চারদিক-এসো, মিলি প্রাণের উচ্ছ্বাসে
কাফরুলের মরহুম মকবুল আহমেদের মেজ মেয়ে কামরুন নাহার ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে পড়তেন। তখন তাঁকে নৌকায় করে দূরে এক স্কুলে যেতে হতো। একদিন বাবাকে বললেন, ‘বাবা, আমি তো সাঁতার জানি না, নৌকায় যেতে গিয়ে যদি পানিতে পড়ে যাই, তাহলে কী হবে?’
সেদিন ছোট্ট মেয়েটির ওই কথা বাবা মকবুল আহমেদকে একটি স্কুলের গোড়াপত্তন করতে উজ্জীবিত করেছিল। সে রকমটাই শোনা গেল মকবুল আহমেদের মেজ ছেলে মিন্টুর কাছ থেকে। হাবিবুর রহমানসহ এলাকার কিছু মুরব্বির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মরহুম আজিজুল হক, মরহুম মকবুল আহমেদ, মরহুম সালাম, মরহুম চান মিয়া প্রমুখের স্বক্রিয় উদ্যোগ ও সহযোগিতায় নৈশ বিদ্যালয়টি ১৯৬৯ সালে একটি দিবা বিদ্যালয়ে রূপ নেয় এবং তার পর থেকে উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ পথচলা। ১৯৭৫ সালে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো চারজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় বিদ্যালয়টি।
ভোরের শিশিরবিন্দু বিছিয়ে আছে ঘাসের ওপর, কুয়াশার চাদর খানিকটা বাধা দিচ্ছে শীতের সকালের মিষ্টি রোদকে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার, বোধ করি এমনই এক শিশিরসিক্ত সকালে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের পদচারণে মুখরিত হতে শুরু করবে রাজধানীর কাফরুল থানাধীন উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। সেদিন বিগত ৩৬ বছরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ পরিণত হবে এক মিলনমেলায়। এই মিলনমেলা হবে মনের টানে, প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
বিদ্যালয়টির প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তারও আগে ছোট পরিসরে ১৯৬৮ সালে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। সে সময় এলাকার কিছু তরুণ দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার প্রতিযোগিতায় একটি শিল্ড ও কাপ জেতে। আর এই জয়ের পুরস্কার দেখাতে এলাকার ঘরে ঘরে গেলে লোকজন তাদের কিছু টাকা দেয়। ঠিক হলো খেলার টাকা ব্যয় হবে একটি নৈশ বিদ্যালয় করার পেছনে। ব্যস, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল নিয়ে বর্তমানে যেখানে ‘উত্তর কাফরুল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা’ অবস্থিত, সেখানে ত ৎ কালীন মক্তব্যের পাশে একটি ছোট টিনের ঘরে ছেলেরা শুরু করে এক নৈশ বিদ্যালয়, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মরহুম আজিজুল হক। এমনটাই বর্ণনা করছিলেন মোহাম্মদ মনসুর আলী (যিনি ওই খেলার একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন), আবদুল হামিদ খান ও আলহাজ মো. আজহারুল হক ফেরদৌস। এলাকায় তখন কোনো বিদ্যালয় ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের যেতে হতো অনেক দূরে হেঁটে কিংবা নৌকায়।
কথা হলো বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলীর সঙ্গে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, বিদ্যালয়ে তাঁর যোগ দেওয়ার আগে প্রথম ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাসের কথা। সেই ক্লাসে একজন ছাত্রী ওদের শ্রেণীর সবচেয়ে কঠিন একটা অঙ্ক দিয়েছিল করে দেওয়ার জন্য। ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাসের সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন সহকারী শিক্ষক পদে। তিনি আরও বললেন কয়েকজন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কথা, যাদের এখনো খুব মনে পড়ে।
বিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এসএসসির ফলাফল জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বললেন, এসএসসিতে ২০১১ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০৭ জন, পাসের হার ৯৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১৯ জন; ২০১০ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১১৯ জন, পাসের হার ৯৬ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১৩ জন; ২০০৯ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩২ জন, পাসের হার ৮৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ২২ জন।
সৌভাগ্যবশত কথা হলো বিদ্যালয় সরকারীকরণের আগের একজন শিক্ষক খন্দকার আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বয়স এখন আনুমানিক ৭৫। আমজাদ হোসেন বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মরহুম উদ্যোক্তাদের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৬৯ সালে ১০০ টাকা বেতনে তিনি শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ওই বছরই প্রথমবারের মতো বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তি পায়।
প্রাণের বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীর কথা শুনে নিবন্ধন করতে আসা ১৯৮৯ ব্যাচের দোলনের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কতটা উচ্ছ্বসিত তিনি। মিলনমেলা যেন এখনই শুরু হয়ে গেছে। একই রকম দেখা গেল ওই ব্যাচের সালাহউদ্দীন, মোরশেদা রুমি, শরীফ, মিজান; ১৯৯৯ ব্যাচের নোমান, ২০০১ ব্যাচের সাজু, ২০০৪ ব্যাচের কানিজ ফাতেমা, ১৯৯৬ ব্যাচের ইসলাম ও ১৯৮৩ ব্যাচের কামরুজ্জামান আবুলের চোখমুখেও। যেন দীর্ঘদিন গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের অল্প পানিতে কোনো রকম বেঁচে থাকা কিছু মাছ হঠা ৎ বর্ষার থইথই পানি পেয়ে মহা উচ্ছ্বসিত। হ্যাঁ, সত্যিই তো, এ যে মনের ভেতরের টান। এই টান বিদ্যালয় ছাড়া শিক্ষাজীবনের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে পুনর্মিলনীর কথা ভাবছিলেন। কখনো কেউ ভেবেছেন শুধু নিজেদের ব্যাচ নিয়ে আবার কখনো কেউ ভেবেছেন সব ব্যাচ নিয়ে। সাহসটা হয়ে উঠেনি কারও। ৩৬ বছর পর এবার সবার ভাবনাকে পূর্ণতা দিল সম্প্রতি গঠিত বিদ্যালয়টির এক্স স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। আয়োজন করল পুনর্মিলনীর—‘এসো মিলি মনের টানে, প্রাণের উচ্ছ্বাসে’ এই আহ্বানে।
দিনব্যাপী এই মিলনমেলায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন চলছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, করা যাবে ৭ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত যেকোনো দিন যেকোনো সময়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা যাবে: ০১৭১৬০২৮২০২ ও ০১৮১৯০৩০৯৯২ নম্বরে।
জায়েদ জুলফিকার
ভোরের শিশিরবিন্দু বিছিয়ে আছে ঘাসের ওপর, কুয়াশার চাদর খানিকটা বাধা দিচ্ছে শীতের সকালের মিষ্টি রোদকে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার, বোধ করি এমনই এক শিশিরসিক্ত সকালে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের পদচারণে মুখরিত হতে শুরু করবে রাজধানীর কাফরুল থানাধীন উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। সেদিন বিগত ৩৬ বছরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ পরিণত হবে এক মিলনমেলায়। এই মিলনমেলা হবে মনের টানে, প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
বিদ্যালয়টির প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তারও আগে ছোট পরিসরে ১৯৬৮ সালে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। সে সময় এলাকার কিছু তরুণ দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার প্রতিযোগিতায় একটি শিল্ড ও কাপ জেতে। আর এই জয়ের পুরস্কার দেখাতে এলাকার ঘরে ঘরে গেলে লোকজন তাদের কিছু টাকা দেয়। ঠিক হলো খেলার টাকা ব্যয় হবে একটি নৈশ বিদ্যালয় করার পেছনে। ব্যস, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল নিয়ে বর্তমানে যেখানে ‘উত্তর কাফরুল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা’ অবস্থিত, সেখানে ত ৎ কালীন মক্তব্যের পাশে একটি ছোট টিনের ঘরে ছেলেরা শুরু করে এক নৈশ বিদ্যালয়, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মরহুম আজিজুল হক। এমনটাই বর্ণনা করছিলেন মোহাম্মদ মনসুর আলী (যিনি ওই খেলার একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন), আবদুল হামিদ খান ও আলহাজ মো. আজহারুল হক ফেরদৌস। এলাকায় তখন কোনো বিদ্যালয় ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের যেতে হতো অনেক দূরে হেঁটে কিংবা নৌকায়।
