বিশেষ সাক্ষাৎকার-একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত by নাসিম আখতার মালিক
নাসিম আখতার মালিক। জন্ম ২২ এপ্রিল ১৯৩৩, কাশ্মীরে। দেশভাগের পর পাঞ্জাবের ঝিলামে বসবাস শুরু করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ে পড়াশোনা এবং কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শামীম আশরাফ মালিকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর নাসিম রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে তিনি একাত্তরের মার্চে ঢাকায় ছিলেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন। জিয়াউল হকের সামরিক শাসনামলে তাহেরা মাজহার আলী ও আসমা জাহাঙ্গীর প্রমুখের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন উইমেন অ্যাকশন ফোরাম। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে নাসিম আখতার ঢাকায় এলে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের পূর্বাপর রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো এবার বাংলাদেশে এসে আপনার কেমন অনুভূতি হলো? কী পরিবর্তন দেখলেন?
নাসিম আখতার একাত্তরে যে বাংলাদেশ দেখেছি, তার চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। আবার সমস্যাও আছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েছে। তার পরও বলব, পাকিস্তানের চেয়ে এখানকার অবস্থা অনেক ভালো। পাকিস্তানি মুদ্রার চেয়ে বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্যমান বেশি। এখানে মহিলারা অনেক বেশি এগিয়ে গেছেন। তাঁদের কাজের সুযোগ বেড়েছে, বেশিসংখ্যক নারী ঘরের বাইরে এসেছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় দিক।
প্রথম আলো দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নাসিম আখতার পাকিস্তানে ডানপন্থীদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। বিশেষ করে জিয়াউল হকের শাসনামল থেকে ডানপন্থীরা সবকিছু নিজেদের দখলে নিয়েছে। সরকার সামাল দিতে পারছে না। এখানেও ডানপন্থীরা সক্রিয়। তবে সরকার তাদের সামাল দিতে পারছে বলেই আমার ধারণা। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে। অন্যদিকে পাকিস্তান কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো একাত্তরে আপনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে কী করলেন?
নাসিম আখতার আমরা ওখানে (লাহোরে) গিয়ে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক সতীর্থ ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। কিন্তু খুব বেশি সাড়া পাইনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এখানকার ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তা ছাড়া সিন্ধুর মতো পাঞ্জাবেও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা প্রচার চালিয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙতে চান। তার আগেই অবশ্য ভুট্টো, ‘এধার হাম, ওধার তোম’ বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। বাঙালিদের সম্পর্কে নানা প্রচারণা চালিয়ে ভুট্টো ও তাঁর পার্টির সমর্থকেরা জনগণকে পক্ষে টেনে নিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানও তখন ভুট্টোকে সমর্থন করেছেন। এসব কারণেই সেনাবাহিনী এখানে সামরিক অভিযান চালাতে পেরেছে। তার পরেও আমরা ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলেছি, সামরিক অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে যে বিবৃতি তৈরি করেছিলাম, তাতে শত চেষ্টা করেও ৪৩ জনের বেশি সই নিতে পারিনি। সইদাতাদের মধ্যে ছিলেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আই এ রহমান, মজহার আলী খান, তাহেরা মজহার আলী খান, হামিদ আখতার, আবদুল্লাহ মালিক, হাবিব জালিব, আমিন মোঘল, মাওলানা আশফাক, জাফর মালিক, ইমতিয়াজ শাহ, এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান প্রমুখ। স্থানীয় পত্রিকায় তা ছাপাও হয়েছিল। একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বললেন, জনগণ যদি চায় তাহলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি জানতেন, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ এর বিরুদ্ধে।
সে সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অনেক নেতা-কর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন ঘরোয়া বৈঠকে বসতাম, আবার আনুষ্ঠানিক সভাও হতো। এ রকম একটি সভা থেকে আমরা ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযানের সমালোচনা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবকে মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম। সেই সভায় পিপলস পার্টির কিছু লোক এসে গোলযোগ শুরু করল। ফলে দুই পক্ষে হাতাহাতি হলো। আমাদের দলের কিছু তরুণ ‘পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করো, শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও’ সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। আহমেদ সেলিম কবিতা লিখেছিলেন, ‘দেশ চলছে বুটের জোরে’। এ জন্য তাঁর জেল হয়েছিল। মাওলানা আশফাক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন, আওয়ামী ফিকরি মাহাজ। সেখানে বিভিন্ন মতের লোক আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে গিয়ে কথা বলতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলছিল।
প্রথম আলো আপনার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা কী ছিল?
