কালান্তরের কড়চা-চাণক্যপুরীর কূটকৌশল এবং বাংলাদেশের বিদেশনীতি by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

ন্ডনের সানডে টাইমসের ১১ সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায়ই একটি খবর বেরিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, 'Four former foreign secretaries have called on David Cameron to confront Russian leaders this week over the regin's hostility to businessman, lawyers and journalists.' এর বাংলা সরলার্থ হচ্ছে, ব্রিটেনের চারজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে এই সপ্তাহের বৈঠকে শক্ত মনোভাব দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন।


তাঁরা মনে করেন, রাশিয়া ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের প্রতি খুব বিরূপ নীতি অনুসরণ করছে।
ডেভিড ক্যামেরন গত রবিবার মস্কো যাত্রা করেছেন। যাত্রার আগে তিনি যে চারজন সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাঁরা সাবেক লেবার ও টোরি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। রাশিয়া ও ব্রিটেনের সম্পর্ক এখন খুব ভালো নয়। এ সম্পর্ক মেরামত করা এবং দুই দেশের মধ্যে আবার মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য; যা ব্রিটেনের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, তা শক্ত না নরম মনোভাব দেখিয়ে অর্জন করা যাবে, তা নিয়ে অভিজ্ঞ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করা যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন, তেমনি তাঁকে এই পরামর্শ দেওয়াটা আগের দলীয় এবং অন্য দলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও নিজেদের জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে সাবেক চার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বৈঠক।
কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনো দলীয় সরকারের দলীয় স্বার্থরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয় না। তৈরি হয় জাতির বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর এই নীতির প্রশ্নে কিছু হেরফের থাকতেই পারে এবং থাকে; কিন্তু সব দলেরই অভিন্ন লক্ষ্য থাকে জাতীয় স্বার্থরক্ষা। এ জন্যই ইরাক যুদ্ধের সময় লেবারদলীয় ব্লেয়ার সরকারের পক্ষে ভোট দিতে টোরি দল দ্বিধা করেনি এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লেবার পার্টি টোরি চার্চিলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে যোগ দিতে দেরি করেনি।
কিউবান ক্রাইসিসের সময় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট কেনেডি সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টকে ডেকে এনেছেন হোয়াইট হাউসে তাঁর পরামর্শ গ্রহণের জন্য এবং ব্রিটেনে লেবার গভর্মেন্টের টনি ব্লেয়ার ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছেন সরকার পরিচালনায় তাঁর পরামর্শ শোনার জন্য। জাতির বা দেশের জরুরি অবস্থায় অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও বিরোধী দল আপাতত দলীয় ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সম্মিলিত মেধা ও প্রতিভা দ্বারা জাতীয় স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করে। সাবেক ও বর্তমান সরকারের নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিনিময় হয়। অনভিজ্ঞতা দ্বারা ও দলতান্ত্রিকতা দ্বারা যে জাতীয় সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করা যায় না, এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশই জানে এবং মেনে চলে। জাতির প্রয়োজনের মুহূর্তে তারা দলীয় ভেদাভেদ ভুলে যায়।
আগেই বলেছি, গণতান্ত্রিক বিশ্বে জাতির জরুরি অবস্থায় বা জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠার যে নজির দেখা যায়, হালে বাংলাদেশে তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাহলে বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে কি দেশপ্রেম নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু তা দলগুলোর দলীয় স্বার্থের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং সংকীর্ণতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়; পার্টি-স্বার্থ ও পাওয়ারের লোভ পেট্রিয়টিজমকে কাছে আসতে দেয় না।
তা নাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বপ্রধান শত্রু হিসেবে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা সর্বজনবিদিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে চরম অবজ্ঞা দেখানোর জন্য বললেন, 'বাংলাদেশ হচ্ছে তলাবিহীন ঝুড়ি', তখন আওয়ামী লীগবিরোধী কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কী করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এই কথা তাদের বক্তৃতা ও লেখায় বারবার উদ্ধৃত করে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন?