কথা হলো বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলীর সঙ্গে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, বিদ্যালয়ে তাঁর যোগ দেওয়ার আগে প্রথম ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাসের কথা। সেই ক্লাসে একজন ছাত্রী ওদের শ্রেণীর সবচেয়ে কঠিন একটা অঙ্ক দিয়েছিল করে দেওয়ার জন্য। ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাসের সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন সহকারী শিক্ষক পদে। তিনি আরও বললেন কয়েকজন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কথা, যাদের এখনো খুব মনে পড়ে।
বিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এসএসসির ফলাফল জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বললেন, এসএসসিতে ২০১১ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০৭ জন, পাসের হার ৯৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১৯ জন; ২০১০ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১১৯ জন, পাসের হার ৯৬ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১৩ জন; ২০০৯ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩২ জন, পাসের হার ৮৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ২২ জন।
সৌভাগ্যবশত কথা হলো বিদ্যালয় সরকারীকরণের আগের একজন শিক্ষক খন্দকার আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বয়স এখন আনুমানিক ৭৫। আমজাদ হোসেন বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মরহুম উদ্যোক্তাদের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৬৯ সালে ১০০ টাকা বেতনে তিনি শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ওই বছরই প্রথমবারের মতো বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তি পায়।
প্রাণের বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীর কথা শুনে নিবন্ধন করতে আসা ১৯৮৯ ব্যাচের দোলনের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কতটা উচ্ছ্বসিত তিনি। মিলনমেলা যেন এখনই শুরু হয়ে গেছে। একই রকম দেখা গেল ওই ব্যাচের সালাহউদ্দীন, মোরশেদা রুমি, শরীফ, মিজান; ১৯৯৯ ব্যাচের নোমান, ২০০১ ব্যাচের সাজু, ২০০৪ ব্যাচের কানিজ ফাতেমা, ১৯৯৬ ব্যাচের ইসলাম ও ১৯৮৩ ব্যাচের কামরুজ্জামান আবুলের চোখমুখেও। যেন দীর্ঘদিন গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের অল্প পানিতে কোনো রকম বেঁচে থাকা কিছু মাছ হঠা ৎ বর্ষার থইথই পানি পেয়ে মহা উচ্ছ্বসিত। হ্যাঁ, সত্যিই তো, এ যে মনের ভেতরের টান। এই টান বিদ্যালয় ছাড়া শিক্ষাজীবনের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে পুনর্মিলনীর কথা ভাবছিলেন। কখনো কেউ ভেবেছেন শুধু নিজেদের ব্যাচ নিয়ে আবার কখনো কেউ ভেবেছেন সব ব্যাচ নিয়ে। সাহসটা হয়ে উঠেনি কারও। ৩৬ বছর পর এবার সবার ভাবনাকে পূর্ণতা দিল সম্প্রতি গঠিত বিদ্যালয়টির এক্স স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। আয়োজন করল পুনর্মিলনীর—‘এসো মিলি মনের টানে, প্রাণের উচ্ছ্বাসে’ এই আহ্বানে।
দিনব্যাপী এই মিলনমেলায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন চলছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, করা যাবে ৭ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত যেকোনো দিন যেকোনো সময়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা যাবে: ০১৭১৬০২৮২০২ ও ০১৮১৯০৩০৯৯২ নম্বরে।
জায়েদ জুলফিকার
No comments