নাসিম আখতার বাংলাদেশের ঘটনায় তারা দু-একটি বিবৃতি দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল্লাহ মালিক ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যে জন্য সামরিক আদালত তাঁকে জেলে দেন। হাবিব জালিদ লিখেছিলেন, ‘সবুজ দেখার জন্য আমার চোখ উন্মীলিত কিন্তু বাগানে বইছে রক্তের ধারা।’
প্রথম আলো শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন পাকিস্তানের জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেন, সেদিন আপনার অনুভূতি কী ছিল?
নাসিম আখতার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেখ মুজিব মুক্তি পাওয়ায় একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। একাত্তরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাদের দলের যেসব কর্মী আটক হয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করতে জেলখানায় যেতাম। খাবার দিতাম। মনে পড়ে ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, সেদিন জেলখানায় গিয়ে তাদের খবরটি দিলে তারা ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দ প্রকাশ করল। আমিও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললাম, ‘জয় বাংলা’। ভুট্টো ক্ষমতায় আসার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তাদের ওপর সরকারের হয়রানি-নজরদারি চলতে পারে। যে কারণে বামপন্থী অনেক তরুণ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যায়।
প্রথম আলো ভুট্টোর সরকারের সঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্পর্ক কেমন ছিল?
নাসিম আখতার রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। ভুট্টোর সরকার নেতাদের গায়ে হাত না দিলেও কর্মীদের ব্যাপক হারে জেলে পুরেছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়েছে। তার পরও গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনে যেতে চাননি। যদিও ওয়ালী খান, আজমল খাটক প্রমুখ মনে করতেন, ভুট্টোর সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। কিন্তু বেজেঞ্জোর যুক্তি ছিল, ‘আমাদের সংগ্রাম তো শেষ হয়নি। পথের প্রতিটি কাঁটা তুলতে হবে, পাথর সরাতে হবে। আমরা যদি এখনই ভুট্টোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাই, প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা সুযোগ নেবেন। সে ক্ষেত্রে ভুট্টো ও মুজিব কেউ থাকবেন না।’ তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। এর তিন প্রধান নেতা ছিলেন শামীম আশরাফ মালিক, নাজেল আমরোহী ও জামাল নাকভি। শামীম আশরাফ মালিক সংঘাতের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু অপর দুজন সংঘাতের পক্ষে অবস্থান নেন।
প্রথম আলো সামরিক শাসক জিয়াউল হক অনেক জনবিরোধী আইন জারি করেছিলেন, বিশেষ করে হুদুদ ও ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কি আপনারা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন?
নাসিম আখতার জিয়াউল হক ক্ষমতায় এসে সব দলের নেতা-কর্মীদের জেলখানায় ঢোকালেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করলেন। মানুষ আতঙ্কিত ছিল। পরে ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। লাহোরে তাহেরা মাজহার আলীর নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হয়েছিল, যাতে আমি অনুপস্থিত থাকলেও আমার ১৫ বছরের ছেলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী চারপাশ থেকে ঘেরাও করে পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে যায়। পরে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদের ছেড়ে দিলেও আমার ছেলেকে ছয় মাসের জেল ও পাঁচ বেত্রাঘাত দেয়। আমার সামনেই তাকে বেত্রাঘাত দেওয়া হয়।
সে সময় আমরা উইলস অ্যাকশন ফোরাম গঠন করি। সে আন্দোলনে আসমা জাহাঙ্গীরও ছিলেন।
প্রথম আলো জিয়াউল হকের শক্তির উৎস কী ছিল?
নাসিম আখতার তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল সেনাবাহিনী। দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করেছিল। পিপিপির বহু কর্মী জীবন দেন। অন্যদিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের অজুহাতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাঁকে সমর্থন করে। জামায়াতে ইসলামীসহ সব ধর্মভিত্তিক দল তাঁর সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান গদিতে বসার প্রেক্ষাপটে কবি হাবিব জালিব লিখেছিলেন, ‘হে রাজাধিরাজ, আপনি যাকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, একসময় তিনিও নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন।’ কবিতার এ লাইনগুলো জিয়াউল হকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রথম আলো পাকিস্তানের প্রগতিশীল দলগুলোর বর্তমান অবস্থা কী?
