ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও এম জি কিবরিয়া সরকার-ই-ভোটিং বললে অসুবিধা কোথায়?

ক. ই-ভোটিং নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনাররা বলছেন, তাঁরা ই-ভোটিং করছেন না। যা করছেন তাকে ই-ভোটিং না বলে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বলছেন। ই-ভোটিং নিয়ে মানুষের মনে আশঙ্কা দূর করতে নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগ ভালো অর্থে হলেও এটি মূলত একটি ভুল ব্যাখ্যা এবং ইভিএম যে আসলে ইলেকট্রনিক ভোটিংই তা স্পষ্ট। নির্বাচন কমিশন কেন এই ব্যবস্থাকে ই-ভোটিং বলতে নারাজ?


কোনো সন্দেহ নেই, নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য সৎ এ বিষয়ে। ই-ভোটিং নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ দূর করতে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে বিশদ ধারণা দিতে শুধু এটিকে ইভিএম নামে অভিহিত করছে। কারণ, ইলেকট্রনিক ভোটিং বলতে আমরা যা বুঝি_একটি বিশেষ যন্ত্র, যা অতি আধুনিক, যেখানে বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেখানে ভোট প্রদান করা যায়। আর ইন্টারনেটের কথা এলেই মনে ভয় ঢুকে যায় খুব সহজেই। বর্তমান দুনিয়ায় উন্নত প্রতিরক্ষাবূ্যহ থাকা সত্ত্বেও হ্যাকাররা হানা দেয় বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এবং প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙে পুরো ব্যবস্থাটিকে নষ্ট করে ফেলে। সুতরাং ই-ভোটিং বলতেই যদি ইন্টারনেটযুক্ত এমন একটি ব্যবস্থার কথা মনে ভেসে ওঠে, তাহলে সন্দেহটি প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গে ইন্টারনেটের কোনো সংযোগ থাকবে না। শুধু তাই নয়, এই যন্ত্রে অতি আধুনিক ইভিএমের যে সুযোগ-সুবিধা থাকে সেগুলোও নেই এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার প্রয়োজনও নেই আমাদের নির্বাচনে। ই-ভোটিং বললেই যেহেতু ইন্টারনেটনির্ভর এমন একটি ভোটিং ব্যবস্থা বুঝি, তাই সন্দেহ দূর করার জন্যই নির্বাচন কমিশন এই ব্যবস্থাকে ই-ভোটিং না বলে শুধু ইভিএম বলছে।
দুই. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ই-ভোটিং বিভিন্ন রকমের। আমাদের পাশের দেশ ভারতে যে ধরনের ইভিএম ব্যবহার করা হয়, তাতে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ এবং গণনা করা হয়ে থাকে এবং এসব দেশেই এই আধুনিক ব্যবস্থাকে ই-ভোটিং ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই আর ইভিএম যন্ত্র টাচ স্ক্রিন হলেই সেই ব্যবস্থা ই-ভোটিং, আর না হলে শুধু ইভিএম_এভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থায় যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আধুনিক হোক বা না হোক সে তো ইলেকট্রনিক ভোটিংই। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারে যে ধরনের সুবিধা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারে আছে, তাই বলে কি আমরা প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারকে কম্পিউটার বলব না? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যে ধরনের ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হয় সেই ধরনের যন্ত্র এবং সুবিধায় পেঁৗছতে আমাদের আরো অনেক সময় পার করতে হবে। পাশাপাশি এটিও মানতে হবে, আমাদের আগামী দিনের নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা ইলেকট্রনিক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। উন্নত বিশ্বে এই ব্যবস্থাটি এখন সর্বাধুনিক পর্যায়ে থাকলেও আমাদেরটি তাদের তুলনায় রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু সেটিও ইলেকট্রনিক ভোটিং। আমাদের জন্য যা বর্তমানে ব্যবহৃত কাগজি ব্যালট ব্যবস্থার তুলনায় উন্নত ও আধুনিক ব্যবস্থা, কিন্তু আমেরিকা বা দুনিয়ার তুলনায় তাই ই-ভোটিং ব্যবস্থার প্রাথমিক অবস্থা। সে কারণে শুধু ইভিএম বললে তা পুরো ব্যবস্থাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হবে।
তিন. ১৯৬০ সালে পাঞ্চ কার্ড ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ই-ভোটিংয়ের যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম সেখানকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এটি সীমিত পরিসরে প্রথম ব্যবহৃত হয়। