বারটিল লিন্টনার-একটি নতুন বড় খেলা
গত ১৩ জানুয়ারি ২০০ কারাবন্দিকে মুক্তি দেওয়া এবং সেই সঙ্গে মিয়ানমারে ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রদূত পাঠানোর ঘোষণা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনারই পদক্ষেপ। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রকামী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নিরঙ্কুশ বিজয়কে মেনে না নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রই মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সমালোচক
হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সামরিক সরকার ও তাদের দোসরদের ওপর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফর করেন। গত অর্ধশতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ পর্যায়ের নেতার এটাই প্রথম মিয়ানমার সফর। তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট থাই সির নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করে একে গণতান্ত্রিক সংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। এদিকে গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে ক্লিনটন বলেন, বার্মাকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে দেখাটা ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। ধুলো সরে যেতে শুরু করলে এটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র উদ্বেগের কারণ নয়। এশিয়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী একটি নতুন কৌশল গড়ে তুলেছে। ১৯৮৯ সালের পর এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। গণতন্ত্রের জন্য রক্তাক্ত আন্দোলনের মাত্র কয়েক মাস পরে যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বার্টন লেভিন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, 'যেহেতু মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি নেই এবং সামরিক স্বার্থ নেই বললেই চলে, তাই যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব মূল্যবোধ অনুসারে এখানে আয়েশে কাটাতে পারে।'
এরপরের বছর বার্টন মিয়ানমার ছেড়ে আসেন এবং তাঁর পরিবর্তে আর কেউ যাননি। ইতিমধ্যে মিয়ানমার চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তোলে। অনেক বিশেষজ্ঞই এ বিষয়টিকে মনে করেন পশ্চিমাদের মিয়ানমার শাসনকে ত্যাগ করার ফল। মিয়ানমারের নিকটতম প্রতিবেশী, বিশেষ করে ভারত চীনের দ্বারা ভারত মহাসাগরে গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন নির্মাণ পরিকল্পনা এবং লাইফলাইন নিরাপদ করার জন্য সম্ভাব্য সেনাছাউনি গড়ে তোলার বিষয়টিকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে। হয়তো আরো বেশি সতর্কবার্তা দেশটিতে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি। মিয়ানমারে উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি এ অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্যকে আরো কঠিন করে তুলবে।
সুতরাং এটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সময়, এখনই নীতি পরিবর্তন করে একজন রাষ্ট্রদূত পাঠানো। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য মিয়ানমারের কাছে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতিই দিক না কেন, তা অনুমান করার বিষয়। কিন্তু একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে আংশিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশের বিষয়টি সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটনের সঙ্গে মিয়ানমারের বল খেলার ইচ্ছা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর প্রথম প্রমাণ মিলেছে ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রেসিডেন্ট থাই সি চীনের সহায়তায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কোচিন রাজ্যে মাইসন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের ঘোসণা দিয়েছেন। চীন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রথমে মামলা করার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু পরে দেখেশুনে চলার নীতি অবলম্বন করেছে। চীন সম্ভবত এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বিতণ্ডা করে অতি গুরুত্বপূর্ণদের ও গ্যাস পাইপলাইনের বিবিয়োগ নিয়ে বিশৃঙ্খলায় পড়তে চাইছে না। কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে চীনের ওপর নির্ভর করা নিয়ে যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, সেটাও একটা কারণ। এটা ভোলার নয় যে ৬০ ও ৭০-এর দশকে চীন মিয়ানমারের কমিউনিস্ট পার্টির ইনসার্জেন্টদের বিশাল সমর্থন দিয়েছে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানি বাণিজ্যে চীনের প্রভাব, ভূমি মালিকানার সঙ্গে যোগ হয়েছে অবৈধ অভিবাসীর বিষয়টি, যা মিয়ানমারের জাতীয় সেন্টিমেন্টকে নাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্থিরতার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, থাই সি প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে ক্লিনটনের সঙ্গে আলাপ করেন, সেটি চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে। হিলারি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ভালো সম্পর্ককে সমর্থন করার কথা জানিয়েছেন, যদি সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে, যদি মিয়ানমারের সরকার সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তি বাতিল করে।
মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক ওয়াশিংটনের কাছে একটি সমস্যা। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতি মাসে উত্তর কোরিয়ার জাহাজ মিয়ানমারের বন্দরে এসে থামে। জাহাজ চলাচলের রেকর্ড অনুসারে নিয়ে আসে সিমেন্ট এবং সাধারণ পণ্য। যাওয়ার সময় নিয়ে যায় চাল। এটি একটি অদলবদল ব্যবসা। মিয়ানমারের রয়েছে প্রচুর চাল, তারা উত্তর কোরিয়াকে দিচ্ছে খাবার, যার তীব্র সংকট রয়েছে। দুই দেশের ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবহার দুই দেশের জন্যই মুশকিল।
২০০৯ সালে ইয়েলগ্লোবাল একটি রিপোর্ট করেছে যে, মধ্য মিয়ানমারের মিনলায় যে ডিফেন্স ইন্ডস্রি করা হচ্ছে এবং যে মাটির নিচের বাংকার তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে উত্তর কোরিয়ার কেনিমিয়ানতের দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ডিজাইনে মিয়ানমারের সরকার স্কাড ধরনের মিসাইল তৈরি করছে। ২০০৯ সালে যুক্ততরাষ্ট্রের নেনভি উত্তর কোরিয়ার একটি মালবাহী ক্যাং ন্যাম ১-কে ধাওয়া করে, যাকে অস্ত্রের কার্গো ছিল বলে মনে করা হয়। জাহাজটি বাধ্য হয়ে উত্তর কোরিয়ায় ফিরে যায়। অবৈধ পণ্য পরিবহনের জন্য জাতিসংঘের ১৮৭৪ রেজুলেশন অনুসারে উত্তর কোরিয়ার জাহাজ খতিয়ে দেখা অনুমোদন করে।
লেখক : থাইল্যান্ডভিত্তিক সুইডিশ সাংবাদিক। ব্লাড ব্রাদার্স : এ ক্রিমিনাল আন্ডার ওয়ার্ল্ড অব এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রন্থের প্রণেতা।
ভারতের আউটলুক থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments