মিডিয়া ভাবনা-চাই শিক্ষা টিভি চ্যানেল by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছি, জুলাই মাসেই ‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ চালু হবে। জুলাই মাসের অর্ধেক পার হয়ে গেছে, এখনো এই টিভি চ্যানেলের আর কোনো খবর দেখিনি। অনুমান করছি, হয়তো কোনো কারিগরি কারণে টিভি চ্যানেলটি চালু হতে বিলম্ব হচ্ছে।
সংবাদপত্রেই পড়েছিলাম, ‘সংসদ টিভি চ্যানেলটি’ সংসদ অধিবেশন লাইভ প্রচার করবে। এ ছাড়া আর কী কী অনুষ্ঠান হবে, তার বিস্তারিত জানা যায়নি। সংসদ অধিবেশন যখন চলবে না, তখন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করবে। মোটামুটি এ রকমই পরিকল্পনা বলে শুনেছি। এই টিভি চ্যানেল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু সংসদ সচিবালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় এখনো জানায়নি। কাজেই আমার হাতে তথ্য খুব কম। এটুকু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।
আমি মনে করি, ‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য কোনো প্রয়োজনীয় টিভি চ্যানেল হতে পারে না। জাতীয় সংসদের অধিবেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যের খাতিরে আমাকে বলতেই হবে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যত বক্তৃতা বা বিতর্ক হয়, তার খুব কম অংশই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সম্পূর্ণ অধিবেশন লাইভ টিভিতে প্রচার করা মোটেও অর্থপূর্ণ কাজ হবে না। তা ছাড়া টিভি একটি দৃশ্যপ্রধান মাধ্যম। যেখানে ‘শোনা’ ও ‘দেখা’ একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়, সেখানে টিভি মাধ্যম বেশি উপযোগী। সংসদ অধিবেশন নিতান্তই শোনার ব্যাপার, দেখার কিছু নেই। ঘুরেফিরে একই মুখ, একই দৃশ্য। বৈচিত্র্যও নেই। শোনার জন্য রেডিও তো রয়েছেই। আগ্রহী শ্রোতা বা রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা রেডিও শুনে তাঁদের চাহিদা মেটাতে পারছেন। সংসদ অধিবেশন টিভিতে লাইভ সম্প্র্রচারের জন্য কোনো দাবি উঠেছিল বা কেউ মানববন্ধন বা অনশন করেছে—এমনটা শুনিনি। আমার মনে হয়, সরকার বা সংসদ সচিবালয় একটা অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে যাচ্ছে। এখনো যদি সময় থাকে, এই উদ্যোগ বন্ধ করা উচিত।
আমি সংসদ অধিবেশন, সংসদীয় কমিটির সভা ও সংসদের অন্যান্য কার্যাবলিকে ছোট করে দেখছি না। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে সংসদই তো প্রাণ। আমাদের দেশে নানা কারণে সংসদ কার্যকর হয়নি বা বিরোধী দল সংসদকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে—এগুলো ভিন্ন প্রসঙ্গ। এসব বিষয় নিয়ে বহু কথা হয়েছে। সামনে আরও হবে। তবে ফল কী হবে, তা বলা মুশকিল। যেমন, অনেক বছর যাবৎ সমালোচনা সত্ত্বেও তুচ্ছ অজুহাতে প্রধান বিরোধী দল সংসদ অধিবেশন বর্জন করেই চলেছে। শত সমালোচনাও কি বিরোধী দলকে ফেরাতে পেরেছে সংসদে? এগুলো আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। এসব থেকে আমরা কবে নিষ্কৃতি পাব, তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ নিয়ে আমার আপত্তি থাকলেও সংসদ অধিবেশনকে মিডিয়ায় ভালো করে কভারেজ দিতে আমার আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে রকম কভারেজ হচ্ছে না। সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভির ‘খবরে’ সংসদ অধিবেশনের শুধু মূল কথাগুলো স্থান পায়। কারণ, গণমাধ্যমের চালকেরা জানেন, এর বেশি বিবরণ পড়তে বা শুনতে পাঠক-দর্শকেরা আগ্রহী নয়। পাঠক-দর্শক আগ্রহী হলে গণমাধ্যমে বেশি সময় বা জায়গা দেওয়া হবে না—এমন বোকা সাংবাদিকেরা নন। একাত্তরের আগে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের বিবরণ সংবাদপত্রের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হতে দেখেছি বক্তাদের স্ট্যাম্প সাইজ ছবিসহ। কৈশোরের সেই স্মৃতি এখনো মনে ভাসে। এখন সেই দিন আর নেই। যতই সংসদ টিভি চ্যানেল চালু করুক না কেন, সংসদ অধিবেশনের সেই আকর্ষণ আর নেই। এখনকার সংসদে বিরোধী দলের সেই এজেন্ডাও আর নেই। এখন কে কাকে চোর বলছে, দর্শক তা জানে। এখন দেশজুড়ে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের’ রাজনীতি। কে কার সমালোচনা করবে!
