পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
বর্তমানে পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার নতুন দিক হচ্ছে এই যে, সামরিক বাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচিত সরকার ছাড়াও সেখানে সাধারণ জনগণ এখন মার্কিনবিরোধী হিসেবে একটি গণ্য শক্তি। যতই অসংগঠিত হোক, একে অবহেলা করার উপায় নেই, এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির ওপর অল্প বিস্তর যা-ই বিস্তার করুক।
এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বে পাকিস্তানে এখন এক টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে, যাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির হিসাবের বাইরে রাখার উপায় নেই
পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেভাবে তৎপর থাকে ও ভূমিকা রাখে এটা অন্য কোনো দেশে ঠিক এভাবে দেখা যায় না, দেখা গেলেও কদাচিৎ দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের চক্রান্ত ও হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এটা সত্য। সরাসরি হামলা চালিয়ে অন্য যেসব দেশ দখল করার দৃষ্টান্ত তাদের আছে সেসব দেশেও তারা দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক চক্রান্ত এবং তৎপরতা এভাবে রাখে না বা তার কোনো দৃষ্টান্ত সেভাবে দেখা যায় না যেভাবে এটা দেখা যায় পাকিস্তানে। এটা শুধু আজকের ব্যাপার নয়, পাকিস্তান একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের কয়েক বছর পর থেকেই, বিশেষত ব্রিটিশের তুলনায় গণশক্তিকে পরিণত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পাকিস্তানে সবসময়ই একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে, যা সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এর ফলে সমগ্র রাজনীতি ক্ষেত্রে একটা বিষাক্ত অগণতান্ত্রিক আবহাওয়া সেখানকার সাধারণ পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পশ্চিম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পর সেখানে এই অবস্থা প্রায় অপ্রতিহতভাবে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। অনেক সময় এই প্রভাব সেখানে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
আশির দশকে আফগান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মুঠো আরও শক্ত করেছে। যেভাবে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে, বলা চলে কার্যত সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তারা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের অনুমতি ছাড়াই, এমনকি তাদের অগোচরে এবং একই সঙ্গে খোলাখুলিভাবে নানা কীর্তিকলাপ করে চলেছে_ এটা তারা কোনো কোনো লাতিন আমেরিকান দেশে করেছিল। এখন তারা তাদের সেই হস্তক্ষেপের ধরন অনেকখানি পরিবর্তন করে প্রায় মরিয়া অবস্থাতেই পাকিস্তানে সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে নানা ধরনের হস্তক্ষেপ করছে। বস্তুতপক্ষে অহরহ গণতন্ত্রের জয়গান করতে থাকা মার্কিন রাষ্ট্র পরিচালকরাই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সবকিছু খতম করে সে দেশে সামরিক বাহিনীকে শুধু ক্ষমতাতেই বারবার বসায়নি, সামরিক বাহিনীকে একটি রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি আলোচনার সময় এ বিষয়টির প্রতি উদাসীন থেকে বা এর গুরুত্ব উপলব্ধি না করে সঠিকভাবে কোনো চিন্তাই সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ও নির্বাচিত সরকারের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব চলছে, যার ইস্যুর জোগান দিয়েছে ও দিয়ে চলেছে মার্কিন সরকার। এই দ্বন্দ্বের গতি যে তাদের অঙ্গুলি হেলনেই নির্ণীত হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামরিক শাসন-ক্লান্ত পাকিস্তানের জনগণ এখন সে দেশে সামরিক সরকারের মাধ্যমে নিরঙ্কুশভাবে মার্কিন প্রভুত্ব কায়েম রাখার বিরুদ্ধে নিজেদের মত ইতিমধ্যেই নানাভাবে প্রকাশ করে আসছে। পাকিস্তানের জনগণের মতো মার্কিনবিরোধী জনগণ এখন বিশ্বে আর কোথাও নেই। একদিকে মার্কিন বিরোধিতা এবং অন্যদিকে সামরিক শাসন বিরোধিতা মিলে পাকিস্তানে এখন নতুন করে সামরিক সরকারের প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের জানান জনগণ এখন এমনভাবে দিচ্ছেন, যার প্রতিফলন ঘটছে তাদের বর্তমান নির্বাচিত সরকারের মধ্যেও। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, এই নির্বাচিত সরকারও প্রকৃতপক্ষে কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি নয়, এরাও দুর্নীতিবাজ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। সামরিক সরকার ও মার্কিন সরকারের সৃষ্ট নানা চক্রান্তের কারণে তাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যে ধরনের দ্বন্দ্ব এখন সৃষ্টি হয়েছে এটা আগে হলে সামরিক বাহিনী বিলম্ব না করে নির্বাচিত সরকারকে নিমিষেই নস্যাৎ করে ক্ষমতা দখল করত। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা তাদের দ্বারা সহজে সম্ভব হচ্ছে না।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেনি, এ কথা ইমরান খান কয়েকদিন আগে বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, সে শিক্ষা নিলে তারা বর্তমানে পশতুন বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের সঙ্গে যে ব্যবহার করছে সেটা তারা করত না। এ ব্যবহারের কারণে পশতুনদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের যে তিক্ত সম্পর্ক ও তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এটা হতো না। এর পরিণতির ইঙ্গিতও ইমরান খান দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল পশতুনদের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে, এই তার ভবিষ্যদ্বাণী, যদি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তার নীতি ও কার্যকলাপ পরিত্যাগ না করে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান নির্বাচিত সরকার প্রধানকে হুকুম করেছেন, তার কিছু বক্তব্যের জবাবদিহি করতে ও তা প্রত্যাহার করতে! যে দেশে সামরিক বাহিনী একটি নির্বাচিত সরকারকে এইভাবে হুকুম দিতে পারে, সে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসেবে কে বেশি শক্তিশালী_ নির্বাচিত সরকার, না সামরিক বাহিনী, এটা বোঝার কোনো অসুবিধা নেই।
সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল কায়ানি এবং প্রধানমন্ত্রী গিলানির মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন যেভাবে চলছে তা লক্ষ্য করার মতো। কারণ এর পরিণতি আগের মতো সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তন না ঘটিয়ে আগামী নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনতে পারে। এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে কারণে সেটা হলো, একদিকে মার্কিন সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণের মার্কিন বিরোধিতা। এই মার্কিন বিরোধিতা এখন এমন ব্যাপক ও গভীর যার তুলনা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের নয় মাসের আগে কোনো সময়ে দেখা যায়নি।
বর্তমানে পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার নতুন দিক হচ্ছে এই যে, সামরিক বাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচিত সরকার ছাড়াও সেখানে সাধারণ জনগণ এখন মার্কিনবিরোধী হিসেবে একটি গণ্য শক্তি। যতই অসংগঠিত হোক, একে অবহেলা করার উপায় নেই, এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির ওপর অল্পবিস্তর যা-ই বিস্তার করুক। এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বে পাকিস্তানে এখন এক টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে, যাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির হিসাবের বাইরে রাখার উপায় নেই।
মার্কিনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের কিছু অবনতি হলেও সামরিক বাহিনী যে পাকিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তির খুঁটি এতে সন্দেহ নেই। কাজেই এদের সম্পর্ক এখন পর্যন্ত খুব সুদৃঢ়। বর্তমানে সামরিক বাহিনী ও নির্বাচিত সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে পাকিস্তানে যদি নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সরকারকে ফেলে দিয়ে মার্কিনের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে, তাহলে এবার সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশে রাজনীতি যেদিকে মোড় নেবে তার মধ্যে অনেক নতুনত্ব থাকার সম্ভাবনা। এই নতুনত্ব সেখানে গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির শর্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অবদান রাখবে।
১৭.১.২০১২
পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেভাবে তৎপর থাকে ও ভূমিকা রাখে এটা অন্য কোনো দেশে ঠিক এভাবে দেখা যায় না, দেখা গেলেও কদাচিৎ দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের চক্রান্ত ও হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এটা সত্য। সরাসরি হামলা চালিয়ে অন্য যেসব দেশ দখল করার দৃষ্টান্ত তাদের আছে সেসব দেশেও তারা দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক চক্রান্ত এবং তৎপরতা এভাবে রাখে না বা তার কোনো দৃষ্টান্ত সেভাবে দেখা যায় না যেভাবে এটা দেখা যায় পাকিস্তানে। এটা শুধু আজকের ব্যাপার নয়, পাকিস্তান একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের কয়েক বছর পর থেকেই, বিশেষত ব্রিটিশের তুলনায় গণশক্তিকে পরিণত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পাকিস্তানে সবসময়ই একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে, যা সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এর ফলে সমগ্র রাজনীতি ক্ষেত্রে একটা বিষাক্ত অগণতান্ত্রিক আবহাওয়া সেখানকার সাধারণ পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পশ্চিম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পর সেখানে এই অবস্থা প্রায় অপ্রতিহতভাবে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। অনেক সময় এই প্রভাব সেখানে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
আশির দশকে আফগান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মুঠো আরও শক্ত করেছে। যেভাবে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে, বলা চলে কার্যত সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তারা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের অনুমতি ছাড়াই, এমনকি তাদের অগোচরে এবং একই সঙ্গে খোলাখুলিভাবে নানা কীর্তিকলাপ করে চলেছে_ এটা তারা কোনো কোনো লাতিন আমেরিকান দেশে করেছিল। এখন তারা তাদের সেই হস্তক্ষেপের ধরন অনেকখানি পরিবর্তন করে প্রায় মরিয়া অবস্থাতেই পাকিস্তানে সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে নানা ধরনের হস্তক্ষেপ করছে। বস্তুতপক্ষে অহরহ গণতন্ত্রের জয়গান করতে থাকা মার্কিন রাষ্ট্র পরিচালকরাই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সবকিছু খতম করে সে দেশে সামরিক