নাসিম আখতার পাকিস্তানের প্রগতিশীল পার্টি বলতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেই বোঝায়। কিন্তু এই পার্টি এখন নানা ভাগে বিভক্ত। ন্যাপ থেকে ওয়ালী খান আলাদা হয়ে গঠন করেছিলেন পিএনপি। বেজেঞ্জোও আলাদা পার্টি করেন। আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল কঠোর লাইন নেন। অনেক নেতা-কর্মী বিদেশে চলে গেলেন। বালুচ নেতারা আলাদা পার্টি করেন। পাঞ্জাব ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা-কর্মীরা গঠন করেন ন্যাশনাল ওয়ার্কার পার্টি। কিন্তু তাঁরাও তেমন সক্রিয় নন।
প্রথম আলো পাকিস্তানে নারীর অবস্থা কী?
নাসিম আখতার একটি বিষয়ে পারভেজ মোশাররফকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। তিনি নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সময়ে স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বহু নারী সদস্য নিয়ে এসেছেন, যা পিপিপির আমলেও ছিল না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীরা সামনে এসেছেন। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রগতিশীলদের তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। কিন্তু আইনজীবীরা ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর বিষয়টি সামনে নিয়ে এলে পরিস্থিতি পারভেজ মোশাররফের বিপক্ষে চলে যায়। এ ছাড়া তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেছিলেন।
প্রথম আলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ধারণা কী?
নাসিম আখতার পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এ বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। যদিও তাঁরা মনে করেন, পাকিস্তান ভাঙা ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনুশোচনা করে, নিজেদের ভুল স্বীকার করে। কিন্তু যখন এ কথাগুলো বলা দরকার ছিল, তখন বলেনি। এটাই হলো নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা।
প্রথম আলো আপনি কি মনে করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
নাসিম আখতার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি একটি ঘটনার উল্লেখ করব। লাহোরে এক সমাবেশে একজন বক্তা পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করলে পুরো কক্ষ স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই মুখ চাওয়া-চাউয়ি করেন। তখন তাহেরা মাজহার আলী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি মনে করি, ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
আমিও মনে করি, একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটি পাকিস্তানের জন্য ভালো হবে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আর ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি সরকারেরই ক্ষমা চাওয়া উচিত, একাত্তরের ঘটনার জন্য তাদের দায়ও কম নয়।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসিম আখতার ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো এবার বাংলাদেশে এসে আপনার কেমন অনুভূতি হলো? কী পরিবর্তন দেখলেন?
নাসিম আখতার একাত্তরে যে বাংলাদেশ দেখেছি, তার চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। আবার সমস্যাও আছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েছে। তার পরও বলব, পাকিস্তানের চেয়ে এখানকার অবস্থা অনেক ভালো। পাকিস্তানি মুদ্রার চেয়ে বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্যমান বেশি। এখানে মহিলারা অনেক বেশি এগিয়ে গেছেন। তাঁদের কাজের সুযোগ বেড়েছে, বেশিসংখ্যক নারী ঘরের বাইরে এসেছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় দিক।
প্রথম আলো দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নাসিম আখতার পাকিস্তানে ডানপন্থীদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। বিশেষ করে জিয়াউল হকের শাসনামল থেকে ডানপন্থীরা সবকিছু নিজেদের দখলে নিয়েছে। সরকার সামাল দিতে পারছে না। এখানেও ডানপন্থীরা সক্রিয়। তবে সরকার তাদের সামাল দিতে পারছে বলেই আমার ধারণা। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে। অন্যদিকে পাকিস্তান কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো একাত্তরে আপনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে কী করলেন?
