মনের কোণে হীরে-মুক্তো-রকমারি স্বাদের মনকাড়া আমন্ত্রণে প্রলম্বিত মধুমাস by ড. সা'দত হুসাইন

এখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। ১৪১৯ সালের জ্যৈষ্ঠ মাস। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, সফেদা, জামরুল, আনারসের ম-ম গন্ধে ভরা হাটবাজার। এমনকি পাড়া-মহল্লাও। ফল-ফলাদির এই সমারোহের কারণে এ সময়টাকে বলা হয়ে থাকে বাংলার মধুমাস। গতানুগতিক অর্থে মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠ মাসকে বোঝানো হয়।


আর এই মধুর আনন্দটি ফলের রস থেকে আসে- এমনটি ধরা হয়। কথাটি সাধারণভাবে সত্য। তবে সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে মধুমাসের মেয়াদ এবং মাত্রা কত বিরাটভাবে বদলিয়েছে, তা তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
ফলফলাদির প্রাচুর্য থাকলেও স্বাধীনতার আগে জ্যৈষ্ঠ মাসে মাছ এবং তরিতরকারির বাজারে বড় রকমের আক্রা দেখা যেত। স্কুলজীবন অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে আমাদের নোয়াখালীর বাসার বাজার-সওদা করার দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। কাঁচাবাজার আমাদের বাসার কাছে থাকায় সকালে স্কুলে যাওয়ার আগেই এ কাজটা আমি শেষ করে ফেলতে পারতাম। নিয়মিত বাজার করার কারণে বাজারে মাছ এবং তরিতরকারির আমদানি সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। মে-জুন মাসে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে তরকারির সরবরাহ তেমন একটা ছিল না। আলু, কপি, শিম, লাউ, টমেটো, পালং শাক, গাজর, বাঁধাকপি ইত্যাদির সরবরাহ মার্চ-এপ্রিলেই শেষ হয়ে যেত। মিষ্টি কুমড়া, ডাঁটা শাক, পেঁপে- এ কয়টি তরকারি বাজারে দেখা যেত। সীমিত পরিমাণে বরবটি, জালি কুমড়া কোনো কোনো বাজারে পাওয়া যেত। খাল, বিল, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাছের সরবরাহ কমে যেত। গরুর মাংস (সের বা কেজি ১.২৫ টাকা), খাসির মাংস (কেজি ১.৫০ টাকা) এবং মুরগি (প্রতি পিস ৩-৪ টাকা) এ সময় বেশি পরিমাণে কেনাবেচা হতো। জুলাই মাসে (আষাঢ়-শ্রাবণ) পানি বাড়ার পর পানি-তরকারি যেমন- লতি, পানি-কচু, কলমিশাক, কচুর ছড়া বাজারে আসত। ছোট মাছের সরবরাহ এ সময় বাড়তে থাকত। ইলিশ মাছও অল্পবিস্তর পাওয়া যেত।
স্বাধীনতার পর অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দেশে বহুসংখ্যক হিমাগার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আলু সংরক্ষণব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখন বাজারে সারা বছর আলু পাওয়া যায়। আলু যে তরকারির শীর্ষে- এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজকাল হিমাগারে বাঁধাকপি, টমেটো, মটরশুঁটি, গাজর ইত্যাদি তরকারিও সংরক্ষণ করা হয়। কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন বা প্রভূত উন্নতির ফলে লাউ, বরবটি, শসা, স্থলকলমি (ক্যাংকুন) সারা বছর পাওয়া যায়।
এককথায়, এখন জ্যৈষ্ঠ মাসে বাজারে তরিতরকারির আকাল পরিলক্ষিত হয় না। শীতকালের তুলনায় তরকারির সরবরাহ অবশ্য কম। তবে রান্না চড়ানোর মতো যথেষ্ট তরকারি বাজারে পাওয়া যায়। হাইব্রিড জাতের প্রচলনের ফলে কয়েকটি ফসলের উৎপাদন আশাতীতভাবে বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে কুমড়া, শসা, পেঁপে, ঢেঁড়স ইত্যাদি। জ্যৈষ্ঠ মাসে এসব ফসলের সরবরাহ চোখে পড়ার মতো। ভোক্তা এবং কৃষক উভয়ই এর ফলে লাভবান হচ্ছে।
মাছের বাজারেও দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। পুকুরে উৎপাদিত পাঙ্গাশ জ্যৈষ্ঠের বাজারকে ভরিয়ে রেখেছে। গত ১০ বছরে এ পাঙ্গাশের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। সরবরাহ বাড়ায় এ মাছের দাম কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এমন হয়েছে যে দাম কমার কারণে আজকাল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের অনেকে পাঙ্গাশ মাছ খেতে চায় না। এ মাছকেও সামাজিক মর্যাদার প্রতীকের অংশ করে ফেলা হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথি থাকলে খাওয়ার টেবিলে পাঙ্গাশ মাছ রাখা হয় না। ময়মনসিংহের ফিশারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে পাঙ্গাশের এই জাত প্রচলনে বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে। গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রচেষ্টায় আরো যেসব মাছের উৎপাদন বেড়েছে এবং জ্যৈষ্ঠের বাজারে মাছের সরবরাহ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা সম্ভব রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- সরপুঁটি, গুলশা, শিং মাছ, কৈ মাছ এবং মাগুর মাছ। বাজারে এগুলো 'চাষের মাছ' হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেলাপিয়া বা নাইলোটিকা মাছের সরবরাহ। সব মিলে জ্যৈষ্ঠের বাজারে এখন আর মাছের আক্রা নেই। বাজারে গিয়ে খালি থলে নিয়ে ফিরে আসার আশঙ্কা নেই।