সরকার-নিয়ন্ত্রিত ‘বিটিভি’ ও ‘বেতারে’ সংসদ অধিবেশন নিয়ে একটি সাপ্তাহিক বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করার সুযোগ আছে। যদি করতে জানে। যদি প্রযোজকের কিছুটা স্বাধীনতা থাকে। প্রযোজকের স্বাধীনতা ও দক্ষতার অভাব ঘটলে সেই অনুষ্ঠানও হবে বিরক্তিকর। দর্শকেরা তখন ভাববে, ‘এর চেয়ে ছায়াছবির গান শোনালেই ভালো হতো।’
সরকারের মধ্যে কে বা কারা কী চিন্তা থেকে সংসদ টিভি চ্যানেলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি জানি না। সংসদ ও টিভি মাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণায় দুর্বলতা রয়েছে বলে আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু ‘সরকার’ খুব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তারা যা খুশি তা করতে পারে। আমার এই সামান্য নিবন্ধ তাদের থামাতে পারবে না।
সরকারের কাছে যদি সুযোগ থাকে (বিটিভির দ্বিতীয় চ্যানেল) তাহলে একটি ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ করার জন্য আমি প্রস্তাব দেব। আগেও লিখেছি। আরও অনেকে লিখেছেন বা বলেছেন। দেশে সুশিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা, সৃজনশীল প্রশ্ন, ভাষা শিক্ষা, সাক্ষরতা ইত্যাদির প্রসারে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি যোগ্য লোকের হাতে এর দায়িত্ব পড়ে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এর অনুষ্ঠানসূচি পরিকল্পিত হয়। আমলা বা দলীয় ক্যাডারদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা কার্যকর কোনো ‘শিক্ষা চ্যানেল’ হবে কি না সন্দেহ। শিক্ষাঙ্গনের দলীয় ক্যাডারদের আয়-রোজগারের আরেকটা পথ হতে পারে।
‘শিক্ষা চ্যানেলে’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা কর্মসূচি ও নীতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রসার ও সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে বর্তমানে যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা চ্যানেলের মাধ্যমে তাও দূর করা যায়। প্রি-স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা, শিক্ষার এমন কোনো স্তর নেই, টিভির মাধ্যমে যা নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের গাইড করা যায় না।
দেশব্যাপী আজকাল ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের খুব অভাব, বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে। ছুটির দিনে টিভির মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষকদের দিয়ে নানা বিষয়ে ক্লাস পরিচালনা করা যায়; সারা দেশে টিভির সামনে বসে ছাত্রছাত্রীরা তা দেখবে ও শিখবে। ‘শিক্ষা টিভি’ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে এক জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে, যদি সঠিক পরিকল্পনায় একে গড়ে তোলা যায়।
আমি শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নই। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা দিতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু বুঝতে পারি, আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ শিক্ষা বিস্তারে একটা বড় হাতিয়ার হতে পারে। আমাদের সেই হাতিয়ার আছে। আমরা তা ব্যবহার করছি না শুধু সিদ্ধান্তের অভাবে।
পাঠক, এবার আপনিই বলুন কোন টিভি চ্যানেল আমাদের বেশি দরকার? সংসদ অধিবেশনের বক্তৃতা? নাকি টিভির মাধ্যমে নানা বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের ক্লাস, শিক্ষক প্রশিক্ষণ? কোনটা বেশি জরুরি?
