গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন by ড. মোহাম্মদ ভূঁইয়া

গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কীভাবে অপসারণ করেছে, তা সবাই জানে। আমরা যারা বিদেশে থাকি, আমরা এটাও জানি যে এতে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিদ্যমান সব আইনকে উপেক্ষা করে সরকারের একটি অংশ এখন গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সব নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ নেবে, এটাই স্বাভাবিক।


সে অনুযায়ী গতবছর ২৬ জুলাই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ড. ইউনূসকে প্রধান করে এ জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করে। পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি খোন্দকার মোজাম্মেল হক সে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ খালেদ শামস, পরিচালক কামরুল হাসান ও ঋণগ্রহীতা পরিচালক রোজিনা বেগমকেও ওই সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত ২২ নভেম্বর ড. ইউনূসকে বাদ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি খোন্দকার মোজাম্মেল হক পাঁচ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেন। সরকারের তিনজন প্রতিনিধি ও দুজন ঋণগ্রহীতা পরিচালককে নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়। এটা স্পষ্টতই সব ধরনের সুস্থ ধারার চর্চার বিরোধী একটি পদক্ষেপ। কারণ এর ফলে সরকার ব্যাংকের মাত্র তিন ভাগ মালিকানা নিয়ে ৬০ ভাগ কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায়। নোবেল বিজয়ী একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে সরকারের একজন পুতুল নিয়োগ দেওয়া ছাড়া এ উদ্যোগের আর কোনো মাজেজা নেই। পরিচালনা পর্ষদ গত ২৯ ডিসেম্বর এ সিদ্ধান্তের জন্য গরিব নারী সদস্যদের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। এর ফলে সভাপতি মোজাম্মেল হক তাঁর এ সিদ্ধান্ত আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেন। সে সময় নতুন বোর্ড নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। যাই হোক, কোনো কারণ জানানো ছাড়াই মোজাম্মেল হক সম্প্রতি একটি বিশেষ সভা ডেকেছেন। সেখানে তিনি ব্যাংকের গরিব নারী সদস্যদের স্বার্থবিরোধী কিছু করেন কিনা সেদিকে বাংলাদেশের জনগণের অবশ্যই নজর রাখতে হবে। আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সরকারের নিয়োগকৃত অনুসন্ধানী কমিশনও ড. ইউনূসের দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। বিশ্বজুড়ে ড. ইউনূস একজন সৃজনশীল এবং গরিববান্ধব ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি তাঁর সাধারণ ও সৎ জীবনযাপনের জন্য সমধিক পরিচিত। সরকার এবং এর সমর্থকরা ভালো করেই জানে যে ড. ইউনূস যতদিন গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত থাকবেন ততদিন তারা এই ব্যাংক ও এর ৫৪টি স্বাধীন সামাজিক ব্যবসার বিশাল সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারবে না। এ জন্যই তারা ড. ইউনূসকে সরানোর জন্য সব আইনকানুন ভঙ্গ করে চলেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৭০ লাখের বেশি ঋণগ্রহীতা আছে। বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতাই গরিব, যাদের সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো ক্ষমতা নেই। আমি মনে করি এখন সব নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন নাগরিকের সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সময় এসেছে, যাতে গরিব ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো সরকার জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। যদি বেশির ভাগ মানুষ সরকারকে গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো প্রকার বেআইনি হস্তক্ষেপ না করার দাবি জানায় তবে এর একটা প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে। জানা যায়, সরকারের বেশির ভাগ নেতাই নিজেদের জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ জড়ো করেছেন। আমি মনে করি এখন তাঁরা অন্তত দেশ ও জনগণের স্বার্থে কিছু করতে পারেন। তাঁরা সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করতে পারেন তা হলো গ্রামীণ ব্যাংক ও এর অন্যান্য সামাজিক ব্যবসা থেকে তাদের কর্তৃত্ব প্রত্যাহার করা। এ ছাড়াও তাঁরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য ড. ইউনূসের সাহায্য কামনা করতে পারেন। একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে আমি আশা করব, সরকার ড. ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক ও এর ৫৪টি সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে তার মনোভাব পুনর্বিবেচনা করবে। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল করবে না, বরং দেশেও তার রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.