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবীতে এখন তিন ধরনের ই-ভোটিং ব্যবস্থা দেখা যায়। পেপার-বেসড ইলেকট্রনিক সিস্টেম, ডিরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ডিআরই ব্যবস্থা এবং পাবলিক নেটওয়ার্ক ডিআরই ব্যবস্থা। পেপার-বেসড ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা এখন পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সময়ের পরিক্রমায় এই ব্যবস্থায় অনেক উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রাথমিকভাবে ব্রাজিল ডিআরই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে ৫০টি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ২০১০ সালের নির্বাচনে ১৩৫ মিলিয়ন ভোটার সরাসরি এই ব্যবস্থায় ভোটদানের সুযোগ পান। ২৪ বছরে ইভিএমে ব্রাজিলের এমন সাফল্য অনেক দেশই অনুসরণ করছে। বাংলাদেশে ইভিএম মূলত ডিরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ডিআরই ব্যবস্থা। ব্রাজিলের ইভিএম যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, আমাদের ইভিএম সেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েই তৈরি। সুতরাং 'ই-ভোটিং হচ্ছে না' 'ইভিএম হচ্ছে'_এমন কথা বলার সুযোগ নেই।
চার. পাবলিক নেটওয়ার্ক ডিআরই ব্যবস্থাও এখন পৃথিবীর খুব কম দেশে আছে। এই ব্যবস্থায় ইন্টারনেটের সুবিধা সংযুক্ত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, এস্তোনিয়া, ব্রিটেন এবং ইউরোপের হাতেগোনা কয়েকটি দেশে এই সুবিধা রয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের ই-ভোটিং ব্যবস্থা অচিন্তনীয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই এই ব্যবস্থায় অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে। হ্যাকাররা নানা ধরনের বিঘ্ন ঘটিয়েছে এই ব্যবস্থায়। আমাদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া যন্ত্রটির ভোটদান পদ্ধতিটি বোধহয় ই-ভোটিং নয়। এটি অমূলক ধারণা। কৌতূহলের বিষয়, পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে ই-ভোটিং ব্যবস্থা চালু আছে তার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া দেশের সংখ্যাই বেশি এবং এসব দেশে এই ব্যবস্থাকে ই-ভোটিং ব্যবস্থাই বলা হয়ে থাকে। সুতরাং আমরা ইভিএম চালু করছি, ই-ভোটিং চালু করছি না_এমন কথা বলা যুক্তিসংগত কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি। তবে জনমনে যাতে কোনো সংশয় তৈরি না হয়, সেজন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত আমরা ইভিএম দিয়ে কী কী সুবিধা দিচ্ছি তা ভোটারদের কাছে পরিষ্কার করা। নির্বাচন কমিশন ই-ভোটিং নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইতিমধ্যে মতবিনিময় করেছে, যা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু আসল কাজটি হলো, যন্ত্রটির ব্যবহারিক সুবিধাদি নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা।
পাঁচ. নানা মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে প্রশংসা করা হচ্ছে। আশার বিষয়, ইতিমধ্যে কমিশন ঘোষণা করেছে, তারা আসন্ন নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সম্পূর্ণ নির্বাচন ই-ভোটিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে চায়। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে যদি ই-ভোটিং সফল হয়, তাহলে সেটি এই ইভিএম যন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং কমিশনের উচিত হবে না এ ব্যাপারে শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যে না থেকে বিষয়টি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এবং আলোচনার টেবিলে ইভিএম বিষয়ে অতি উৎসাহী হয়ে অনেকেই নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সেসব আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি না, নির্বাচন কমিশনকে ভেবে দেখতে হবে। তবে বর্তমানে যে যন্ত্রটি কমিশন ইভিএম হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, তাতে দৃশ্যত কোনো ত্রুটি আছে বলে মনে হয় না। জয়দেবপুর মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দক্ষ দল কাজ করছে এই যন্ত্র তৈরিতে। তাই আমাদের আস্থার জায়গা অনেক মজবুত এই যন্ত্রের ওপর, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির কারণে যদি সেটি নষ্ট করার চেষ্টা হয়, তাতে মূলত কেউই লাভবান হবে না। ক্ষতি হবে সবারই। আমাদের ধারণা, এই আস্থার জায়গাটি শক্তিশালী করার জন্যই নির্বাচন কমিশন ব্যাপারটিকে বর্তমান অবস্থায় ই-ভোটিং না বলে শুধু ইভিএম বলছে। যা মূলত ভালো উদ্দেশ্যে হলেও এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা।
ছয়. ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথম এই ব্যবস্থার প্রচলন করে তার চেয়েও অনেক আধুনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের ই-ভোটিংয়ের যাত্রা শুরু হচ্ছে। সে কারণে আজ থেকে ৫০ বছর আগের স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ইভিএমকে যদি ই-ভোটিং বলা হয়, তাহলে আমাদের ইভিএমকে কেন শুধু ইভিএম বলা হবে? কেন তা ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা নয়?

লেখকবৃন্দ যথাক্রমে : ডিরেক্টর-ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.