অন্য কোনো আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন দেশ হলে গোটা জাতির প্রতি এই ধৃষ্টতামূলক উক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে দেশটি গর্জে উঠত। কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। বরং এই উক্তি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে করা হয়েছে এই প্রচার চালিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুর উক্তিকে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, এলিট শ্রেণী_তথা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের একটি অংশ কতটা আত্মমর্যাদাবোধ ও দেশপ্রেমবর্জিত হতে পারে, তার আরেকটা উদাহরণ দিই। নোবেল পুরস্কার জয়ী ড. ইউনূসকে যখন যেকোনো কারণেই হোক গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধানের পদ থেকে সরে যেতে হয়, তখন এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম আদালতের দ্বারস্থ হতে ছুটে গিয়েছিলেন। যখন তিনি দেখলেন, মামলায় উচ্চ আদালতেও জয়ী হবেন না, তখন তিনি বলা শুরু করলেন, তিনি আদালতে সুবিচার পাবেন না এবং এটা তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ও শত্রুতামূলক আচরণ।
দেশে বসে এ ধরনের প্রচারণা চালানো হলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু দেশের উচ্চ আদালতে মামলাটি চলাকালীনই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে কর্তৃত্ব রক্ষা করার কাজে যুক্তরাষ্ট্রে দেন-দরবার শুরু করেন। ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানো সঠিক কাজ হয়েছে কী হয়নি, সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। তাঁকে অপসারণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তিনি একটি স্বঘোষিত নিরপেক্ষ দৈনিকের সহায়তায় গণ-আন্দোলন গড়ে তোলারও চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি চলতে থাকাকালে এবং দেশের এমন একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি বিদেশি হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে চেয়েছিলেন কিভাবে?
এখন তো উইকিলিকস ফাঁস করে দিয়েছে, ড. ইউনূস নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হয়েও কিভাবে দেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে একটি বিদেশি সুপারপাওয়ার এবং একটি সুপার দম্পতির (ক্লিনটন দম্পতি) হস্তক্ষেপ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এটা কি পেট্রিয়টিজম বা দেশপ্রেম? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে যখন ড. ইউনূসকে সরে যেতে বলা হয় এবং তা নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে মামলা চলার সময়ই ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনো কোনো কর্মকর্তা, মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁদের বন্ধুর পক্ষে এবং বাংলাদেশ সরকারকে কিছুটা শাসানি দিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম এবং ওপরে বর্ণিত একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সুশীল ব্যক্তিত্ব ও 'নিরপেক্ষ' পত্রিকার ভূমিকা দেখেছি।
ক্লাবে, পার্টিতে, ঘরোয়া সভায় সে সময় এদের দেখেছি দাঁত বের করে হাসতে। পরম সন্তোষের সঙ্গে এঁরা বলেছেন, 'এবার হাসিনা কোথায় যায় দেখব? ঠেলার নাম বাবাজি। ড. ইউনূসের পক্ষে এখন সুপারপাওয়ার আমেরিকা। দেখি, শেখ হাসিনা এখন ইউনূসের কাছে মাথানত না করে কোথায় যান?' তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, ড. ইউনূসকে রক্ষার জন্য আমেরিকা সম্ভবত বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দেবে।
আমি ঢাকা ক্লাবের এক পার্টিতে এ ধরনের উচ্চ নাসিকার এক বুদ্ধিজীবীকে বলেছিলাম, ড. ইউনূসের ওপর যদি কোনো অন্যায় ও অবিচার করা হয়ে থাকে, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তও যদি আপনাদের কাছে ন্যায়বিচার মনে না হয়, তাহলে সে কথা বলুন, প্রতিবাদ করুন, আন্দোলন করুন। কিন্তু দেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে চান কেন, আর সেই হস্তক্ষেপের সম্ভাবনায় উল্লাস প্রকাশ করেন কিভাবে? যদি এই হস্তক্ষেপ ঘটে এবং বিদেশি চাপের কাছে হাসিনা সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়, তাহলে সেটা কি দেশের জন্য গৌরবের হবে, না ড. ইউনূসের জন্য গৌরবের হবে? তিনি আমার কথায় নাসিকা কুঞ্চন করেছেন, জবাব দেননি। অবশ্য এই বুদ্ধিজীবীদের আশা পূর্ণ করতে ওয়াশিংটন আর ড. ইউনূসের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টিতে এগোয়নি এবং শেখ হাসিনাও কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি।
ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীতটা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমার আজকের আলোচ্য বিষয় আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের বা সরকারের ফরেন পলিসি বা বিদেশনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্যের অপরিহার্য ভূমিকার কথা। জাতির জরুরি প্রয়োজনে বা জরুরি মুহূর্তে অধিকাংশ দেশেই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে, এমনকি সর্বদলীয় ভিত্তিতে এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যের কথা, বাংলাদেশে এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে কখনো দেখা যায়নি এবং এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি চাপমুক্ত বিদেশনীতি নির্ধারণে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার ব্যাপারে আমরা সফল হতে পারি না, তাতে জাতীয় স্বার্থ ও অধিকারকে নিরাপত্তা দান নিশ্চিত করা সহজ হয় না।