মধুমাসের অনুকূলে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ধান-চালের উৎপাদনে। স্বাধীনতার আগে খাদ্যশস্য হিসেবে বাংলার সবচেয়ে বড় ফসল ছিল আমন ধান, যা শীতকালে উৎপাদিত হয়। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে এ ফসল কাটা হলে বাংলার ঘরে ঘরে, পাড়ায়-মহল্লায়, গঞ্জে-গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। 'নবান্ন' উৎসব এ সময়ে আয়োজন করা হতো। আজও বাংলাদেশে সে রীতি চালু রয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব হয়। আবহাওয়া অনুকূল অর্থাৎ ঠাণ্ডা থাকায় নবান্নের পর পরই শুরু হয়ে যায় পিঠা-পার্বণের উৎসব। শীতকালজুড়ে এ উৎসব চলতে থাকে। এর সঙ্গে জারি, সারি, যাত্রা, কবিগান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি রাতভর ওয়াজ মাহফিল এবং দিনে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে সমানতালে। আমন ফসল ওঠার পর কয়েক মাস আর কোনো বড় ধরনের নতুন ফসল উঠবে না- এটাই ছিল বাংলার জনগণের স্বাভাবিক বিশ্বাস।
কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক, কৃষি গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী, নীতিনির্ধারক, ঋণদাতা এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় বোরো ধান উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এফআইএস (ফার্টিলাইজার, ইরিগেশন, সিড) টেকনোলজি ব্যবহার করে ধুধু মাঠকে শস্যশ্যামল মাঠে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সে মাঠ থেকে সোনার ফসল তোলা হচ্ছে। যতই বছর গড়িয়েছে, বোরোর উৎপাদন ততই বেড়েছে। এখন বছরে প্রায় দুই কোটি টন বোরো উৎপন্ন হয়। আমনের উৎপাদন ১.৩ কোটি টন, বোরো যে বাংলাদেশের কৃষকের সবচেয়ে বড় ফসল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জ্যৈষ্ঠ মাসে এ ফসল কৃষক ঘরে তোলে। বোরো হচ্ছে কৃষকের জন্য অর্থকরী ফসল, তারা এ ফসল বিক্রি করে নগদ টাকা রোজগার করে। বলা যায়, বোরো ধান কৃষকের জীবনে সচ্ছলতা আনে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। অঘোষিত নবান্নের উৎসব চলে বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামে। ফলের রসে, ঝোলেভাতে জ্যৈষ্ঠ প্রকৃতই মধুমাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
খাওয়া-পরার আনন্দের সঙ্গে যোগ হয় বাংলার দুই মহাকবির জন্মজয়ন্তী। ক্যালেন্ডারের হিসাবে জ্যৈষ্ঠ মাস শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে শুরু হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী, চলে জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে। নজরুলজয়ন্তী তো ১১ জ্যৈষ্ঠ। ভর মধুমাসে পুরো সময়টা থাকে জন্মজয়ন্তীতে মুখরিত। উপজেলা পর্যন্ত জন্মজয়ন্তীর উৎসবের আয়োজন করা হয়। গ্রামে অবশ্য সেভাবে জন্মজয়ন্তী উৎসব করা হয় না। আজকাল টেলিভিশনের বদৌলতে গ্রামের লোকও জয়ন্তী উপভোগ করে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা গ্রামাঞ্চলেও মধুমাসে এ উৎসবের আয়োজন করা হবে।
মধুমাসের মেয়াদ বোধ হয় বর্ষপঞ্জির তারিখ মিলিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু ফল এবং কৃষিজাত পণ্য আগের তুলনায় অনেক আগে বাজারে আসতে শুরু করে। আবার তাদের স্থায়িত্বের মেয়াদও দীর্ঘতর হয়ে থাকে। তরমুজ আগে এপ্রিলে বাজারে দেখা যেত, এখন মার্চ থেকেই বাজারে আসতে শুরু করে। সফেদাও মার্চ থেকেই বাজারে আসতে শুরু করে। আম এখন সেপ্টেম্বরেও পাওয়া যায়, যদিও এগুলোর অধিকাংশ সীমান্তের ওপার থেকে আসা। তরকারির ক্ষেত্রে এ সত্য আরো বেশি প্রযোজ্য। বোরো ধানের আগমনী সময় মোটামুটি দুই মাসের সামান্য বেশি, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত। মে মাসের প্রথম থেকেই নানারূপ ফলের সমাহারে বাজার ভরে ওঠে এবং কমপক্ষে জুনের শেষ পর্যন্ত এ প্রাচুর্য অব্যাহত থাকে। মধুমাসের ব্যবহারিক মেয়াদকালকে তাই দুই মাস বা এক ঋতুর সমান প্রলম্বিত করা যেতে পারে। এটি হতে পারে মধ্যবৈশাখ থেকে মধ্য আষাঢ় পর্যন্ত। এই প্রলম্বিত মধুমাস হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফসল।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.