দূরের দূরবীনে-অমিত শক্তির বাংলাদেশ ও পরমুখাপেক্ষী রাজনীতি by অজয় দাশগুপ্ত

মাদের দেশটি গরিব বা উন্নয়নশীল বলে একে ছোট বা হেয় মনে করার আদৌ কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। কোনো দেশ বা জাতি ব্যক্তি-মানুষের মতোই তার আচরণ আর রুচির ওপর দাঁড়িয়ে। সেখানেই তার চারিত্র, সেটাই তার ভিত্তি।


আমাদের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের মতো সামরিক রাষ্ট্রের পেট চিড়ে। তখনকার বাস্তবতাও আজকের মতো ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তান ছিল মার্কিন দেশ, চীন আর মধ্যপ্রাচ্যের ঘোর দোস্ত, এতটাই যে একটি পাকিস্তানের অঞ্চল ও সার্বভৌম রক্ষায় সপ্তম নৌবহর প্রেরণেও পিছিয়ে থাকেনি, অন্যটির তপ্ত বুলেট, মেশিনগানের গুলি অকাতরে বাঙালির বক্ষ ভেদ করতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। বাকি যে মধ্যপ্রাচ্য, তারা ঢেলেছিল অর্থ, চাপিয়ে দিয়েছিল লবিং আর পেট্রোডলারের দানবীয় অপশক্তি। তার পরও বাংলাদেশ নিজস্ব সম্মান আর ভালোবাসায় নতুন ফুলের মতো ফুটে উঠেছিল। সুবাস ছড়াতেও দেরি হয়নি। এত শক্তিধর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখেও স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি ছিল সূর্যের মতন দীপ্র ও উজ্জ্বল। তিনি যেখানে যেতেন বা যা বলতেন তা নিয়ে বিরোধিতা থাকলেও দেশ-বিদেশের সরকারপ্রধান, মিডিয়া ও জনগণের চোখে তিনি ছিলেন প্রকৃত হিরো। সত্যি বলতে কী, ম্যান্ডেলা, গান্ধী, কাস্ত্রো বা এ জাতীয় বড় কিছু নেতা ব্যতীত অন্যদের বেলায় এমন জনপ্রিয়তা চোখে পড়ে না।
সে কঠিন সময় পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বস্বীকৃত এক স্বাধীন রাষ্ট্র। সময়ের স্রোতে পরিণত বাংলাদেশের শরীরে যেমন রং, ক্ষত বা অপমানের চিহ্ন আছে, তেমনি আছে উজ্জ্বলতার অনেক অলংকার, অতীতের ভাষা, গণজাগরণ, মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি অর্থনীতি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও উৎপাদনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন, যাঁরা বাংলাদেশের নাম শুনলে আঁতকে ওঠেন, নাক সিটকে সরে যেতে চান, আমি তাঁদের চ্যালেঞ্জ জানাই, বলি_পার্শ্ববর্তী সব দেশ ও সমবাস্তবতার সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। বাংলাদেশ কতটা অগ্রসর, আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ললাটে নোবেল তিলক জোটেনি, হয়তো জুটবেও না কোনো দিন, অন্যদিকে গণতন্ত্রের প্রহরী হয়েই সে অভিধা জুটেছে অং সান সু চির কপালে। তাঁকে শ্রদ্ধা করি, তাঁর জীবনী পাঠে মুগ্ধ হই, একবার অন্তত মিয়ানমার যাওয়ার ইচ্ছায় বুক বাঁধি। কিন্তু এটা তো ঠিক, তাঁর সবল ও প্রবল ব্যক্তিত্বের পরও সামরিক শাসন হটানো সম্ভব হয়নি। বার্মা বা মিয়ানমারের সব গণতান্ত্রিক ইচ্ছাই পদদলিত, এমনকি সে দেশের ধর্মযাজকদের সেফরন রং লাল রঙে রাঙানোর পরও মিয়ানমারের বন্ধ্যত্ব ঘোচেনি। অথচ বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা সামরিক শাসন বা জান্তা হটাতে বিলম্ব হয়নি কোনোকালে, ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় থাকা সামরিক শাসকরা কুলবধূ অথবা রাজনীতিতে নবাগতা রক্তের উত্তরাধিকারের কাছে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সমালোচক বন্ধুদের বলি, ভারতের চোখ ধাঁধানো উন্নতি বা অগ্রগতির গল্প শুনে কাহিল হওয়ার প্রয়োজন নেই। পশ্চিমাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, আমরা খারাপ নেই, আমাদের সংস্কৃতিজীবন ও জীবনবোধ তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আবার কিছু প্রবাসী বন্ধু ও আত্মীয়কে দেখি কথায় কথায় দেশের মুণ্ডুপাত করতে আগ্রহী। জানি না, কোন কারণে তারা এত ক্ষিপ্ত, তবে হিসাব করলে সহজেই বেরিয়ে আসবে প্রত্যেকের ক্ষিপ্ত হওয়ার পেছনে আছে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, কারো