‘সংসদ টিভি চ্যানেলের’ পরিবর্তে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ চালু করার জন্য সরকারপ্রধানের কাছে আমি বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। সরকারের কাছে যদি পর্যাপ্ত টাকা ও কারিগরি সুবিধা থাকে তাহলে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেলের’ পাশাপাশি ‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ও হতে পারে। কিন্তু অগ্রাধিকার কোনটা, সেটা ঠিক করতে হবে।
সংবাদপত্র ও বাংলা ভাষা
আমাদের সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়ার কোনো পর্যালোচনা সচরাচর হয় না। ফলে সাংবাদিক ও প্রযোজকেরা তাঁদের ভুল বা দুর্বলতা বুঝতে পারেন না। কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়মিত এই পর্যালোচনা করলে খুব ভালো কাজ হতো। তবে যাঁরা করবেন, তাঁদের দক্ষতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে কাজটা অর্থবহ হবে না।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার (চৈত্র ১৪১৬ সংখ্যা) পত্রিকায় বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ সংবাদপত্রের বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটি চিন্তা-উদ্দীপক প্রবন্ধ (বাংলা ভাষা কোন পথে) লিখেছেন। তিনি ঢাকা ও কলকাতার কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্রের খবর ও শিরোনাম উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন বাংলা ভাষা ব্যবহারে কত ভুল শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। বিশেষ করে কলকাতার প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় যেভাবে ইংরেজি অনুকরণে বাংলা লেখা হয়, যা ঠিক নয়, তা তিনি দৃষ্টান্তসহ দেখিয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রভাবে আবার এসব ভুল বাংলাদেশের সংবাদপত্রেও প্রশ্রয় পেয়েছে।
গোলাম মুরশিদ একজন গবেষক ও সচেতন লেখক বলে তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেই হয়। তা ছাড়া, তিনি যুক্তি সহকারে ভুলগুলো চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বক্তব্যই শতভাগ ঠিক, সেই রায় দেওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি আলোচ্য প্রবন্ধ ও সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার ভুল প্রয়োগ সম্পর্কে বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সংবাদপত্রের পাতায় তাঁরা এই আলোচনার অবতারণা করতে পারেন। প্রবন্ধটি বিভিন্ন সংবাদপত্রে পুনর্মুদ্রণ করলে অনেক সাংবাদিক ও সাধারণ পাঠক এই বিষয়ে আগ্রহী হবেন বলে আশা করা যায়।
আমাদের সংবাদপত্রে মাসে অন্তত একবার নিজস্ব লেখালেখির একটা পর্যালোচনা ছাপানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। এতে বহু লেখক ও পাঠক নানা কিছু শিখতে পারবেন।
গোলাম মুরশিদকে ধন্যবাদ, এই চমৎকার ও উদ্ধৃতিবহুল প্রবন্ধ লেখার জন্য।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
আমি মনে করি, ‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য কোনো প্রয়োজনীয় টিভি চ্যানেল হতে পারে না। জাতীয় সংসদের অধিবেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যের খাতিরে আমাকে বলতেই হবে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যত বক্তৃতা বা বিতর্ক হয়, তার খুব কম অংশই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সম্পূর্ণ অধিবেশন লাইভ টিভিতে প্রচার করা মোটেও অর্থপূর্ণ কাজ হবে না। তা ছাড়া টিভি একটি দৃশ্যপ্রধান মাধ্যম। যেখানে ‘শোনা’ ও ‘দেখা’ একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়, সেখানে টিভি মাধ্যম বেশি উপযোগী। সংসদ অধিবেশন নিতান্তই শোনার ব্যাপার, দেখার কিছু নেই। ঘুরেফিরে একই মুখ, একই দৃশ্য। বৈচিত্র্যও নেই। শোনার জন্য রেডিও তো রয়েছেই। আগ্রহী শ্রোতা বা রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা রেডিও শুনে তাঁদের চাহিদা মেটাতে পারছেন। সংসদ অধিবেশন টিভিতে লাইভ সম্প্র্রচারের জন্য কোনো দাবি উঠেছিল বা কেউ মানববন্ধন বা অনশন করেছে—এমনটা শুনিনি। আমার মনে হয়, সরকার বা সংসদ সচিবালয় একটা অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে যাচ্ছে। এখনো যদি সময় থাকে, এই উদ্যোগ বন্ধ করা উচিত।
