ভবিষ্যতে কোনো সময় সুযোগ পেলে প্রথম আলোর জনপ্রিয় আইন বিশারদ ও কলামিস্ট মিজানুর রহমান খান এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা আমাদের উপহার দেবেন। আমি আমার আজকের আলোচনা উপজেলা বিষয়ে সীমিত রাখার চেষ্টা করব। আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে, উনিশ শ আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমি তখন বোস্টনে নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সে সময় অনলাইনে ঢাকার কোনো কাগজ পাওয়া যেত না। আমি দেশের বাংলা পেপার পড়ার জন্য দুই বাস বদলে অনেক কষ্ট করে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত ওয়াইডনার লাইব্রেরিতে যেতাম। এমনি একদিন খবরের কাগজের পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মফস্বলের কোনো এক নাম না জানা থানায় গিয়ে মান উন্নীত করে ওই থানাকে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন। ছবিতে এবং খবরের বিস্তারিত বর্ণনায় দেখেছিলাম, অনুষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি ঘিরে ওই থানার জনগণের মধ্যে সীমাহীন উৎসাহ আর উদ্দীপনার ঝলক। তখনই আমার মনে হয়েছিল যে এরশাদ একটি কাজের কাজই করছেন এবং এই কাজটি অনেক আগে অন্য কারো শুরু করা উচিত ছিল। মনে মনে বলেছিলাম, 'বেটার লেট দেন নেভার।'
কিন্তু দুঃখের বিষয়, নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক ও শক্তিশালী রূপ পাওয়ার আগেই জাতীয় রাজনীতিতে শুরু হয়ে গেল টালমাটাল অবস্থা। এরশাদবিরোধী আন্দোলন দ্রুত জোরদার হতে লাগল। বসুনিয়া, নূর হোসেন, ডা. মিলনরা আত্মাহুতি দিলেন। আওয়ামী লীগ রাজনীতির ঘুঁটির চালে একটু ভুল করে ফেলল। খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এরশাদ সরকারের পতন হলো। সব রাজনৈতিক জোটের সমঝোতার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো। ১৯৯১ সালে নির্বাচন হলো। নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করল। নির্বাচনের পর নিতান্তই ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং হিংসা-বিদ্বেষবশত খালেদা জিয়া কলমের এক খোঁচায় উপজেলাব্যবস্থা নাকচ করে দিলেন। এরপর সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে কী বিএনপি, কী আওয়ামী লীগ_কেউই আর উপজেলাব্যবস্থা নিয়ে কোনো সিরিয়াস ও গভীর চিন্তাভাবনা করেনি। এক-এগারোর পর মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় উন্নয়নে উপজেলার গুরুত্ব এবং বিশেষত্ব আবার আলোচনায় সামনে চলে এল। এ ব্যাপারে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি_সবাই এক বাক্যে বলতে লাগলেন, 'আমরা শক্তিশালী উপজেলাব্যবস্থা চাই।' শক্তিশালী উপজেলা ছাড়া স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় উন্নয়নের সফলতা সম্ভব নয়। উপজেলাব্যবস্থার আইন-কানুন, ক্ষমতার ভাগাভাগি ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলো। বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হলো। মোটামুটি সবাই উপজেলাব্যবস্থাকে জোরদার করে গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হলেন। সে লক্ষ্যে উপজেলা নিয়ে কিছু কাঠামোগত নিয়ম-কানুন হলো, নির্বাচনী আইন হলো, নির্বাচন হলো। এ পর্যন্ত সবই ভালো হলো। তারপর উপজেলা পরিষদ যখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করবে, তখনই শুরু হয়ে গেল যত ধানাইপানাই। দলবেঁধে স্থানীয় এমপিরা কেন্দ্রে গেলেন। নিজ নিজ নেত্রীর কাছে কান্নাকাটি শুরু করলেন। এমপিদের বক্তব্য, 'উপজেলার উন্নয়ন, কাজকর্মের পরিকল্পনা এবং কার্যসম্পাদন যদি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানরা করতে থাকেন, তাহলে এমপিরা তাঁদের অঞ্চলে এবং জনগণের কাছে অপাঙ্ক্তেয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন। এ ছাড়া কন্ট্রাক্টর ও ঠিকাদাররাও এমপিদের পাত্তা দেবেন না। তাঁদের সঙ্গে এমপিদের মোয়ামেলাত বন্ধ হয়ে যাবে। এতে এমপিরা স্থানীয়ভাবে শুধু যে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি হারাবেন তা-ই নয়, বরং আর্থিকভাবেও সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এমতাবস্থায় কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি_সব এমপিই তাঁদের নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, 'কোনোভাবেই উপজেলার ষোল আনা মাতব্বরি নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।' এমপিরা যেহেতু সরকারের মূল নিয়ামক শক্তি, সংসদীয় গণতন্ত্রে এমপিদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে সরকারের অস্তিত্ব_তাই সরকার, দলীয় নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রী এমপিদের স্বার্থে সহজেই উপজেলা পরিষদ ও অসংখ্য উপজেলাবাসীর স্বার্থকে নির্দ্বিধায় কোরবান করে দিলেন।
আমি ছোট্ট একটি প্রশ্ন রেখে আজকের এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। প্রশ্নটি হলো, 'এমপিরা যদি দেশের আইন প্রণয়নের ওপর স্থানীয় উন্নয়ন কাজকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তাহলে এমপি না হয়ে উপজেলা পরিষদে নির্বাচন করলেন না কেন?
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর_জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ, awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.