নাসিম আখতার আমরা ওখানে (লাহোরে) গিয়ে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক সতীর্থ ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। কিন্তু খুব বেশি সাড়া পাইনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এখানকার ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তা ছাড়া সিন্ধুর মতো পাঞ্জাবেও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা প্রচার চালিয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙতে চান। তার আগেই অবশ্য ভুট্টো, ‘এধার হাম, ওধার তোম’ বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। বাঙালিদের সম্পর্কে নানা প্রচারণা চালিয়ে ভুট্টো ও তাঁর পার্টির সমর্থকেরা জনগণকে পক্ষে টেনে নিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানও তখন ভুট্টোকে সমর্থন করেছেন। এসব কারণেই সেনাবাহিনী এখানে সামরিক অভিযান চালাতে পেরেছে। তার পরেও আমরা ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলেছি, সামরিক অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে যে বিবৃতি তৈরি করেছিলাম, তাতে শত চেষ্টা করেও ৪৩ জনের বেশি সই নিতে পারিনি। সইদাতাদের মধ্যে ছিলেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আই এ রহমান, মজহার আলী খান, তাহেরা মজহার আলী খান, হামিদ আখতার, আবদুল্লাহ মালিক, হাবিব জালিব, আমিন মোঘল, মাওলানা আশফাক, জাফর মালিক, ইমতিয়াজ শাহ, এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান প্রমুখ। স্থানীয় পত্রিকায় তা ছাপাও হয়েছিল। একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বললেন, জনগণ যদি চায় তাহলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি জানতেন, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ এর বিরুদ্ধে।
সে সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অনেক নেতা-কর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন ঘরোয়া বৈঠকে বসতাম, আবার আনুষ্ঠানিক সভাও হতো। এ রকম একটি সভা থেকে আমরা ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযানের সমালোচনা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবকে মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম। সেই সভায় পিপলস পার্টির কিছু লোক এসে গোলযোগ শুরু করল। ফলে দুই পক্ষে হাতাহাতি হলো। আমাদের দলের কিছু তরুণ ‘পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করো, শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও’ সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। আহমেদ সেলিম কবিতা লিখেছিলেন, ‘দেশ চলছে বুটের জোরে’। এ জন্য তাঁর জেল হয়েছিল। মাওলানা আশফাক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন, আওয়ামী ফিকরি মাহাজ। সেখানে বিভিন্ন মতের লোক আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে গিয়ে কথা বলতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলছিল।
প্রথম আলো আপনার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা কী ছিল?
নাসিম আখতার বাংলাদেশের ঘটনায় তারা দু-একটি বিবৃতি দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল্লাহ মালিক ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যে জন্য সামরিক আদালত তাঁকে জেলে দেন। হাবিব জালিদ লিখেছিলেন, ‘সবুজ দেখার জন্য আমার চোখ উন্মীলিত কিন্তু বাগানে বইছে রক্তের ধারা।’
প্রথম আলো শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন পাকিস্তানের জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেন, সেদিন আপনার অনুভূতি কী ছিল?
নাসিম আখতার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেখ মুজিব মুক্তি পাওয়ায় একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। একাত্তরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাদের দলের যেসব কর্মী আটক হয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করতে জেলখানায় যেতাম। খাবার দিতাম। মনে পড়ে ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, সেদিন জেলখানায় গিয়ে তাদের খবরটি দিলে তারা ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দ প্রকাশ করল। আমিও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললাম, ‘জয় বাংলা’। ভুট্টো ক্ষমতায় আসার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তাদের ওপর সরকারের হয়রানি-নজরদারি চলতে পারে। যে কারণে বামপন্থী অনেক তরুণ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যায়।
প্রথম আলো ভুট্টোর সরকারের সঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্পর্ক কেমন ছিল?
নাসিম আখতার রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। ভুট্টোর সরকার নেতাদের গায়ে হাত না দিলেও কর্মীদের ব্যাপক হারে জেলে পুরেছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়েছে। তার পরও গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনে যেতে চাননি। যদিও ওয়ালী খান, আজমল খাটক প্রমুখ মনে করতেন, ভুট্টোর সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। কিন্তু বেজেঞ্জোর যুক্তি ছিল, ‘আমাদের সংগ্রাম তো শেষ হয়নি। পথের প্রতিটি কাঁটা তুলতে হবে, পাথর সরাতে হবে। আমরা যদি এখনই ভুট্টোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাই, প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা সুযোগ নেবেন। সে ক্ষেত্রে ভুট্টো ও মুজিব কেউ থাকবেন না।’ তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। এর তিন প্রধান নেতা ছিলেন শামীম আশরাফ মালিক, নাজেল আমরোহী ও জামাল নাকভি। শামীম আশরাফ মালিক সংঘাতের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু অপর দুজন সংঘাতের পক্ষে অবস্থান নেন।
প্রথম আলো সামরিক শাসক জিয়াউল হক অনেক জনবিরোধী আইন জারি করেছিলেন, বিশেষ করে হুদুদ ও ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কি আপনারা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন?