বাহিনীকে শুধু ক্ষমতাতেই বারবার বসায়নি, সামরিক বাহিনীকে একটি রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি আলোচনার সময় এ বিষয়টির প্রতি উদাসীন থেকে বা এর গুরুত্ব উপলব্ধি না করে সঠিকভাবে কোনো চিন্তাই সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ও নির্বাচিত সরকারের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব চলছে, যার ইস্যুর জোগান দিয়েছে ও দিয়ে চলেছে মার্কিন সরকার। এই দ্বন্দ্বের গতি যে তাদের অঙ্গুলি হেলনেই নির্ণীত হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামরিক শাসন-ক্লান্ত পাকিস্তানের জনগণ এখন সে দেশে সামরিক সরকারের মাধ্যমে নিরঙ্কুশভাবে মার্কিন প্রভুত্ব কায়েম রাখার বিরুদ্ধে নিজেদের মত ইতিমধ্যেই নানাভাবে প্রকাশ করে আসছে। পাকিস্তানের জনগণের মতো মার্কিনবিরোধী জনগণ এখন বিশ্বে আর কোথাও নেই। একদিকে মার্কিন বিরোধিতা এবং অন্যদিকে সামরিক শাসন বিরোধিতা মিলে পাকিস্তানে এখন নতুন করে সামরিক সরকারের প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের জানান জনগণ এখন এমনভাবে দিচ্ছেন, যার প্রতিফলন ঘটছে তাদের বর্তমান নির্বাচিত সরকারের মধ্যেও। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, এই নির্বাচিত সরকারও প্রকৃতপক্ষে কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি নয়, এরাও দুর্নীতিবাজ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। সামরিক সরকার ও মার্কিন সরকারের সৃষ্ট নানা চক্রান্তের কারণে তাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যে ধরনের দ্বন্দ্ব এখন সৃষ্টি হয়েছে এটা আগে হলে সামরিক বাহিনী বিলম্ব না করে নির্বাচিত সরকারকে নিমিষেই নস্যাৎ করে ক্ষমতা দখল করত। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা তাদের দ্বারা সহজে সম্ভব হচ্ছে না।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেনি, এ কথা ইমরান খান কয়েকদিন আগে বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, সে শিক্ষা নিলে তারা বর্তমানে পশতুন বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের সঙ্গে যে ব্যবহার করছে সেটা তারা করত না। এ ব্যবহারের কারণে পশতুনদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের যে তিক্ত সম্পর্ক ও তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এটা হতো না। এর পরিণতির ইঙ্গিতও ইমরান খান দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল পশতুনদের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে, এই তার ভবিষ্যদ্বাণী, যদি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তার নীতি ও কার্যকলাপ পরিত্যাগ না করে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান নির্বাচিত সরকার প্রধানকে হুকুম করেছেন, তার কিছু বক্তব্যের জবাবদিহি করতে ও তা প্রত্যাহার করতে! যে দেশে সামরিক বাহিনী একটি নির্বাচিত সরকারকে এইভাবে হুকুম দিতে পারে, সে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসেবে কে বেশি শক্তিশালী_ নির্বাচিত সরকার, না সামরিক বাহিনী, এটা বোঝার কোনো অসুবিধা নেই।
সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল কায়ানি এবং প্রধানমন্ত্রী গিলানির মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন যেভাবে চলছে তা লক্ষ্য করার মতো। কারণ এর পরিণতি আগের মতো সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তন না ঘটিয়ে আগামী নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনতে পারে। এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে কারণে সেটা হলো, একদিকে মার্কিন সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণের মার্কিন বিরোধিতা। এই মার্কিন বিরোধিতা এখন এমন ব্যাপক ও গভীর যার তুলনা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের নয় মাসের আগে কোনো সময়ে দেখা যায়নি।
বর্তমানে পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার নতুন দিক হচ্ছে এই যে, সামরিক বাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচিত সরকার ছাড়াও সেখানে সাধারণ জনগণ এখন মার্কিনবিরোধী হিসেবে একটি গণ্য শক্তি। যতই অসংগঠিত হোক, একে অবহেলা করার উপায় নেই, এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির ওপর অল্পবিস্তর যা-ই বিস্তার করুক। এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বে পাকিস্তানে এখন এক টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে, যাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির হিসাবের বাইরে রাখার উপায় নেই।
মার্কিনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের কিছু অবনতি হলেও সামরিক বাহিনী যে পাকিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তির খুঁটি এতে সন্দেহ নেই। কাজেই এদের সম্পর্ক এখন পর্যন্ত খুব সুদৃঢ়। বর্তমানে সামরিক বাহিনী ও নির্বাচিত সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে পাকিস্তানে যদি নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সরকারকে ফেলে দিয়ে মার্কিনের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে, তাহলে এবার সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশে রাজনীতি যেদিকে মোড় নেবে তার মধ্যে অনেক নতুনত্ব থাকার সম্ভাবনা। এই নতুনত্ব সেখানে গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির শর্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অবদান রাখবে।
১৭.১.২০১২
No comments