আমি সংসদ অধিবেশন, সংসদীয় কমিটির সভা ও সংসদের অন্যান্য কার্যাবলিকে ছোট করে দেখছি না। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে সংসদই তো প্রাণ। আমাদের দেশে নানা কারণে সংসদ কার্যকর হয়নি বা বিরোধী দল সংসদকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে—এগুলো ভিন্ন প্রসঙ্গ। এসব বিষয় নিয়ে বহু কথা হয়েছে। সামনে আরও হবে। তবে ফল কী হবে, তা বলা মুশকিল। যেমন, অনেক বছর যাবৎ সমালোচনা সত্ত্বেও তুচ্ছ অজুহাতে প্রধান বিরোধী দল সংসদ অধিবেশন বর্জন করেই চলেছে। শত সমালোচনাও কি বিরোধী দলকে ফেরাতে পেরেছে সংসদে? এগুলো আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। এসব থেকে আমরা কবে নিষ্কৃতি পাব, তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ নিয়ে আমার আপত্তি থাকলেও সংসদ অধিবেশনকে মিডিয়ায় ভালো করে কভারেজ দিতে আমার আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে রকম কভারেজ হচ্ছে না। সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভির ‘খবরে’ সংসদ অধিবেশনের শুধু মূল কথাগুলো স্থান পায়। কারণ, গণমাধ্যমের চালকেরা জানেন, এর বেশি বিবরণ পড়তে বা শুনতে পাঠক-দর্শকেরা আগ্রহী নয়। পাঠক-দর্শক আগ্রহী হলে গণমাধ্যমে বেশি সময় বা জায়গা দেওয়া হবে না—এমন বোকা সাংবাদিকেরা নন। একাত্তরের আগে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের বিবরণ সংবাদপত্রের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হতে দেখেছি বক্তাদের স্ট্যাম্প সাইজ ছবিসহ। কৈশোরের সেই স্মৃতি এখনো মনে ভাসে। এখন সেই দিন আর নেই। যতই সংসদ টিভি চ্যানেল চালু করুক না কেন, সংসদ অধিবেশনের সেই আকর্ষণ আর নেই। এখনকার সংসদে বিরোধী দলের সেই এজেন্ডাও আর নেই। এখন কে কাকে চোর বলছে, দর্শক তা জানে। এখন দেশজুড়ে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের’ রাজনীতি। কে কার সমালোচনা করবে!
সরকার-নিয়ন্ত্রিত ‘বিটিভি’ ও ‘বেতারে’ সংসদ অধিবেশন নিয়ে একটি সাপ্তাহিক বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করার সুযোগ আছে। যদি করতে জানে। যদি প্রযোজকের কিছুটা স্বাধীনতা থাকে। প্রযোজকের স্বাধীনতা ও দক্ষতার অভাব ঘটলে সেই অনুষ্ঠানও হবে বিরক্তিকর। দর্শকেরা তখন ভাববে, ‘এর চেয়ে ছায়াছবির গান শোনালেই ভালো হতো।’
সরকারের মধ্যে কে বা কারা কী চিন্তা থেকে সংসদ টিভি চ্যানেলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি জানি না। সংসদ ও টিভি মাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণায় দুর্বলতা রয়েছে বলে আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু ‘সরকার’ খুব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তারা যা খুশি তা করতে পারে। আমার এই সামান্য নিবন্ধ তাদের থামাতে পারবে না।
সরকারের কাছে যদি সুযোগ থাকে (বিটিভির দ্বিতীয় চ্যানেল) তাহলে একটি ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ করার জন্য আমি প্রস্তাব দেব। আগেও লিখেছি। আরও অনেকে লিখেছেন বা বলেছেন। দেশে সুশিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা, সৃজনশীল প্রশ্ন, ভাষা শিক্ষা, সাক্ষরতা ইত্যাদির প্রসারে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি যোগ্য লোকের হাতে এর দায়িত্ব পড়ে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এর অনুষ্ঠানসূচি পরিকল্পিত হয়। আমলা বা দলীয় ক্যাডারদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা কার্যকর কোনো ‘শিক্ষা চ্যানেল’ হবে কি না সন্দেহ। শিক্ষাঙ্গনের দলীয় ক্যাডারদের আয়-রোজগারের আরেকটা পথ হতে পারে।
‘শিক্ষা চ্যানেলে’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা কর্মসূচি ও নীতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রসার ও সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে বর্তমানে যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা চ্যানেলের মাধ্যমে তাও দূর করা যায়। প্রি-স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা, শিক্ষার এমন কোনো স্তর নেই, টিভির মাধ্যমে যা নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের গাইড করা যায় না।