নাসিম আখতার জিয়াউল হক ক্ষমতায় এসে সব দলের নেতা-কর্মীদের জেলখানায় ঢোকালেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করলেন। মানুষ আতঙ্কিত ছিল। পরে ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। লাহোরে তাহেরা মাজহার আলীর নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হয়েছিল, যাতে আমি অনুপস্থিত থাকলেও আমার ১৫ বছরের ছেলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী চারপাশ থেকে ঘেরাও করে পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে যায়। পরে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদের ছেড়ে দিলেও আমার ছেলেকে ছয় মাসের জেল ও পাঁচ বেত্রাঘাত দেয়। আমার সামনেই তাকে বেত্রাঘাত দেওয়া হয়।
সে সময় আমরা উইলস অ্যাকশন ফোরাম গঠন করি। সে আন্দোলনে আসমা জাহাঙ্গীরও ছিলেন।
প্রথম আলো জিয়াউল হকের শক্তির উৎস কী ছিল?
নাসিম আখতার তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল সেনাবাহিনী। দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করেছিল। পিপিপির বহু কর্মী জীবন দেন। অন্যদিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের অজুহাতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাঁকে সমর্থন করে। জামায়াতে ইসলামীসহ সব ধর্মভিত্তিক দল তাঁর সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান গদিতে বসার প্রেক্ষাপটে কবি হাবিব জালিব লিখেছিলেন, ‘হে রাজাধিরাজ, আপনি যাকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, একসময় তিনিও নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন।’ কবিতার এ লাইনগুলো জিয়াউল হকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রথম আলো পাকিস্তানের প্রগতিশীল দলগুলোর বর্তমান অবস্থা কী?
নাসিম আখতার পাকিস্তানের প্রগতিশীল পার্টি বলতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেই বোঝায়। কিন্তু এই পার্টি এখন নানা ভাগে বিভক্ত। ন্যাপ থেকে ওয়ালী খান আলাদা হয়ে গঠন করেছিলেন পিএনপি। বেজেঞ্জোও আলাদা পার্টি করেন। আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল কঠোর লাইন নেন। অনেক নেতা-কর্মী বিদেশে চলে গেলেন। বালুচ নেতারা আলাদা পার্টি করেন। পাঞ্জাব ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা-কর্মীরা গঠন করেন ন্যাশনাল ওয়ার্কার পার্টি। কিন্তু তাঁরাও তেমন সক্রিয় নন।
প্রথম আলো পাকিস্তানে নারীর অবস্থা কী?
নাসিম আখতার একটি বিষয়ে পারভেজ মোশাররফকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। তিনি নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সময়ে স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বহু নারী সদস্য নিয়ে এসেছেন, যা পিপিপির আমলেও ছিল না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীরা সামনে এসেছেন। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রগতিশীলদের তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। কিন্তু আইনজীবীরা ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর বিষয়টি সামনে নিয়ে এলে পরিস্থিতি পারভেজ মোশাররফের বিপক্ষে চলে যায়। এ ছাড়া তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেছিলেন।
প্রথম আলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ধারণা কী?
নাসিম আখতার পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এ বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। যদিও তাঁরা মনে করেন, পাকিস্তান ভাঙা ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনুশোচনা করে, নিজেদের ভুল স্বীকার করে। কিন্তু যখন এ কথাগুলো বলা দরকার ছিল, তখন বলেনি। এটাই হলো নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা।
প্রথম আলো আপনি কি মনে করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
নাসিম আখতার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি একটি ঘটনার উল্লেখ করব। লাহোরে এক সমাবেশে একজন বক্তা পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করলে পুরো কক্ষ স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই মুখ চাওয়া-চাউয়ি করেন। তখন তাহেরা মাজহার আলী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি মনে করি, ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
আমিও মনে করি, একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটি পাকিস্তানের জন্য ভালো হবে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আর ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি সরকারেরই ক্ষমা চাওয়া উচিত, একাত্তরের ঘটনার জন্য তাদের দায়ও কম নয়।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসিম আখতার ধন্যবাদ।
No comments