বাংলাদেশের জন্য এটা খুবই অগৌরবের যে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশ আর কখনো বিদেশি চাপ অথবা প্রভাবমুক্ত বিদেশনীতি নির্ধারণ করতে পেরেছে কি না সন্দেহ। অনেক সময় নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের জন্য আমরাই বিদেশি হস্তক্ষেপকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছি। বিদেশি পর্যবেক্ষক ছাড়া আমরা একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাই না। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিদেশি মেরিন সৈন্য সরকারের বিনা আমন্ত্রণে, বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশে ঢোকে ত্রাণকাজ চালানোর নামে (খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে) এবং আমাদের সেনাবাহিনীর ত্রাণকাজের ওপর খবরদারি চালায়। তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয় না। আর বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা তো অনেকটাই ব্রিটিশ ভারতের দিলি্লতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ভাইসরয়ের মতো। তাতেও আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অমর্যাদা হয় না।
২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনের আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন আমাদের ঘরের ঝগড়া মেটাতে এবং দুই নেত্রীকে পাশে বসিয়ে এই উপদেশ দিতে যে নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, দুই নেত্রী যেন তা মেনে নেন। জিমি কার্টারের দূতিয়ালির পরিণতি যে কী দাঁড়ায় তা কি বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল জানত না? গোটা আরব বিশ্বের প্রতিবাদের মুখে মিসর-ইসরায়েল অশুভ আঁতাতের মধ্যস্থতা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জিমি কার্টার। পরিণতি মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদাতের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং সারা মধ্যপ্রাচ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষের বিস্তার লাভ। বাংলাদেশেও জিমি কার্টারের সালিসির পর অনুষ্ঠিত ২০০১ সালের নির্বাচন শেষে যে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার তুলনা বিরল। এর পরও বিদেশি সাহায্য, পরামর্শ ও সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি অচল।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আমরা যেমন দলীয় কোন্দলের ঊধর্ে্ব উঠতে পারি না, তেমনি বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও দেশের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে জানি না। পাকিস্তান ও ভারত দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের স্বার্থ ও অধিকারের দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এই স্বার্থ ও অধিকারের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের মিত্রতার সম্পর্ক রক্ষাও প্রয়োজন। আমেরিকার মতো সুপারপাওয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আরো সতর্ক থাকা এবং দৃঢ় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। নইলে কুমির ছানাকে শিক্ষিত করার নামে শিয়াল পণ্ডিতই তাকে ভক্ষণ করবে।
এ ব্যাপারে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই কতটা সচেতন সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও তারা জাতীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব দলীয় স্বার্থকে স্থান দেয়। পাকিস্তানের কাছ থেকে আমাদের পাওনা আদায় ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত সরকারকে লাজুক বধূর ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। তাদের সব চিৎকার ভারতের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ভারতের কাছ থেকে দাবি-দাওয়া আদায়ে নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনা দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করলেও তার পেছনে জাতীয় ঐকমত্যের দৃঢ় দেয়াল গড়ে তুলতে পারেন না অথবা চান না। নিজের ব্যক্তিত্ব ও দলীয় সরকারের কৃতিত্ব দ্বারাই ভারতের মতো চাণক্যবুদ্ধির অধিকারী বড় প্রতিবেশীর কাছ থেকে সব দাবি আদায় করে ফেলবেন ভাবেন। তা সব সময় সম্ভব হয় না, যেমন এবার হয়নি। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপমুক্ত সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টার কথা এখানে আর তুললাম না। আমেরিকার সুয়োরানি হওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলই এখন পরস্পরের সহযোগী নয়, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশে আমেরিকাকে তাই আর ড্রোন হামলা চালাতে হয় না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের এবারের ঢাকা সফরের সময় এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে বিদেশনীতিতে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও আমরা ঐকবদ্ধ হতে জানি না, দলীয় ভূমিকার ঊধর্ে্ব উঠতে পারি না, পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা দ্বারা চালিত হতে চাই না। ভারত আমাদের যত বড় বন্ধু বলে দাবি করুক, দিলি্ল যে আসলে চাণক্যপুরী এবং আধিপত্যবাদী কূটকৌশলই তার বর্তমান কূটনীতি_এই বাস্তবতা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এই কূটনীতির মোকাবিলায় আমাদের বর্তমান বিদেশনীতির সবলতা ও দুর্বলতার দিকটিই আমি একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চাই।
(পরবর্তী অংশ আগামী সপ্তাহে)
লন্ডন, ১২ সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০১১

No comments

Powered by Blogger.