চাকরি, কারো বিবাহ, কারো সামাজিকতা, কারো বা দুর্নীতিগত সমস্যা। কারো ছিল সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত হওয়ার মতো অঘটন। কিন্তু এসব তো সব দেশে, সব জাতিতেই সত্য। সর্বত্র তার চিহ্ন আছে, নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ার ধসে গেছে বলে কি মুসলমানরা আমেরিকা ছেড়ে যাঁর যাঁর দেশে ফিরে গেছে? না আমেরিকানরা মুসলমানদের ত্যাজ্য করেছে? সংখ্যাগুরু নামে পরিচিতদের অন্যায় বা জোরজবরদস্তি মেনে না নিয়ে রুখে দাঁড়াতে সচেষ্ট হতে হবে। সরকার কথা না শুনলে বাদ-প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে পারলে রাষ্ট্র শুনবে, রাষ্ট্র না মানলে আন্তর্জাতিক সংস্থা তাকে মানতে বাধ্য করাবে। কিন্তু দেশের টাকা নিয়ে বারাসাত, হাওড়া বা অন্য দেশে বাড়ি তুলে দুই ডিঙিতে পা রাখবেন না; এতে দেশের যেমন ক্ষতি, তেমনি আত্মসম্মানেরও। পৃথিবীতে রিফিউজি বা শরণার্থীদের কেউ ভালোবাসে না, আশ্রয় দিলেও মর্যাদা বা সম্মানের চোখে দেখে না। ফলে আমাদের দায়িত্ব হোক বুঝে নেওয়া, দেশের কল্যাণ ও সম্মানের জন্য যূথবদ্ধ হয়ে থাকা।
ওইটুকু নেই বলেই আজ বহু অগ্রগতির পরও আমরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। এত আশা-ভরসার পর মমতা আমাদের হাত ধুইয়ে দিতে পেরেছেন। কথায় বলে_'বড়'র পিরিতি বালির বাঁধ। বড় প্রতিবেশী ছোট প্রতিবেশী বলে কথা নয়, কথা আত্মমর্যাদা আর সম্মানবোধের। কার্ল মার্কস জীবনেও ভারতে আসেননি। তাঁর দূরদৃষ্টি ও অবলোকন ছিল বিদ্যুতের মতো। তাঁর বন্ধু অ্যাঙ্গেলসকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ভারতবর্ষের জীবন মৎস্যকুলের মতো, এক পুকুরে থাকলেও খিদে পেলে বা প্রয়োজনে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে এবং খেয়ে ফেলবে_ভারতের বর্তমান ভূমিকায় সেটাই স্পষ্ট। দুর্ভাগ্য আমাদের, রাজনীতি-রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাধররা মাৎস্যন্যায় বোঝেন না। 'বড়'র ছলনে ভুলি! আশার মরীচিকার পেছনে দৌড়ানোর দিন শেষ জেনেও আমরা তাই করে চলেছি। আরো একটা সমস্যা দেখুন, সাড়া জাগানো উইকিলিকসের কল্যাণে আমাদের দেশের যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তার উৎস একটি মাত্র দেশ_সব কিছু তবে আমেরিকার নখদর্পণে! পৃথিবীতে কি আর কোনো দেশ, শক্তি বা পরাশক্তি নেই? একদা স্নায়ুযুদ্ধের কালে পৃথিবীতে ভারসাম্য ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া ও তার বলয়ের চাপে দিশাহারা আমেরিকা ঘর সামাল দিতেই ছিল ব্যস্ত। সে শক্তি আজ পরাজিত। ছলে-বলে-ষড়যন্ত্রে রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বারোটা বাজিয়ে আমেরিকাই এখন একচ্ছত্র অধিপতি। কী কাণ্ড! ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাংলাদেশ নিয়েও তার মাথাব্যথা_কী ঘটছে, কী হচ্ছে! ফেয়ার ফেয়ার বলে গলায় ফেনা তোলা পশ্চিমারা কী বলবেন, এ জাতীয় তথ্য ফাঁস করা কতটা ফেয়ার? শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, নীতিমালা, সঙ্গী নির্বাচন, দেশ ও দল চালানোর ভিন্ন কৌশল থাকবে_এটাই স্বাভাবিক। সেগুলো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারও দেশবাসীর। ওইসব পরামর্শক কিংবা পর্যবেক্ষক নিজেদের দোষত্রুটির দিকে তাকান না, কিন্তু অন্যেরটার খোঁজ রাখেন। এর ভেতরও আছে পজিটিভ ও নেগেটিভ দুই ধরনের আউটলুক। পজিটিভ এই, আজ বাংলাদেশ স্থানিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বেগবান এবং আগুয়ান বলেই তাকে ঘিরে এত মাতম। তার খবর ফাঁস-বেফাঁস করা নিয়ে আগ্রহ। নেগেটিভ এই, আত্মমর্যাদাহীন, পরাশক্তির লেজুড় ও ক্ষমতার জন্য আমেরিকার পোঁ-ধরা রাজনীতিই এর উৎস মূল। অন্যথায় আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা নাক গলাতেও সাহস পেত না।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.