জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-বিবর্ণ চিত্রের দায় কার?

নিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সেশন জটসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক চিত্র এতটাই বিবর্ণ হয়ে পড়েছে যে এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁদের নিয়োগ নিয়ে নানা মহল থেকে তখনই বিস্তর প্রশ্ন উঠেছিল, সেই তালিকা থেকে ৮২১ জন চাকরি হারিয়েছেন।


গত ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষ জরুরি সভা ডেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আদালতের রায় অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। ২০০৩ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারালেন। তবে আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকায় বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ওই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ২৩০ জন আপাতত চাকরি হারাচ্ছেন না। চাকরিচ্যুতরা চাকরি ফেরত পাওয়ার দাবিতে ইতিমধ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ইতিহাসের পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু সংগত কারণ ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উপযুক্ত করে উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত ও মসৃণ করার লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কার্যত সুফল আশানুরূপ মেলেনি। দলীয়করণ, মহল বিশেষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ড জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিমধ্যে বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয়করণের উৎকট রূপ ফুটে উঠতে যখন থেকে শুরু করেছিল তখন থেকেই এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব সমাজে পড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে নিয়োগসহ অন্যান্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ থেকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা গেছে_এমন খবরও মিডিয়ায় এসেছে। সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি ঘটেছে উপাচার্য ড. আফতাব আহমাদের সময়ে। বহুমুখী সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেশন জটের মতো ভয়াবহ অভিশাপ অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবনে কালো ছায়া ফেলেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের একটি বড় অংশের উচ্চ শিক্ষার্থী এবং এক শর বেশি সরকারি-বেসরকারি কলেজ সম্মান ও মাস্টার্স পর্যায়ে এবং স্নাতক (পাস) পর্যায়ে প্রায় দেড় হাজার কলেজ যুক্ত থাকায় ধরেই নেওয়া যায়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, এর বৃহৎ দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানে ধস নামার মূল কারণই হলো, এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। দলীয়করণের ভূত যখন মাথায় চাপে তখন অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। আজ যাঁরা উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি হারালেন তাঁরা তাঁদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেননি। কাজেই এ নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠানের ওপর দেশের উচ্চশিক্ষার পথ মসৃণ করার বিষয়টি নির্ভর করছে, তা কণ্টকাকীর্ণ করার অর্থ দেশ-জাতির সর্বনাশই ডেকে আনা। অতএব, আমরা আশা করব, তাঁদের বোধোদয় ঘটবে এবং অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করার হীনচেষ্টা থেকে বিরত থাকবেন। কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্ণ চিত্র মুছে ফেলে এর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল করতে হলে প্রতিষ্ঠানটির দিকে খুব দ্রুত গভীর আলোকপাত করতে হবে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে।

No comments

Powered by Blogger.