দেশব্যাপী আজকাল ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের খুব অভাব, বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে। ছুটির দিনে টিভির মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষকদের দিয়ে নানা বিষয়ে ক্লাস পরিচালনা করা যায়; সারা দেশে টিভির সামনে বসে ছাত্রছাত্রীরা তা দেখবে ও শিখবে। ‘শিক্ষা টিভি’ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে এক জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে, যদি সঠিক পরিকল্পনায় একে গড়ে তোলা যায়।
আমি শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নই। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা দিতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু বুঝতে পারি, আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ শিক্ষা বিস্তারে একটা বড় হাতিয়ার হতে পারে। আমাদের সেই হাতিয়ার আছে। আমরা তা ব্যবহার করছি না শুধু সিদ্ধান্তের অভাবে।
পাঠক, এবার আপনিই বলুন কোন টিভি চ্যানেল আমাদের বেশি দরকার? সংসদ অধিবেশনের বক্তৃতা? নাকি টিভির মাধ্যমে নানা বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের ক্লাস, শিক্ষক প্রশিক্ষণ? কোনটা বেশি জরুরি?
‘সংসদ টিভি চ্যানেলের’ পরিবর্তে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেল’ চালু করার জন্য সরকারপ্রধানের কাছে আমি বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। সরকারের কাছে যদি পর্যাপ্ত টাকা ও কারিগরি সুবিধা থাকে তাহলে ‘শিক্ষা টিভি চ্যানেলের’ পাশাপাশি ‘সংসদ টিভি চ্যানেল’ও হতে পারে। কিন্তু অগ্রাধিকার কোনটা, সেটা ঠিক করতে হবে।
সংবাদপত্র ও বাংলা ভাষা
আমাদের সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়ার কোনো পর্যালোচনা সচরাচর হয় না। ফলে সাংবাদিক ও প্রযোজকেরা তাঁদের ভুল বা দুর্বলতা বুঝতে পারেন না। কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়মিত এই পর্যালোচনা করলে খুব ভালো কাজ হতো। তবে যাঁরা করবেন, তাঁদের দক্ষতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে কাজটা অর্থবহ হবে না।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার (চৈত্র ১৪১৬ সংখ্যা) পত্রিকায় বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ সংবাদপত্রের বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটি চিন্তা-উদ্দীপক প্রবন্ধ (বাংলা ভাষা কোন পথে) লিখেছেন। তিনি ঢাকা ও কলকাতার কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্রের খবর ও শিরোনাম উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন বাংলা ভাষা ব্যবহারে কত ভুল শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। বিশেষ করে কলকাতার প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় যেভাবে ইংরেজি অনুকরণে বাংলা লেখা হয়, যা ঠিক নয়, তা তিনি দৃষ্টান্তসহ দেখিয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রভাবে আবার এসব ভুল বাংলাদেশের সংবাদপত্রেও প্রশ্রয় পেয়েছে।
গোলাম মুরশিদ একজন গবেষক ও সচেতন লেখক বলে তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেই হয়। তা ছাড়া, তিনি যুক্তি সহকারে ভুলগুলো চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বক্তব্যই শতভাগ ঠিক, সেই রায় দেওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি আলোচ্য প্রবন্ধ ও সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার ভুল প্রয়োগ সম্পর্কে বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সংবাদপত্রের পাতায় তাঁরা এই আলোচনার অবতারণা করতে পারেন। প্রবন্ধটি বিভিন্ন সংবাদপত্রে পুনর্মুদ্রণ করলে অনেক সাংবাদিক ও সাধারণ পাঠক এই বিষয়ে আগ্রহী হবেন বলে আশা করা যায়।
আমাদের সংবাদপত্রে মাসে অন্তত একবার নিজস্ব লেখালেখির একটা পর্যালোচনা ছাপানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। এতে বহু লেখক ও পাঠক নানা কিছু শিখতে পারবেন।
গোলাম মুরশিদকে ধন্যবাদ, এই চমৎকার ও উদ্ধৃতিবহুল প্রবন্ধ লেখার জন্য।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments